ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির এই সময়ে দ্বীনে এলাহির নতুন রুপ

শুক্রবারে সাধারণত কাজকর্ম অফ রাখি। কিছুটা হালকা সময় কাটাতে চেষ্টা করি। আজ বিকালে একটা টকশো দেখছিলাম। টকশো অনুষ্ঠানটি গত সপ্তাহে প্রচারিত হয়েছে। টকশোতে তিন ধর্মের তিনজন আলোচক ছিলেন। টকশোর মূল প্রতিপাদ্য ছিল কীভাবে ধর্মীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি গড়ে তোলা যায়। হিন্দু ধর্মের একজন কোরআনুল কারিমের সুরা কাফেরার (!?) দলিল দিলেন, তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমাদের ধর্ম আমাদের। এরপর তিনি প্রস্তাব দিলেন অন্য ধর্মের মৌলিক কথা ও ইতিবাচক শিক্ষা যেন মসজিদের মিম্বরেও প্রচার করা হয়, কাউকে যেন আঘাত করা না হয়, একইসাথে স্কুলে বাচ্চাদের যেন শুরুতে সব ধর্ম একসাথে পড়ানো হয়, এসব ধর্মের শিক্ষা তাদের মনে গেঁথে দেয়া হয়। সব ধর্মের যেন একটা সমন্বয় করা হয়। উপস্থাপিকা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মুসলিম শায়খের কাছে। জানতে চাইলেন এই প্রস্তাব সম্পর্কে তার মতামত কী? শায়খ মুচকি হেসে বললেন, অবশ্যই, শুধু মসজিদে কেন, বিভিন্ন মাহফিলে ও সভাতেও বলা দরকার। একটু পরে শায়খ আবার বললেন, জাতীর মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে, সেখানে ধর্মীয় শিক্ষার অবস্থান কী তা দেখতে হবে। এরপর তিনি হিন্দু ভদ্রলোকের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন, এটা খুব ইম্পরট্যান্ট আপনি যেটা বলেছেন। আমার মনে হয় এটাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত (অর্থাৎ বাচ্চাদেরকে সকল ধর্ম পড়ানোর বিষয়টা গুরুত্ব দেয়া উচিত। বাচ্চারা যেন ছোটবেলাতেই ঈমানের পাশাপাশি কুফরের শিক্ষা পায়, কুফরের প্রতি ঘৃণা তৈরী না হয়, শায়খ এদিকে গুরুত্ব দিতে বলছেন)।

একজন কল দিয়ে প্রশ্ন করলো, আমরা জানি সত্য তো একটা। তাহলে এত ধর্ম কেন? হয়তো একটা ধর্ম সত্য হবে কিংবা সব মিথ্যা। ‘মুচকি হাসা’ শায়খ যিনি অন্যত্র খুব সাহস দেখিয়ে ‘সে কি আছে নাকি’ বলে মৃত একজন আলেমকে তাচ্ছিল্য করার সাহস দেখান, তিনি এখানে ঈমানী সাহস দেখাতে ব্যর্থ হলেন। তিনি দৃঢ়কন্ঠে বলতে পারলেন না, নিশ্চয় আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ধর্ম একমাত্র ইসলাম’ (সূরা আলে-ইমরান-১৯)।
তিনি কী করলেন? তিনি বললেন, আমার মনে হয় এভাবে না দেখে আমাদের ভাবা উচিত সবাই এক মত অনুসরণ করবে না। ফলে বিভক্তি থাকবে, একে বিবেদে রুপ দেয়া যাবে না। ভিন্নমতকেও আমাদের শ্রদ্ধা করতে হবে, এর বিরোধিতাকে না বলতে হবে।

আহ, এই কথা শোনার চেয়ে মরণও তো ভালো আমাদের জন্য। শায়খ এখানে যে ভিন্ন মতের কথা বললেন, সেই ভিন্নমত আসলে কী? সেই ভিন্নমত হলো কুফর, সেই ভিন্নমত হলো ইরতিদাদ, সেই ভিন্নমত হলো ইলহাদ। শায়খ কুফরকে শ্রদ্ধা করতে বললেন। কুফরের বিরোধিতা করতে নিষেধ করলেন।

এসব বক্তব্যের ফিকহী দৃষ্টিকোণ কী হবে সে আলাপ না করেও বিষয়টা যে কত ভয়ানক তা খালি চোখেই দেখা যায়।
টকশো শেষ হলো। মোটামুটি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। এসব কী শুনলাম। বারবার মাথায় ঘুরলো মানাজির আহসান গিলানি রহিমাহুল্লাহর সেই বিখ্যাত কথা, যা আজ থেকে ৭৫ বছর আগে তিনি লিখেছিলেন, ‘মতবাদগুলো নতুন কিছু নিয়ে আসে না, এগুলো আসে পুরনো কোনো বাতিল মতবাদের অংশবিশেষ নিয়ে, নতুন রুপে, নতুন উপস্থাপনে’।
আমার মনে হলো শায়খ যা বলেছেন এ নতুন কিছু নয়। তিনি আকবরের দ্বীনে এলাহির নতুন একটা ভার্সন বললেন মাত্র। তিনি যা বলেছেন যে পরামর্শ দিয়েছেন এগুলোতো আকবরের আমলের বস্তাপচ্চা রদ্দিমাল। শায়খ বললেন, মসজিদের মিম্বরে ও অন্যান্য মাহফিলে অন্য ধর্মের বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে, পরিচিত করাতে হবে।

নবী মুহাম্মদের (সা) মিম্বরে দাঁড়িয়ে কুফরের পরিচয় করাতে বললেন শায়খ। অনেকে বলবেন শায়খ এখানে ধর্মগুলোর পর্যালোচনা করতে বলেছেন, যেন এসব ধর্ম জেনে এসব ধর্মের বিরোধিতা করা সহজ হয়। এক্ষেত্রে বলবো আগের আলোচকের কথা লক্ষ্য করুন। তিনি বললেন, মিম্বর থেকে যেন অন্য ধর্মগুলো শেখানো হয় জানানো হয় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। এরপরের প্রশ্নের জবাবে শায়খ বললেন, হ্যা এটা করা দরকার। শুধু মসজিদে কেন, অন্য সভাতেও করা দরকার। আবার একটু পরেই শায়খ বলে দিলেন, কেউ যেন ভিন্নমতের বিরোধিতা না করে।

তাহলে খোলাসা দাড়ালো কী? শায়খ মিম্বরে অন্য ধর্মের মার্কেটিং করার অনুমতিই দিচ্ছেন, বিরোধিতার নয়। এমন শায়খের শায়খ মোল্লা মোবারক নাগোরির পরামর্শে আকবর চার শতাব্দি আগেই এগুলো চালু করেছিল। সর্বধর্ম স্বমন্বয়ের কথা বলে ঈমান ও কুফরের সীমারেখা তুলে দিয়েছিল। মসজিদের মিম্বরেও তখন হিন্দুধর্মের অর্চনা করা হয়েছিল। আমার কথা নয়, মুঘল ঐতিহাসিক মোল্লা আবদুল কাদের বাদায়ুনির লেখা পড়ে দেখুন, তিনি স্পষ্ট লিখেছেন, মুসলমানদের যে মিম্বরে তাকবিরের ধ্বনি উচ্চারিত হত, সেখান থেকে হিন্দুদের বিভিন্ন শ্লোকের শব্দ শোনা গেল। (মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ, ২/২২৩)

সর্বধর্ম সমন্বয়ের এই চিন্তা আকবরের মাথাতে ছিল। নানা মতবাদের লোকজনের সাথে মিশে সে মনে করেছিল হক ছড়িয়ে আছে সব ধর্মেই। তাই সমন্বয় করতে হবে, সবার কাছ থেকে ভালোটা নিতে হবে। দেখুন, ঠিক একই চিন্তা শায়খও সমর্থন জানালেন। তিনিও বললেন শিক্ষাব্যবস্থা এমন করা ইম্পরট্যান্ট যেখানে শিশুদের শুরুতেই সব ধর্মের শিক্ষা দেয়া হবে। যারা মনে করেন শায়খদের এসব কথা ব্যক্তিগত মতামত মাত্র, তারা ভুল করেন। শায়খদের এসব চিন্তার পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস আছে। শায়খদের কাছে রয়েছে এসব চিন্তার সনদ। আফসোস একটাই তাদের এই চিন্তার সনদের শেষমাথা মদীনার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে না। তাদের চিন্তার সনদ শেষ হয় আবুল ফজলের ভায়া হয়ে মোল্লা মোবারক নাগোরির কাছে। আর তাদের এই সনদে সত্যায়নের স্বাক্ষরটি দিয়ে রেখেছে স্বয়ং মুরতাদ আকবর।
মনে হবে, শায়খ তো ভালোই বলেছেন। সব ধর্ম সম্পর্কে জানা থাকা দরকার। ভাইয়েরা আমার, শায়খের কথার উপর ফিকহকে প্রাধান্য দিন। আলেমদের কাছ থেকে জেনে নিন, সব ব্যক্তির জন্য সব স্তরে থেকে ভিন্ন ধর্ম জানা ও এর চর্চা করার সুযোগ আছে কিনা। ইসলামি ফিকহ আপনাকে নির্দেশনা দিবে। এগুলো মুফতি সাহেবদের থেকে জেনে নিবেন।
আমি ইতিহাসের পথিক, আমি ইতিহাসের গল্প শুনাই। আকবরও ঠিক এই কাজটি করেছিল। তার আদেশে হিন্দুদের ধর্মীয় পুস্তাকাদি ও সাহিত্য ফার্সিতে অনুবাদ করে ফেলা হয়। এসব পড়ার জন্য মুসলমানদের উৎসাহ দেয়া হয়। মুসলিম সমাজের মধ্যে বিপুল পরিমানে এসব বইপত্র পড়া হয়, চর্চা হয়। এর ফলাফল কী হয়েছিল? শুনুন বাদায়ুনীর মুখে যিনি স্বচক্ষে সেই যুগ দেখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, মুসলমান সমাজে এমন একটি শ্রেনী গড়ে উঠে যারা ছিল হিন্দু মেজাজের মুসলমান’। (মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ, ২/২৬৯)

