আমাদের ইতিহাসের হারানো পাতা

মূল : শায়খ হাবিবুর রহমান আজমী রহ.
রুপান্তর : ইমরান রাইহান

১।

সুলতান শামসুদ্দিন আলতামাশ ৬০৭ হিজরী থেকে ৬৩৩ হিজরী পর্যন্ত ভারতবর্ষ শাসন করেন। খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকীর মালফুজাত ‘ফাওয়ায়েদুস সালেকিনে’ তার প্রশংসা করা হয়েছে।ফা ওয়ায়েদুস সালেকিনের ভাষ্যমতে, তিনি সআধারণত রাতে ঘুমাতেন না। কখনো ঘুম এলে একটু পরেই সজাগ হয়ে যেতেন। উঠে অযু করে নামাজ পড়তেন। চাকর-বাকর কাউকে ডাকতেন না। বলতেন, যারা আরামের ঘুমে আছে তাদের কষ্ট দেয়ার কী দরকার? কখনো কখনো রাতের বেলা আশরাফী ভর্তি থলে নিয়ে রাজধানীর অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতেন। গরীব দুস্থদের ঘরে গিয়ে তাদের খোজখবর নিতেন। বলতেন, কারো কোনো সাহায্য প্রয়োজন হলে কিংবা কেউ জুলুমের শিকার হলে, প্রাসাদের সাথে সংযুক্ত শিকল ধরে টান দিয়ো। আমি তোমাদের খবর নিবো। (ফাওয়ায়েদুস সালেকিন, ২৯)

২।
খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি ইন্তেকাল করেন ৬৩৩ হিজরীতে। মৃত্যুর পুর্বে তিনি অসিয়ত করে যান, আমার জানাজা এমন কেউ পড়াবে যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে।
ক। সে কখনো কোন গায়রে মাহরামের দিকে দৃষ্টিপাত করেনি
খ। কখনো তার আসরের সুন্নত কাজা হয় নি।
গ। সে সবসময় তাকবিরে উলার সাথে জামাতে নামাজ পড়েছে।
শায়খের জানাজা প্রস্তুত করা হলো। ঘোষনা করা হলো শায়খের শেষ অসিয়ত। কেউ এগিয়ে আসলো না। অনেকক্ষণ পর সুলতান শামসুদ্দিন আলতামাশ সামনে এগিয়ে এলেন।মৃদুস্বরে বললেন, শায়খ আপনি আমার গোপন আমল ফাস করে দিলেন। (খাজিনাতুল আসফিয়া , ২৭৫)

৩।
সুলতান আলতামাশের ছেলে নাসিরুদ্দিন মাহমুদও পিতার মত আবেদ, যাহেদ ছিলেন। তিনি ৬৪৪ হিজরীতে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তার ঘরের কাজের জন্য কোন চাকরবাকর রাখেন নি। একদিন তার স্ত্রী অভিযোগ করলেন, রুটি সেকতে সেকতে আমার হাত পোড়া গেছে, একজন দাসীর ব্যবস্থা করুন। নাসিরুদ্দিন মাহমুদ বললেন, দুনিয়া কষ্টের জায়গা। একটু ধৈর্য ধরো। ইনশাআল্লাহ, আখেরাতে এর প্রতিদান পাবে। (বাদায়ুনি, ৯০)

৪।
গিয়াসুদ্দিন বলবনের পর দিল্লীর সিংহাসনে বসেন জালালউদ্দিন ফিরোজ শাহ। তিনি প্রথমে দু রাকাত নামাজ পড়েন। তারপর আহমাদ হাবিব নামে এক উজিরকে নিয়ে গিয়াসুদ্দিন বলবনের প্রাসাদে যান। আহমাদ হাবিব বললো, সুলতান। আপনি এখন থেকে এখানেই থাকবেন।জালালউদ্দিন ফিরোজ শাহ জবাব দিলেন, গিয়াসুদ্দিন বলবন সুলতান হ ওয়ার পূর্বে এই প্রাসাদ নির্মান করেন, তাই এখানে আমার কোনো অধিকার নেই। তার পরিবারের লোকদের এর মালিকানা বুঝিয়ে দাও।

৫।
সুলতান বাহলুল লোধি ৮৫৫ হিজরীতে শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। রাজত্বকালে তিনি সবসময় জামাতে নামাজ পড়তেন। প্রজাদের অভিযোগ নিজেই খতিয়ে দেখতেন। ন্যায়বিচার করতেন। কখনো সিংহাসনে বসতেন না। আমীরদেরকেও তার সামনে দাড়াতে দিতেন না। সেনাপতি কিংবা উযিরদের কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যেতেন। যুদ্ধের ময়দানে দু রাকাত নামাজ পড়ে আক্রমন শুরু করতেন। সিংহাসনে আরোহনের পর প্রথম যেদিন তিনি জামে মসজিদে যান, সেদিনের খুতবায় খতীব সাহেব আফগানদের নিন্দা করছিলেন। সুলতান নিজ জাতীর নিন্দা শুনেও নীরব ছিলেন। নামাজ শেষে খতীবকে বললেন, ভাই, এরাও তো আল্লাহর বান্দা। এতটা না বললেও হতো। (তারীখে দাউদি, ১১)

৬।
আহমেদ নগরের শাসনকর্তা আহমদ নিজামুদ্দিন শাহ ছিলেন অত্যন্ত নেককার, পরহেযগার প্রকৃতির মানুষ। রাস্তায় চলাচলের সময় তিনি দৃষ্টি নিচের দিকে রাখতেন। এক আমীর এর কারন জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দিলেন, আমি পথে বের হলে নারী পুরুষ সবাই রাস্তার পাশে চলে আসে। আমি চাই না আমার দৃষ্টি কোন গায়রে মাহরামের উপর পড়ুক। (তারীখে ফেরেশতা, ২য় খন্ড, ১০০ পৃষ্ঠা)

৭।
সিকান্দর লোদির শাসনকাল। সাম্ভল নামক এলাকার জনৈক ব্যক্তি মাটি খুড়তে গিয়ে পনেরো হাজার আশরাফী ভর্তি একটি থলে পেল। সাম্ভলের শাসনকর্তা মিয়া কাসেম ঐ ব্যক্তির কাছ থেকে থলে নিয়ে সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং এই আশরাফীগুলো কী করা হবে তা জানতে চাইলেন। সুলতান মিয়া কাসেমকে পত্র পাঠিয়ে বললেন, আশরাফী যে পেয়েছে তাকেই দিয়ে দাও। মিয়া কাসেম আবার পত্র পাঠালো, সুলতান, এই ব্যক্তি এত বড় পরিমানের অর্থ পাওয়ার যোগ্য নয়। সুলতান জবাব দিলেন, যিনি তাকে দিয়েছেন তিনিই ভালো জানেন সে যোগ্য কিনা। তাই তাকেই ফিরিয়ে দাও। (তারিখে দাউদি, ৪২)

৮।
সুলতান মাহমুদ বিগ্রা। ৮৬২ হিজরী থেকে ৯১৭ হিজরী পর্যন্ত তিনি গুজরাট শাসন করেন। জীবনের শেষদিকে তিনি খুব কান্না করতেন। একজন আমীর তাকে কান্নার কারন জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দিলেন, প্রতি মূহূর্তে জীবনের মূল্যবান সময় অতিবাহিত হচ্ছে। যে সময় চলে যাচ্ছে তা আর ফিরে আসবে না। জানি না, আমার পরিনতি কী হবে। যদি আমার পরিনতি মাহমুদ (প্রশংসিত) না হয় এই ভয়ে আমি কান্না করি। (মিরআতে সিকান্দরী, ৭৯)

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন