সাহাবায়ে কেরাম কি বিজিত এলাকার মূর্তি অক্ষত রেখেছিলেন?

সদ্যপ্রয়াত হাল যামানার মিসরী আলিম শায়েখ মুহাম্মাদ ইমারাহ প্রতিকৃতির বিষয়ে বলেন, ’সাহাবায়ে কিরাম বিজিত দেশগুলোর উপাস্য নয়, এমন প্রতিকৃতিকে রেখে দিতেন। উমার (টাইপিং মিসটেক। আমর হবে) ইবনুল আস রা. মিসর জয় করেন। কিছু মূর্তি ভেঙ্গে কিছু রেখে দেন। কারণ, ওগুলো উপাস্য ছিল না। এবং মিসরের খ্রিস্টানরা এগুলোর উপাসনা করতো না। এটা মুসলিম সৈন্যবাহিনীর বিশ্বাসের জন্য হুমকি হওয়ার আশংকা ছিল না।’ (আল ইসলাম ওয়াল ফুনুনুল জামিলাহ) (১)

মুহাম্মদ ইমারাহর এই উদ্ধৃতিটি শরয়ী ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রথমে আমরা মূর্তির বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা দেখে আসি-

১। আবুল হাইয়াজ আল আসাদি বলেন, ‘‘একদিন আলি ইবনু আবি তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু আমাকে বললেন, আমি কি তোমাকে এমন একটা কাজে পাঠাব না, যে-কাজে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে পাঠিয়েছিলেন? তুমি কোনো প্রতিকৃতি পেলে তা ধ্বংস করে ফেলবে এবং কোনো উঁচু কবর দেখতে পেলে সমান করে দিবে”। (২)
২। আমর ইবনে আবাসা রাযিয়াল্লাহু আনহু একদিন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে কোন-কোন নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন’? নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে কয়েকটি নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন। ১. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা। ২. মূর্তি ভাঙা। ৩. এবং আল্লাহকে এক বলে স্বীকার করে নেওয়া, যার সাথে কোনোকিছু শরিক করা হবে না”। (৩)

এই হাদিস দুটিতে দুটি শব্দ এসেছে। তিমসাল ও আওসান। তিমসাল শব্দটির বেশ কয়েকটি অর্থ রয়েছে। ইবনু মানযুর রহিমাহুল্লাহ তিমসাল শব্দটির তিনটি অর্থ লিখেছেন।
ক. তিমসাল অর্থ —চিত্র, প্রতিকৃতি।
খ. ছায়া, প্রতিচ্ছবি।
গ. আল্লাহ তাআলার কোনোপ্রকার মাখলুকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করে বানানো কোনো বস্তু। (৪) শেষের অর্থটিকে এক কথায় মূর্তি ও ভাস্কর্য বলে প্রকাশ করা যেতে পারে। হাদিসে ‘তিমসাল’ ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে ‘তামাসা’ অর্থাৎ মুছে ফেলা। তামাসার আরেকটি অর্থ হলো—‘হাদামা’ বা ধ্বংস করা।

তাহলে প্রথম হাদিসটির সর্বনিম্ন যে অর্থ দাঁড়াচ্ছে তা হলো, খোদাইকৃত যেকোনো মূর্তি বা প্রতিকৃতি পেলে সেটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। এটা শব্দের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অর্থটি ধরে নিয়ে বলা। তিমসাল শব্দ যে স্পষ্ট মূর্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, সেই অর্থে ধরা হলে যেকোনো মূর্তি ধ্বংসের অর্থ হবে। উদ্দেশ্য যে মূলত দ্বিতীয়টি, তা পরবর্তী হাদিস দ্বারা স্পষ্ট হয়।
এবার দ্বিতীয় হাদিসটিতে ব্যবহৃত শব্দটি দেখা যাক। সেখানে ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে ‘আওসান’, শব্দটি বহুবচন। একবচনে ‘ওয়াসানুন’। ওয়াসানুনের প্রথম অর্থ হচ্ছে, সর্বদা কোথাও স্থির দাঁড়িয়ে থাকা বস্তু। এর দ্বিতীয় অর্থটি হলো, যেকোনো ধরনের মূর্তি। মূর্তির জন্য ব্যবহৃত আরবি আরেকটি শব্দ হলো সানামুন। ইবনুল আসির বলেছেন, ‘ওয়াসানুন এবং সানামুনের মাঝে পার্থক্য হলো, ওয়াসানুন মানে মাটি, কাঠ বা পাথর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি দেহবিশিষ্ট মূর্তি। আর সানামুন হলো শুধু প্রতিকৃতি”। (৫) দ্বিতীয়ত, এখানে মূর্তি ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত শব্দ হলো, কাসারা অর্থাৎ ভেঙে ফেলা।
তাহলে এই হাদিসে স্পষ্টভাবেই দেহবিশিষ্ট মূর্তি ও ভাস্কর্য ভাঙার নববি নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে। কুরআনে সানামুন শব্দ দিয়ে মূর্তির নিষেধাজ্ঞার কথা আছে। সুতরাং আয়াত ও হাদিসের ভাষাগত সমন্বয়ে যে বিষয়টি স্পষ্ট হলো তা হচ্ছে, শুধু ছবি বা প্রতিকৃতি, দেয়ালে বা পাথরে খোদাই করে বানানো মূর্তি এবং স্বতন্ত্র দেহবিশিষ্ট মূর্তি ও ভাস্কর্য, সবগুলোই স্পষ্ট নসের মাধ্যমে নিষিদ্ধ প্রমাণিত। হাদিসের ঘটনা দ্বারা সেগুলো ভাঙার জন্য নবিজির নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে।

৩। মক্কা বিজয়ের দিন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উযযা মূর্তি ভাঙতে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুকে প্রেরণ করেন। মূর্তিটি নাখলায় একটি ঘরের ভেতর ছিল। কুরাইশ, কিনানা ও মুযার গোত্রের যেসব লোক ওই এলাকায় বসবাস করত, তারা সেখানে এর পূজা করত। খালিদ বিন ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেটিকে ধ্বংস করে দেন। (৬)
৪। আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু অষ্টম হিজরিতে মক্কাবিজয়ের পর হুযাইল গোত্রে গমন করে নবিজির নির্দেশে ‘সুওয়া’ মূর্তি ধ্বংস করেন। (৭)
আফসোস, যে আমর ইবনুল আস নিজে নবিজির নির্দেশে সুওয়া মূর্তি ধ্বংস করেছিলেন, তাঁর ব্যাপারে বলা হচ্ছে তিনি কিছু মূর্তি অক্ষত রেখেছিলেন।

এবার চলুন দেখে নিই মূর্তির ব্যাপারে ফিকহের নির্দেশনা কী?
আল্লামা ইবনুল হুমাম রহ. লিখেছেন : মুসলমানদের শহর তিন প্রকার।

এক. যেসব শহর মুসলমানরা নির্মাণ করেছে। যেমন, কুফা, বসরা, বাগদাদ, ওয়াসেত ইত্যাদি। এসব শহরে নতুন করে মূর্তি কেনাবেচা শুরু করা, ভিন্নধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ করা এবং তাদের উপাসনার জন্য জমায়েত করা জায়েয নেই। এই ব্যাপারে আহলুল ইলমের ইজমা রয়েছে।

দুই. যেসব শহর মুসলমানরা যুদ্ধ করে বিজয় করেছে। সেখানেও সর্বসম্মতিক্রমে নতুন করে এসব করা জায়েয নেই। এখন প্রশ্ন হলো, আগে যদি থাকে সেগুলো কি ভেঙে ফেলতে হবে? ইমাম মালেক, শাফেয়ি ও আহমদ রহ.-এর একটি মত অনুযায়ী—সেগুলো ভেঙে ফেলা আবশ্যক। আমাদের মতে সিদ্ধান্ত হলো—সেসব উপাসনালয় তাদের দায়িত্বে দিয়ে এগুলোকে ঘর বানিয়ে বসবাস বলা হবে। ভেঙে ফেলবে না। ইমাম শাফেয়ী ও আহমদের একটি মতও আমাদের মতের অনুরূপ। কারণ হলো, সাহাবায়ে কেরাম অনেক শহর জয় করেছেন যুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু সেখানকার উপাসনালয় ও আশ্রম ভাঙ্গেননি।

তিন. যেসব শহর সন্ধির মাধ্যমে বিজয় করা হয়েছে। যদি সন্ধি হয় এভাবে যে, অঞ্চল তাদের কিন্তু জিযিয়া দিবে মুসলমানদেরকে, তাহলে সেখানে নতুন করেও কেনাবেচা করতে পারবে। আর যদি সন্ধি হয় এই শর্তে যে, যমিনের মালিকও মুসলমানরা এবং তারা জিযিয়াও দিবে, তাহলে উপাসনালয়ের ক্ষেত্রে হুকুম হবে সন্ধির শর্ত অনুযায়ী। অর্থাৎ, শর্তে যদি উপাসনালয় নির্মাণের অনুমতি থাকে তাহলে নির্মাণ করতে পারবে। তবে উত্তম হলো, উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতো অনুমতির শর্ত না রাখা।(৮)

এবার আসুন মুহাম্মদ ইমারাহর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। তাঁর বক্তব্যের সারকথা হলো, সাহাবায়ে কেরাম বিজিত দেশগুলোর উপাস্য নয় এমন মূর্তি রেখে দিতেন। শুধু যেগুলো উপাস্য সেগুলো ভাঙ্গতেন।

প্রথমত, এটি তো একেবারেই বাস্তবতা-বিবর্জিত কথা। ফিকহ এবং ইতিহাস থেকে আমরা যেটা দেখি শর্তসাপেক্ষে উপাসনালয়ের মূর্তিগুলো রাখা হবে। যেন মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমরা তাদের উপাসনা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু অন্য মূর্তি কোনোভাবেই রাখা হবে না। অথচ মুহাম্মদ ইমারাহ বলতে চাচ্ছেন সাহাবিরা যেগুলো উপাস্য মূর্তি সেগুলো ভেঙ্গেছেন, অন্যগুলো রেখেছেন। যা একেবারেই অবাস্তব।
দ্বিতীয়ত, এখানে কথা বলা হচ্ছে সেই মুবারক জামাত সম্পর্কে, যারা মক্কা বিজয়ের সময় নবিজির সাথে ছিলেন। নবিজিকে তারা স্বচক্ষে মূর্তি ভাঙ্গতে দেখেছেন। মূর্তি সম্পর্কে নবিজির নির্দেশনা তারা জানতেন। এরপরেও এটা কী করে সম্ভব যে তারা কোনো মূর্তি দেখেছেন কিন্তু তা ভাঙ্গেননি। এটি নিশ্চিতভাবে সাহাবায়ে কেরামের উপর বড় ধরনের অপবাদ।

পরবর্তী আলোচনার আগে এখানে একটি মৌলিক বিষয় বলে রাখা যাক। পাশ্চাত্য-মানস প্রভাবিত আধুনিক গবেষকদের একটি বড় অংশ প্রায়ই ইসলামকে এমন এক রুপ দিতে চেষ্টা করেন, যেটি ইসলামের প্রকৃত রুপ নয়। পাশ্চাত্য ও আধুনিকতার সাথে তাল মিলানোর জন্য তারা ইসলামকে এর নিজস্ব অবস্থান থেকে টেনে অন্য দিকে নিয়ে যেতে চান। এই ধরণের গবেষকদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো বিষয়ের সমাধানের জন্য তারা ফিকহশাস্ত্রকে আলোচনায় রাখেন না। ফিকহকে এড়িয়ে তারা ইতিহাসের কোনো ঘটনা খুঁজে নেন, যেখানে কেউ বিচ্যুতির শিকার হয়েছিল। তারপর একেই দলিল বানান।