অর্থাৎ তারা বাহ্যিকভাবে মুসলমান হলেও আকিদা বিশ্বাসে ছিল হিন্দুদের অনুসারী। শায়খরা আজ আমাদের যে পরামর্শ দিচ্ছেন তা মেনে নিলে উম্মাহ কোনপথে যাবে তা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিন।
আকবরের সর্বধর্ম সমন্বয় কিংবা কথিত উদারনীতি, যার ফলে ধর্মগুলোর পার্থক্যরেখা মুছে দেয়া হয়, ইসলামের আল ওয়ালা ওয়াল বারার আকিদা ধবংস করা হয়, এর কী ফলাফল হয়েছিল তা শুধু বাদায়ুনি নয়, মুজাদ্দিদে আলফেসানিও লিখেছেন। তার পত্রাবলী পড়ে দেখুন। সেই সময়ের কী করূন চিত্রই না তিনি এঁকেছেন। এক পত্রে তিনি লিখেছেন, কাফেররা আজ ইসলামের বিধান নিয়ে ঠাট্টা করছে, মুসলিম ভূখন্ডে কুফরি আইন জারি করছে এবং অলিগলি ও বাজারে এসবের প্রশংসা করে বেড়াচ্ছে। মুসলমানদের বাধা দেয়া হচ্ছে শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন করা থেকে, এমনকি কাফেরদের এসব আইনের বিরোধিতাও করতে দেয়া হচ্ছে না। (মাকতুবাতে ইমামে রব্বানি, ১ম খন্ড, পত্র নং-৬৫)

শায়খ বলেছেন ভিন্নমত অর্থাৎ কুফর ও ইরতিদাদকে শ্রদ্ধা করতে হবে।

দুঃখিত, উম্মাহর সন্তানদের পিঠে এখনো মোটামুটি একটা ঈমানী মেরুদন্ড টিকে আছে। উম্মাহর রক্তে এখনো স্রোত আছে, রুহে এখনো ঈমানী আবেগের উত্তাপ আছে। উম্মাহর সন্তানরা এখনো আকলের উপর ইলমে ওহিকে প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত, এর জন্য জানমাল কোরবান করতে প্রস্তুত। তারা আপনাদের এসব মতামত, এসব ইন্টারফেইথ, এসব তত্ত্বকথা, এসব কথিত উদারতা ও সম্প্রীতির বয়ান শুনতে রাজি না, তারা আপনাদের এসব তত্বকথা ছুঁড়ে ফেলে, ইসলামি ফিকহের কাছেই সমাধান খুঁজতে প্রস্তুত। ইলমে নববীর কাছে নিজেদের সঁপে দিতে প্রস্তুত। আপনাদের কাছে মিডিয়া আছে, এইচডি ফরম্যাটের ভিডিও আছে, ভিডিওর শুরুতে আপনাদের নামটাও ঘুরে ঘুরে আসে, কিন্তু উম্মাহর সন্তানরা এসবের পরোয়া করে না। তারা মদীনার সেই খেজুর পাতার কুটিরেই নিজেদের আশ্রয় খুঁজে পায়।

আপনারা উম্মাহর সন্তানদের নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলেন ‘সে কি এখন আছে?’। গুনে রাখুন, একদিন ইতিহাস কথা বলবে। সেদিন ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না। মুসলিম সমাজে যে বিষ ছড়াচ্ছেন আপনারা তার জন্য ইতিহাসের কাছে মাশুল দিতে হবে আপনাদের, যদি সময় থাকতে ফিরে না আসেন।

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন