১
নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার বেদনা কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। যে শহরে তার জন্ম, যে আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছেন, সে শহরকে আজ বিদায় জানাতে হচ্ছে রাতের আঁধারে। খুশনান নামে পরিচিত গলি ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি, দুপাশে তাকে পাশ কাটাচ্ছে বিবর্ণ দেয়াল। দুয়েকটি ঘরের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ছে গলিতে, আবুল মাআলি জুয়াইনি জানেন এই আলো তার জন্য বিপদজনক। যে কেউ চিনে ফেলতে পারে তাকে। এখন পর্যন্ত দুয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধু ছাড়া আর কেউ তার শহর ত্যাগের বিষয়টি জানে না। তিনি চান কেউ টের পাওয়ার আগে নিশাপুর থেকে দুরে সরে যেতে।
জামে মসজিদের সামনে পৌছতে বুকের ভেতর আবেগ অনুভব করলেন জুয়াইনি। আব্বাসি আমলের শুরুতে আবু মুসলিম খুরাসানির হাতে নির্মিত এই মসজিদের সাথে মিশে আছে নিশাপুরবাসির আবেগ অনুভূতি। এই মসজিদকে ঘিরে তার নিজের স্মৃতিও কম নয়। বাল্যকালে এই মসজিদের চত্বরে বসেই তিনি নিয়েছিলেন কোরআন শিক্ষার পাঠ। পরে এখানেই বসেছেন আবুল কাসেম ইসফারাইনির দরসে। মসজিদের দেয়ালে পরম মমতা নিয়ে হাত বুলালেন জুয়াইনি। এই মসজিদের খতিব ছিলেন তার বন্ধু। সম্প্রতি তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়েছে। ‘আমার নিশাপুর ভালো নেই’ মনে মনে ভাবলেন জুয়াইনি। আমর বিন লাইসের প্রাসাদের ভগ্নস্তুপ পাশ কাটালেন জুয়াইনি, তাড়া অনুভব করছেন। রাতের মধ্যেই শহর থেকে দুরে সরে যেতে চান তিনি।
কিবাব ফটকের গলিতে প্রবেশ করতেই চলার গতি কমিয়ে দিলেন জুয়াইনি। জানেন ফটকের পাশেই অবস্থান করছে সশস্ত্র প্রহরীরা। শহর ত্যাগ করতে চাইলে মুখোমুখি হতে হবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের। অবশ্য বিকল্প পরিকল্পনা ঠিক করা আছে। ফটক থেকে একটু দুরে প্রাচীরের গায়ে একটা বড়সড় ফাটল আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মানুষ বের হওয়ার মত বড় নয় ফাটলটা, কিন্তু দিনের বেলা তার কজন বন্ধু এসে ফাটলকে বড় করে রেখেছে, এখন বের হতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
অনুমান করে ফাটলের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন জুয়াইনি। সাথে মশাল আছে, কিন্তু একান্ত বাধ্য না হলে জ্বালতে চান না তিনি। আকাশে চাঁদ উঠেছে, মৃদু জ্যোৎস্নায় আলোকিত চারপাশ। সে আলোয় প্রাচীরের ভগ্নস্থানে শরীর গলিয়ে দিলেন তিনি। বন্ধুরা চেষ্টা করলেও জুয়াইনি বুঝতে পারলেন, তারা আসলে খুব একটা বড় করতে পারেনি। না পারারই কথা, পাথুরে দেয়াল ভাঙ্গার মত পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ছিল না তাদের কাছে। জুয়াইনি অনেক কষ্টে নিজেকে বের করতে সক্ষম হলেন, কিন্তু পাথরের খোঁচায় পোশাকের কয়েক জায়গা ছিঁড়ে গেল। প্রাচীরের গায়ে একটি ঘোড়া বেধে রাখা হয়েছে, এক বন্ধুর উপহার। ঘোড়ায় চড়ে বসলেন জুয়াইনি।
শেষবারের মতো নিশাপুরের দিকে তাকালেন জুয়াইনি। চাঁদের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে নগরপ্রাচীর, জামে মসজিদের সুউচ্চ মিনার। তিক্ত মনে জুয়াইনি ভাবলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে হয়তো আর কখনোই এখানে ফিরে আসা হবে না। বুকে দীর্ঘশ্বাস চেপে তিনি ঘোড়া ছুটালেন কিরমানের দিকে।
–
জুয়াইনির নিশাপুর ত্যাগের সংবাদ জানাজানি হলো পরদিন বিকালে। অন্যদিনের মত তাকে দরসে না পেয়ে ছাত্ররা খোঁজ নিতে গেল বাড়িতে। পরিবারের লোকজন কথা এড়িয়ে গেলেও পরিষ্কার বোঝা গেল জুয়াইনি শহরে নেই। কোনো এক সুযোগে শহর ছেড়েছেন তিনি। জুয়াইনির শহর ত্যাগের সংবাদে জনসাধারণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। বন্ধুরা ব্যাথিত হলেন, শত্রুরা কিছুটা খুশি, আপদ কমেছে ভেবে। তুস থেকে আসা ব্যবসায়ী খুবানি বিক্রি করতে করতে কান খাড়া করে শুনল জুয়াইনির শহরত্যাগের সংবাদ, মনে মনে কিছুটা হতাশ সে। তার আশা ছিল ব্যবসায়িক ব্যস্ততা শেষে জুয়াইনির দরসে বসবে।
জুয়াইনির শহর ত্যাগের সংবাদ শুনলেন হাফেজ আবু বকর বাইহাকিও। মসজিদে আকিলে দরসদানকালে তিনি জানলেন তরুণ আলেম জুয়াইনি শহর ছেড়েছেন। উপস্থিত ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন, কোনোদিন হয়তো তাকেও শহর ছাড়তে হবে। প্রতিদিনই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ইতিমধ্যে তার বন্ধুদের অনেককেই দরস-খুতবা-বয়ান করতে নিষেধ করা হয়েছে। অনেককে বাধ্য করা হচ্ছে প্রশাসনের মনোমতো খুতবা দিতে। তার উপর এখনো কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি, কিন্তু তিনি জানেন খুব দ্রুত তিনিও আক্রান্ত হবেন। সেলজুকি উজির কুন্দুরি তার জাল গুটিয়ে আনছে, এবার শিকারের পালা।
২
আবু বকর বাইহাকির আশংকা অমূলক নয়। ৪৪৫ হিজরি থেকে নিশাপুরের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে এসেছে নানা নাটকীয়তা ও পরিবর্তন। কবছর ধরেই সেলজুক সুলতান তুগ্রিল বেগ নিজের শক্তি ও রাজত্বের সীমানা বৃদ্ধি করছিলেন, ৪৪৪ সালের মধ্যে তিনি কাজভিন, আবহার, জানজান, হামদান, রায়সহ পারস্যের পুরো এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। আব্বাসি খলিফা কায়িম বি আমরিল্লাহর প্রচ্ছন্ন সমর্থন তুগ্রিল বেগকে ক্রমেই সাহসী করে তুলেছে। এখন তার চিন্তা বুয়াইহিদের হাত থেকে আব্বাসি খেলাফতকে উদ্ধার করা। তুগ্রিল বেগের ইচ্ছার কথা আলেমরা জানতেন, তারা সুলতানের জন্য নিয়মিত দোয়াও করছিলেন, কিন্তু ৪৪৫ হিজরিতে আচমকা পরিস্থিতির রদবদল ঘটেছে। দেখা দিয়েছে নতুন এক সমস্যা যা কারো কল্পনাতেও ছিল না।
সুলতান তুগ্রিল বেগ একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম, ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফি মাজহাব অনুসরণ করেন, আলেমদের সাথে সুসম্পর্ক রাখেন। ব্যক্তিগত জীবনেও অত্যন্ত ধার্মিক তিনি। ফরজ আদায়ের পাশাপাশি নফল ইবাদাতেও সুলতান বেশ অগ্রসর। সুলতানের খাদেমদের মুখে জানা যায়, প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখেন তিনি। সফর না থাকলে কখনো তার তাহাজ্জুদ বাদ পড়ে না। মসজিদ নির্মাণে তার বেশ আগ্রহ। কিছুদিন আগে এক বন্ধুকে তিনি বলেছেন, আমি নিজের জন্য ঘর নির্মান করে এর পাশে মসজিদ নির্মান না করলে আল্লাহর কাছে লজ্জিত অনুভব করি।
বাহ্যত সুলতানের সাথে আলেমদের কোনো বিরোধ নেই। সবাই যেমন শাসক আশা করে ঠিক তেমন শাসক তিনি। কিন্তু সুলতানের একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে আলেমদের সাথে সুলতানের বিরোধ ও তিক্ততা বেড়েছে। ৪৪৫ হিজরিতে সুলতান তাঁর উজির হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন আবু নাসর মুহাম্মদ ইবনু মানসুর ইবনু মুহাম্মদ কুন্দুরিকে। তাকে উপাধি দেয়া হয়েছে আমিদুল মুলক। আশ্চর্যের বিষয় হলো, স্বভাব চরিত্রে সুলতানের শতভাগ বিপরীতে উজিরের অবস্থান। সুলতান একনিষ্ঠ আহলুস সুন্নাহর অনুসারী হলেও উজির আকিদা বিশ্বাসের দিক থেকে রাফেজি মতবাদ ও মুতাযিলা মতবাদকে অনুসরণ করেন। শুধু তাই নয়, তাঁর আকিদা বিশ্বাসে প্রভাব আছে কারামিয়্যা ও মুজাসসিমা মতবাদেরও।
কুন্দুরির নিয়োগের সংবাদ শুনে চমকে উঠেছেন নিশাপুরের আলেমগণ। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানেন, বিকৃত আকিদা বিশ্বাসের লোকজন প্রশাসনের দায়িত্ব পাওয়ার অর্থ হলো, আহলুস সুন্নাহর উপর দমন-নির্যাতন চলবে। সমরকন্দ থেকে বেড়াতে আসা একজন আলেম সাবুনিয়া মাদরাসার কুতুবখানায় অন্য আলেমদের সাথে সাক্ষাতকালে মন্তব্য করেন, আগত দিনগুলো সম্ভবত কঠিন হতে যাচ্ছে। তার কথার ইংগিত ছিল উজির কুন্দুরির দিকে।
উজির কুন্দুরির মনেও খেলা করছে আশংকা। তার ব্যাপারে আলেমদের মনোভাব তার অজানা নয়। তার সবচেয়ে ভয় শাফেয়ী আলেম আবু সাহল ইবনুল মুয়াফফাককে নিয়ে। নিশাপুরের আলেমদের মাঝে ইবনুল মুয়াফফাকের রয়েছে অসামান্য প্রভাব। হানাফি আলেমরাও তার দরসে নিয়মিত উপস্থিত হন। জনসাধারণের সাথেও রয়েছে ইবনুল মুয়াফফাকের সখ্যতা। অর্থ ও বিত্তেও তিনি এগিয়ে। কুন্দুরির মনে ভয়, সুলতানের সাথে যদি ইবনুল মুয়াফফাকের সম্পর্ক স্থাপিত হয় তাহলে সুলতান হয়তো তাকে সরিয়ে ইবনুল মুয়াফফাককেই উজির পদে নিয়োগ দিবেন। শোনা যাচ্ছে ইবনুল মুয়াফফাকের সাথে তুগ্রিল বেগের পারিবারিক সম্পর্কও আছে।
ইবনুল মুয়াফফাককে নিয়ে মনে মনে পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল কুন্দুরি, এর মাঝেই শুরু হলো দুজনের মুখোমুখি দ্বন্দ্ব। আবু সাইদ খাশশাবের ব্যক্তিগত কুতুবখানায় প্রতি সপ্তাহেই আলেমদের মজলিস বসে, সেখানে নানা বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। এখানেই ইবনুল মুয়াফফাকের সাথে এক মাসআলায় তর্কে জড়ালেন কুন্দুরি। অবাক বিস্ময়ে তিনি লক্ষ্য করলেন উপস্থিত সবাই কোনো দ্বিধা ছাড়াই ইবনুল মুয়াফফাকের কথা মেনে নিচ্ছে। কুন্দুরি সেলজুকদের প্রভাবশালী উজির হওয়া সত্ত্বেও তার কথার দিকে কর্নপাত করলো না কেউ। রাগে অপমানে কুন্দুরি নিজের বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু মনে জ্বলে উঠলো হিংসার দাবানল।
–
শীতের শুরুতে তুগ্রিল বেগ রাজসভা আহ্বান করেন। এতদিনে তিনি বাগদাদ প্রবেশের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুবছর ধরে একের পর এক পত্র মারফত তিনি খলিফার কন্যাকে বিয়ের আগ্রহ প্রকাশ করলেও খলিফা সাড়া দেননি। কিন্তু সম্প্রতি খলিফা তার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন। ফলে এখন বাগদাদ ও প্রবেশ ও খলিফা কন্যার সাথে বিবাহতে এঁর কোনো বাধা রইলো না।
নির্ধারিত দিনে তাবরিজ শহরে উপস্থিত হলেন সেলজুকদের গুরুত্বপূর্ন কর্মকর্তাবৃন্দ। সুলতানের প্রাসাদের সামনে বিছানো হলো পারসিয়ান কার্পেট। একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে সামনে এগুলেন সেলজুক প্রশাসকরা। প্রাসাদের ফটকে অপেক্ষা করছিলেন তুগ্রিল বেগে। সুলতানের চেহারায় আনন্দ খেলা করছিল। ষাট বছর বয়স হলেও এখনো তিনি একজন তরুণের মতই সুঠামদেহের অধিকারী। তার সুদর্শন চেহারায় রয়েছে ব্যক্তিত্বের ছটা। নির্ধারিত সময় রাজসভা শুরু হলে প্রশাসকরা ডুবে গেলেন খুঁটিনাটি আলোচনায়। তবে উজির কুন্দুরি সযত্নে নিজেকে বিরত রাখলেন কথা বলা থেকে। তার মনে খেলা করছে অন্য চিন্তা।
৩
বিদায়ের আগে সুলতানের সাথে দেখা করার সুযোগ পেলেন কুন্দুরি। শাহী তাবুতে বসেছেন তারা দুজন। সামনে রাখা আছে নানা প্রকার ফলের শরবত। তাঁবুর একপাশে পর্দা উঠিয়ে রাখা হয়েছে। দুরে দেখা যাচ্ছে সেলজুক সেনাদের প্রশিক্ষণ মহড়া। কুন্দুরি মনে মনে কথা সাজাচ্ছেন। তিনি জানেন যা বলার একবারেই বলতে হবে, খুব বেশি সময় তিনি পাবেন না। কুন্দুরি চাচ্ছেন ইবনুল মুয়াফফাকের ব্যাপারে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু সরাসরি বললে সুলতান কোনো পদক্ষেপ নিবেন না। ফলে তাকে একটু ঘুরিয়েই বলতে হবে।
‘সুলতানের নিশ্চয় জানা আছে হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দী থেকেই নানা বাতিল মতবাদ মুসলিম বিশ্বে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নানা ভাবে তারা মানুষের আকিদা বিশ্বাস বিকৃত করেছে। সমাজে বিদআত ও ইলহাদের প্রবেশ ঘটিয়েছে। যতই দিন গেছে এ ধরণের মতবাদের সংখ্যা বেড়েছে। নিত্য নতুন বক্তব্য নিয়ে তারা সামনে এসেছে। ইখওয়ানুস স্ফার ব্যাপারেও সুলতান জানেন, তারা কীভাবে নিজেদের চিন্তা ছড়াতে ব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। আমাদেরকে অবশ্যই নিজেদের আকিদা বিশ্বাসে দৃঢ় থাকতে হবে। সুলতান যেমন নিজ রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধির দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনই সমাজের এসকল বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা নিরসনেও সুলতানের উদ্যোগ জরুরি। আমি নিশাপুর থেকে এসেছি, সেখানকার পরিস্থিতি আমার নিজ চোখে দেখা। সেখানকার বেশিরভাগ আলেম কুল্লাবি আকিদার অনুসারী। ফিকহের ক্ষেত্রে তারা সাধারণত হানাফি ও শাফেয়ী ফিকহ অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে অনেকেই আশআরি আকিদা অনুসরণ করে যা ইবনে কুল্লাবের বিকৃত চিন্তাধারা থেকে উৎসারিত। তারা বিদআতি চিন্তা লালন করে। সুলতানের উচিত এখনই শক্ত পদক্ষেপ নেয়া’ দৃঢ়তার সাথে বললেন কুন্দুরি। সুলতানের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি যদিও চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই মনে মনে কী চিন্তা করছেন তিনি।
‘এতো খুবই বড় সমস্যা। আমার ধারনাও ছিল না আলেমদের কেউ বিদআতি চিন্তা লালন করতে পারেন। এ অবস্থা অবশ্যই মেনে নেয়া হবে না। আমাদের সালতানাতে শুধু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশুদ্ধ আকিদাই চর্চা করা হবে। আপনি বলুন এই বিদআতিদের বিরুদ্ধে কী ধরণের পদক্ষেপ নেয়া যায়’ রাগতস্বরে বললেন সুলতান। বোঝা যাচ্ছে নিশাপুরের আলেমদের উপর উত্তেজিত হয়ে আছেন তিনি। মনে মনে হাসলেন কুন্দুরি। লোহা তেতে আছে এবার তাতে আঘাত করার পালা।
‘আমাদের উচিত বিদআতিদেরকে তাদের আকিদা বিশ্বাস প্রচারে বাধা দেয়া। তাদের সকল দরস-বয়ান-খুতবা নিষিদ্ধ করা। খতিবদের নির্দেশ দিতে হবে যেন তারা জুমার খুতবায় লোকজনকে বাতিল আকিদা সম্পর্কে সতর্ক করে। যদি বিদআতিদেরকে তাদের মতবাদ প্রচারে বাধা দেয়া না হয় তাহলে তারা আহলুস সুন্নাহর লোকদের আকিদা নষ্ট করবে’ কুন্দুরির গলায় জোর।
‘ঠিক বলেছেন। আজ থেকে সকল বিদআতিদের দরস-ওয়াজ-খুতবা নিষিদ্ধ করুন। প্রয়োজনে তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করুন। তারা যেসকল ব্যক্তির মতবাদ প্রচার করে চাই সে আশআরি হোক বা অন্য কেউ, তাদের বিরুদ্ধেও আলোচনা হোক। প্রয়োজনে জুমার খুতবায় তাদের নাম ধরে লানত করা হোক। যারা এ কাজ করবে না তাদেরকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিন’ ক্ষোভের সাথে বললেন তুগ্রিল বেগ।
মূল কাজ হয়ে গেছে। কুন্দুরি তাই সুলতানের সাথে অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করলেন। এখন তার মাথায় একটাই কাজ। দ্রুত নিশাপুর ফিরে সুলতানের নির্দেশ বাস্তবায়ন করা।
–
এক শুক্রবারে কিছু বুঝে উঠার আগেই নিশাপুরের জনসাধারণ দেখল জামে মসজিদের মিম্বরে জুমার খুতবায় ইমাম আবুল হাসান আশআরিকে লানত করছেন খতিব। অবিশ্বাস নিয়ে পুরো দৃশ্য দেখলেন আলেমরা, তখনো তারা বুঝে উঠতে পারেননি কী ঘটছে। কিন্তু পরের কয়েকদিনে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। প্রতিটি মসজিদে এসেছে কুন্দুরির নির্দেশ। স্পষ্ট বলা হলো, জুমার খুতবায় আবুল হাসান আশআরিকে লানত করতে হবে, কারণ সে ছিল বিকৃত আকিদার প্রচারক। কয়েকজন খতিব লানত করতে রাজি হলেন না। পদচ্যুত করা হলো তাদের। উজিরের নিযুক্ত গোয়েন্দারা শহরের প্রতিটি মসজিদে অবস্থান নিলো, যারা খুতবায় নিন্দা করতে গড়িমসি করলেন কিংবা ভিন্ন কথা বললেন, তাদের তালিকা পাঠানো হলো উজিরের কাছে।
সবচেয়ে কোণঠাসা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন ইবনুল মুয়াফফাক। দরস দিতে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি, পথ থেকেই ফিরিয়ে দেয়া হলো তাকে। ছাত্ররা অনুরোধ করেও উজিরের কর্মকর্তাদের মন গলাতে পারেনি। ঘোষণা দেয়া হলো, ইবনুল মুয়াফফাক এখন থেকে কোনো দরস বয়া বয়ানে অংশ নিতে পারবেন না। ইবনুল মুয়াফফাকের দরস বন্ধ করে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন কুন্দুরি। বন্ধ হলো অন্যান্য আশআরি আলেমদের দরসও। তাদের জায়গায় নিয়োগ দেয়া হলো মুতাযিলা চিন্তার অনুসারীদের। ইমাম আশআরিকে লানত না করায় চাবুকপেটা করা হলো একজন আলেমকে।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিশাপুরের সকল মসজিদে বাস্তবায়িত হলো উজিরের আদেশ। মধ্যবয়সী খতিবরা কঠোর গলায় নিন্দা করলেন আবুল হাসান আশআরির। তাকে পরিচয় করানো হলো বিদআতি বলে। বলা হলো, তিনি ইবনে কুল্লাবের অনুসারী, যে ইবনে কুল্লাবের কাজ ছিল তলে তলে খ্রিস্টবাদ প্রচার করা। শেষে বলা হলো, আবুল হাসান আশআরির উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে লানত। মার্ভ যাওয়ার পথে নিশাপুর থেমেছিলেন একজন আব্বাসি আমির। মসজিদের খুতবা শুনে এই শহরে অবস্থান করতে রাজি হলেন না তিনি। দ্রুত শহর ছেড়ে রওনা হলেন।
৪
নতুন এই সমস্যার জন্য আলেমরা প্রস্তুত ছিলেন না। তুগ্রিল বেগের মত আহলুস সুন্নাহর অনুসারী একজন শাসকের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল তাদের ধারনার বাইরে। তারা বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি দ্রুত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং উজির কুন্দুরির কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। আলেমদের একাংশ সিদ্ধান্ত নেন সুলতানের সাথে দেখা করে নিজেদের আকিদা বিশ্বাস স্পষ্ট করবেন এবং তাকে অনুরোধ করবেন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে। তরুণ আলেমরা ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিলেন।
আলেমদের একটি অংশ সুলতানের সাথে দেখা করতে গেলেন তাবরিযে, কিন্তু উজির কুন্দুরি আগেই জেনে গেলেন তাদের পরিকল্পনা। দ্রুত নিজের কজন বার্তাবাহক পাঠালেন সুলতানের কাছে। সুলতানকে বলা হলো তিনি যেন এই বিদআতি আলেমদের সাথে সাক্ষাৎ না করেন। কুন্দুরির উপর আস্থা আছে সুলতানের ফলে বাড়তি ঝামেলায় যেতে চাইলেন না তিনি। আলেমদের ফিরিয়ে দেয়া হলো, প্রাসাদের ফটক থেকেই। বলা হলো, সুলতান ব্যস্ত আছেন, এখন তিনি কারো সাথে দেখা করবেন না। আলেমরা কয়েকবার অনুরোধ করেও কাজ হলো না, কঠোর চেহারার সেলজুক প্রহরী সাফ জানালো, তারা এখান থেকে না সরলে বন্দি করা হবে। হতাশ আলেমরা নিশাপুরের পথ ধরলেন। যে আশা নিয়ে তারা এসেছিলেন তা মিইয়ে গেছে আগেই, আপাতত কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। আলেমদের বিদায় জানিয়েই ক্ষান্ত হলেন না সুলতান, জারি করলেন নতুন নির্দেশনা। একজন অশ্বারোহীর হাতে তুলে দিলেন উজির কুন্দুরির জন্য একটি পত্র। আলেমরা নিশাপুর এসে পৌঁছার আগেই সুলতানের দূত পৌঁছে গেল কুন্দুরির কাছে। অবাক বিস্ময়ে কুন্দুরি লক্ষ্য করলেন, সুলতান নির্দেশ দিয়েছেন বিদআতি আশআরি আলেমদের মধ্যে যারা গণ্যমান্য তাদেরকে যেন গ্রেফতার করা হয়।
বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে কুন্দুরি নির্দেশ দিলেন আবুল কাসেম কুশাইরি, জুয়াইনি, রইস আল ফুরাতি প্রমুখকে গ্রেফতার করতে। নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো তাদের শহরত্যাগেও। দুপুরে আহারের পর নিজের গৃহে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আবুল কাসেম কুশাইরি। একদল নিম্মশ্রেনীর লোক এসে হৈ চৈ শুরু করলো তার গৃহের সামনে। কী হচ্ছে জানার জন্য ঘর থেকে বের হতেই কয়েকজন এসে টেনে হিঁচড়ে ধরলো তাকে। ‘উজির আপনাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন’ বলেই একজন সজোরে ধাক্কা দিল কুশাইরিকে। সত্তরের কোঠায় পা দেয়া কুশাইরি ছিটকে কিছুটা দুরে সরে গেলেন, বুঝতে পারছেন আপাতত কোনো দয়া পাওয়ার আশা নেই। তাকে বন্দি করে আনা হলো জামে মসজিদের পাশে অবস্থিত কারাগারে। রইস আল ফুরাতিকে উঠিয়ে আনা হলো দরস থেকে। ছাত্ররা বাধা দিতে গিয়ে প্রহরীদের মারধোরের শিকার হলো। তাদের চোখের সামনে ধাক্কাতে ধাক্কাতে রইস আল ফুরাতিকে নেয়া হলো কারাগারের দিকে।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেন জুয়াইনি। নিজের এক বন্ধুর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তিনি, জানতে পারলেন তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারই হয়েছে। দ্রুত সরে পড়লেন তিনি এবং সে রাতেই শহর ত্যাগ করে রওনা হলেন বাগদাদের উদ্দেশ্যে। পরবর্তী কয়েকদিন চলল গনগ্রেফতার। আশআরি আলেমদের বড় অংশকে পাঠানো হলো কারাগারে। তবে অন্যদের গ্রেফতার করলেও ইবনুল মুওয়াফফাককে গ্রেফতার করা থেকে বিরত রইলেন কুন্দুরি। ইবনুল মুয়াফফাকের প্রভাব সম্পর্কে ধারনা ছিল তার, ফলে অযথা পরিবেশ ঘোলা করতে চাচ্ছিলেন না তিনি।
ইবনুল মুয়াওফফাক পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যথিত ছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ছাত্রদের বড় অংশ বন্দি আছেন কারাগারে। তিনি নিজেও কোনো প্রকার দরস তাদরিসে অংশ নিতে পারছেন না। তার চোখের সামনে মসজিদের মিম্বরে লানত করা হচ্ছে আবুল হাসান আশআরিকে। ইবনুল মুয়াফফাকের অনুসারীদের একাংশ ছিল যুদ্ধবাজ লোকজন। অস্ত্র চালনায় এদের বেশ পারদর্শিতা ছিল। ইতিপূর্বে তাদের কেউ কেউ তুগ্রিল বেগের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেয়। তারা ইবনুল মুয়াফফাকের সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করতে থাকে। ইবনুল মুয়াফফাককে তারা বলে, এভাবে চুপ থাকলে পরিস্থিতি খারাপই হবে। আপনি আমাদের নির্দেশ দেন আমরা কুশাইরি ও অন্য আলেমদের মুক্ত করে আনি। ইবনুল মুয়াফফাক বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন। শুরুতে তিনি এই পরিকল্পনায় আগ্রহী না হলেও এক সময় বুঝতে পারেন আসলেই এ ছাড়া উপায় নেই। সম্মতি দেন তিনি।
এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে ইবনুল মুয়াফফাকের অনুসারীরা কারাগার অবরোধ করে। তাদের হাতে বর্শা ও দামেস্কের ইস্পাতের তৈরি তরবারি। কারাপ্রহরী তাদের সাথে সমঝোতা ও আলোচনার চেষ্টা চালান, কিন্তু তারা আলেমদের মুক্তির দাবিতে অনড় থাকে। সময় যত গড়াচ্ছিল উত্তেজনা বাড়ছিল। কয়েকজন প্রহরীকে মারধোরের ঘটনাও ঘটে। দ্রুত কুন্দুরিকে জানানো হয় পরিস্থিতি। তিনি ভেবে দেখলেন ইবনুল মুয়াফফাকের অনুসারীদের দাবি মেনে নেয়াই ভালো, অন্যথায় তারা উজিরকে ক্ষমতা থেকে হটানোর আন্দোলন শুরু করতে পারে। আলেমদের মুক্তির নির্দেশ দিলেন তিনি। কুশাইরি ও রইস আল ফুরাতিকে ঘোড়ায় বসিয়ে উল্লাস করতে করতে তাদের গৃহে পৌঁছে দেয়া হলো। মুক্তি পেলেন অন্য আলেমরাও। প্রায় মাসখানেক সময় তারা কারাগারে অবস্থান করেছিলেন।
–
আলেমরা মুক্তি পেলেও অন্যান্য নির্দেশনা আগের মতই বহাল রইলো। বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না আলেমরা। তাদের বড় অংশ সিদ্ধান্ত নেন তারা ইরাক বা হিজাজে চলে যাবেন। আবু বকর বাইহাকি দুজন অনুসারী নিয়ে হিজাজের দিকে চলে যান। কুশাইরি নিশাপুর ত্যাগ করে চলে যান বাগদাদে। কাজিদের অনেকে হিজরত করেন।
তবে ইমাম কুশাইরি নিশাপুর ত্য্যাগ করলেও সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করছিলেন। আলেমদের নিশাপুরত্যাগ তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলছিল। এভাবে কোনো শহর আলেমশূণ্য হয়ে যাওয়া মানা যায় না। তিনি নিজে যে কোনো মূল্যে নিশাপুর ফিরতে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কেও তার ধারনা ছিল। তিনি জানতেন পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সেখানে ফেরা বৃথা। কুশাইরি বুঝতে পেরেছিলেন নিজের সীমিত সামর্থ্যে তিনি পরিস্থিতি উন্নতি ঘটাতে পারবেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য স্থানে অবস্থানরত আলেমদেরকে নিশাপুরের পরিস্থিতি জানাবেন। ৪৪৬ হিজরিতে বাগদাদে অবস্থানকালেই তিনি মুসলিম বিশ্বের আলেমদের উদ্দেশ্যে একটি পত্র লেখেন যার একাধিক কপি প্রস্তুত করে বিভিন্ন শহরে পাঠানো হয়।
পত্রের শুরুতে তিনি নিশাপুরের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং গত এক বছরে সেখানকার আলেমরা কী কী প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন তা আলোচনা করেন। এরপর তিনি ইমাম আবুল হাসান আশআরি ও তার অনুসারীদের প্রশংসা করেন। তাদের নামে যেসব অপবাদ চালু আছে তার অসারতা তুলে ধরেন। বিদআত অপসারণ ও সুন্নাহর পুনর্জীবনে ইমাম আশআরির অবদান আলোচনা করেন। তাকে অভিহিত করেন, ইমামুদ্দিন, সিরাজু যাবিল ইয়াকিন, মুহিউস সুন্নাহ, কামিউল বিদআহ, নাসিরুল হক, নাসিহুল খালক, আয যাকিউর রাজি উপাধিতে। কুশাইরি তার পত্রে লেখেন, আশআরিদের চিন্তাধারা মুতাযিলা ও বিদআতিদের চিন্তধারার মত প্রান্তিক নয়, বরং ভারসাম্যপূর্ন। আল্লাহর কালাম ও সিফাত প্রসঙ্গে আশআরিদের চিন্তাধারাও তুলে ধরেন তিনি। পত্রের শেষদিকে তিনি সুলতান ও উজিরকে সতর্ক করে লেখেন, যে ব্যক্তি ইমাম আবুল হাসান আশআরিকে নিন্দা ও লানত করে সে মূলত সকুল আহলুস সুন্নাহর উপরই আক্রমণ করছে।
ইমাম কুশাইরির পত্র পৌঁছে গেল মুসলিম বিশ্বের নানা শহরে। পৌঁছে গেল বাইহাকেও। সেখানে অবস্থান করছিলেন ইমাম বাইহাকি। সে সময় তিনি আস সুনানুল কাবির সংকলনে ব্যস্ত। কুশাইরির পত্র পাঠে তিনি জানলেন নিশাপুরের আশআরি আলেমদের দূরাবস্থা। তিনি দ্রুত উজির কুন্দুরির কাছে একটি চিঠি লিখলেন। পত্রের শুরুতে তিনি উজিরকে মনে করিয়ে দেন, রাজত্ব আল্লাহর, আল্লাহ যাকে চান তা দান করেন। এরপর তিনি উজিরের প্রশাসনিক গুণাবলীর প্রশংসা করেন। খোরাসানের বিশৃঙ্খলা দমনে উজিরের অবদান স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এতদিনে খোরাসানে ভীতির পরিবর্তে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে এসেছে। এরপর তিনি লেখেন, সম্ভবত উজিরের কাছে আশআরি মাজহাব সম্পর্কে ভুল তথ্য পৌঁছেছে। তারা হলুস সুন্নাহরই অন্তর্ভুক্ত। তাদের মাজহাব মুতাযিলাদের মত তাতিল করাও নয়, আবার মুজাসসিমাদের মত তাশবিহ দেয়াও নয়। উজিরের উচিত বিষয়টি অনুধাবন করা। তার উচিত যারা ইমাম আবুল হাসান আশআরির নামে মিথ্যাচার করেছে তাদের আটক করা। এরপর তিনি আবুল হাসান আশআরির প্রশংসা করেন। ইমাম বাইহাকি লেখেন, আশআরি বংশের সুনাম ও খ্যাতি নবিজির যুগ থেকেই পরিচিত বিষয়। আবু মুসা আশআরি রা ছিলেন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবি। তারই বংশধর ইমাম আবুল হাসান আশআরি। তিনি নিজে কোনো মতবাদ চালু করেননি বরং সাহাবি ও তাবেইদের বক্তব্যগুলোকেই নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন মাত্র। তিনি তাদের কথাকে ব্যাখ্যা এবং স্পষ্ট করেছেন। তিনি ছিলেন তার সময়ের মুজাদ্দিদ। এরপর ইমাম বাইহাকি আশআরি ধারার বেশকিছু মাসআলার ব্যাখ্যা দেন।
পত্রের শেষদিকে ইমাম বাইহাকি বলেন, তিনি আশা করছেন উজির কুন্দুরি পরিস্থিতি নিরসনে পদক্ষেপ নিবেন। তিনি আশআরি আলেমদের মহাত্ম ও মর্যাদা বুঝতে পারবেন এবং তাদেরকে যথাস্থানে আসিন করবেন।
–
ইমাম কুশাইরির পত্রের প্রভাব পড়েছিল নানা শহরে। বিভিন্ন মাজহাবের আলেমরা আশআরি আকিদার পক্ষে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেন। দামগান শহরের কাজি আবু আবদুল্লাহ দামগানিকে প্রশ্ন করা হয়, অনেকে আশআরিদের উপর লানতের নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে জনগণের কর্তব্য কী? তিনি জবাব দেন, এটি নিকৃষ্ট এক বিদআত এবং তা অনুসরণের সুযোগ নেই। বাগদাদের প্রভাবশালী আলেম শায়খ আবু ইসহাক সিরাজি তার এক পত্রে লিখেন, আশআরিরা আহলুস সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। তারা শরিয়তের সাহায্যকারী। যে ব্যক্তি তাদের নিন্দা করে সে মূলত আহলুস সুন্নাহরই নিন্দা করে। আশআরিদের পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করেন মুহাম্মদ বিন আহমাদ আশ শাশির মত প্রতিভাবান তরুণ আলেমও।
ইমাম কুশাইরির পত্র রচনার ৪ বছর পর জন্ম নেয়া প্রভাবশালী মালেকি আলেম ইবনে রুশদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল জুয়াইনি, ইবনুল ফুরাক, আবুল ওয়ালিদ বাজি, আবু বকর বাকিল্লানির চিন্তাধারা সম্পর্কে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ইনারা সবাই হিদায়াত ও কল্যাণের ইমাম। তাদের অনুসরণ করা আবশ্যক, কারণ তারা শরিয়তের সাহায্যে অবদান রেখেছেন। ভ্রান্ত মতালম্বিদের সংশয় ও বিভ্রান্তি দূর করেছেন। তাদের নিন্দা করার সুযোগ নেই। শুধুমাত্র ফাসেক ব্যক্তিরাই তাদের সম্পর্কে নানা ভুল কথা ছড়ায়।
তবে আলেমদের শক্ত মতামত ও পর্যালোচনা সত্ত্বেও উজির কুন্দুরি নিজের অবস্থানে অনড় রইলেন। মূলত আশআরি দমনের আড়ালে তিনি নিজের সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করছিলেন। এই পরিস্থিতিতে ৪৫৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন সুলতান তুগ্রিল বেগ। ক্ষমতায় আসেন সুলতান আলপ আরসালান। তিনি উজির নিয়োগ দেন নিজামুল মুলককে। নিজামুল শুরু থেকেই আলেমদের সাথে সুসম্পর্ক গয়রতে আগ্রহী ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন দ্বীন পালনে একনিষ্ট। ইলম এবং আলেমদের অত্যন্ত সম্মান করতেন। দায়িত্ব লাভের পূর্বেই তিনি আশআরি আলেমদের উপর চলমান মিহনাহ সম্পর্কে জেনেছিলেন। তিনি তখনই এর প্রতিকার নিয়ে ভেবেছিলেন কিন্তু ক্ষমতা না থাকায় কিছু করতে পারেননি। দায়িত্ব পেয়েই তিনি একের পর এক নির্দেশনা জারি করেন। তিনি আলেমদের নির্দেশ দেন নিশাপুর ফিরে যেতে। উজির আশ্বাস দেন সেখানে কেউ তাদের উপর কোনো জবরদস্তি করবে না। খতিবদের নির্দেশ দেয়া হয় ইমাম আশআরিকে লানত করা বন্ধ করতে। তিনি নতুন বেশকিছু মসজিদ ও মাদরাসা নির্মান করেন যেখানে আলেমরা নতুন উদ্যমে দরস তাদরিস শুরু করেন। নিশাপুরের বিখ্যাত জামিয়া নিজামিয়া নিশাপুরও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে যেখানে শিক্ষকতা করেন আবুল মাআলি জুয়াইনি। মূলত নিজামুল মুলক চাচ্ছিলেন আলেমরা যেন নতুন উদ্যমে আশআরি আকিদা জনগণের সামনে তুলে ধরেন।
এভাবেই সমাপ্ত হয় দশ বছর ধরে চলা মিহনাহ। আলেমদের জন্য এই সময়টা সহজ ছিল না। তাদের অনেকে কারাবন্দী হয়েছিলেন, অনেকে নিজের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন, অনেকে দেশান্তরি হয়েছিলেন। তবে তাদের কেউ নিজের মত বদলে রাফেজি বা মুতাযিলা হননি, সব অবস্থানে নিজের মতে শক্ত ছিলেন, নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন।
৫
দশ বছর পর নিজের এলাকায় ফিরে যাচ্ছেন তিনি। মনে একইসাথে আবেগ ও দায়িত্বের ভার অনুভব করছেন ইমাম জুয়াইনি। মাঝের সময়টা তিনি কাটিয়েছেন নানা এলাকায়। চার বছর অবস্থান করেছেন মক্কায়। সেখানে দিয়েছেন ফিকহের দরস। প্রসিদ্ধি পেয়েছেন ইমামুল হারামাইন নামে। পরিস্থিতি আগের মত থাকলে তিনি হয়তো মক্কাতেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু সম্প্রতি নিশাপুর থেকে নিজামুল মুলকের চিঠি এসেছে তার কাছে। নিজামুল মূলক জানিয়েছেন উজির কুন্দুরির পতন হয়েছে। আশআরি আলেমদের উপর থেকে তুলে নেয়া হয়েছে পূর্বের সকল নিষেধাজ্ঞা। নিশাপুরের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মাদরাসা নিজামিয়া। যেখানে পড়ানো হবে শাফেয়ী ফিকহ। নিজামুল মুলকের ইচ্ছা ইমাম জুয়াইনি যেন নিশাপুর এসে এই মাদরাসার দায়িত্ব হাতে নেন। নিজামুল মুলকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিশাপুর যাচ্ছেন তিনি।
দূরে নিশাপুরের প্রাচীর দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন পর নিজের ঘরে ফেরার অনুভূতি হচ্ছে ইমাম জুয়াইনির।