ধরা যাক, শাতিমে রাসুলের ইস্যু আসলো। তারা এক্ষেত্রে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল কিংবা ফিকহের নির্দেশনা আলোচনা করবেন না। তারা খুঁজে-টুজে ইতিহাসের কোনো বর্ণনা নিয়ে আসবেন, যেখানে দেখা যাবে কোনো শাসক শাতেমে রাসুলকে শাস্তি না দিয়ে খাতির করেছিল। এখন এই শাসকের কাজটি শরিয়াসম্মত হয়েছিল কি না সেই আলোচনা না করেই তারা বলে দিবে, দেখুন ইসলাম শাতিমে রাসুলের উপর এত কঠোর হওয়ার আদেশ দেয় না। এভাবে এই ধরনের গবেষকরা ব্যক্তির বিচ্যুতিকে শরিয়াহর দলিল বানাতে উঠেপড়ে লাগে। তাদের কারো কারো লেখা পড়লে তো এমনও মনে হয় ঈমান ও কুফরের মাঝে সংঘাতের কিছু নেই। দুটি মূলত এক বৃন্তের দুই ফুল। মুমিন আর কাফির আখিরাতে পাশাপাশি দুই বাড়িতে থাকবে। এক বাড়ির নাম জান্নাত, আরেক বাড়ির নাম জাহান্নাম। দুনিয়ার মত আখিরাতেও তারা প্রতিবেশি হিসেবেই থাকবে। জানালা দিয়ে খোশগল্প করবে।

মুহাম্মাদ ইমারাহ কিংবা তাঁর মত অন্য গবেষকরা যারা বলতে চান সাহাবায়ে কেরাম মিসর বা বিজিত এলাকার অনেক মূর্তি ভাঙ্গেননি তাদের দলিল হলো, যদি সাহাবায়ে কেরাম মূর্তি ভাঙ্গতেনই তাহলে মিসরে ফারাওদের মূর্তি কীভাবে রয়ে গেল। কীভাবে রয়ে গেল গ্রেট স্ফিংস অফ গিজা নামে পরিচিত সুবিশাল মূর্তিটি?

শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ এই প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, সাহাবায়ে কেরামের মূর্তি না ভাঙ্গার পেছনে তিনটি কারণ বিদ্যমান।
১। সাহাবায়ে কেরাম মিসর জয় করলেও তারা সকল অঞ্চলে পৌঁছতে পারেননি। এই মূর্তিগুলোর অবস্থান ছিল দূরবর্তী এলাকায় যেখানে সাহাবায়ে কেরাম পৌঁছেননি।
২। এসব মূর্তির অনেকগুলো বাইরে ছিল না, বরং ফারাওদের পরিত্যক্ত বাসস্থানের ভেতরে ছিল। নবিজির নির্দেশনা হলো জালিম ও আজাবপ্রাপ্তদের বাসস্থানের পাশ দিয়ে অতিক্রমের সময় তার ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না। পাথরপূজারি সামুদ গোত্রের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদেরকে বলেছিলেন, ‘তোমরা এইসব আযাবপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের এলাকায় যেও না। যতি যেতেই হয় তবে ক্রন্দনরত অবস্থায় যাবে। এই আশঙ্কায় যে, তাদের মতো আযাব তোমাদেরকেও আক্রান্ত করতে পারে”। (৯) এই হাদিসের নির্দেশনা মেনে সাহাবায়ে কেরাম ফারাওদের পরিত্যক্ত বাসস্থানে প্রবেশ থেকে বিরত থাকতেন।
৩। বর্তমানে যেসব মূর্তি দেখা যাচ্ছে এর অনেকগুলোই সাহাবিদের সময়ে মাটি বা বালুর নিচে লুকানো ছিল। এগুলো পরে প্রাকৃতিক পরিবর্তন বা প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আবিষ্কার হয়। গবেষক যিরিকলির মত হলো, এসব মূর্তির বেশিরভাগই সাহাবিদের সময়ে বালুর নিচে ছিল, বিশেষ করে স্ফিংস অফ গিজা। (১০)
এরপরও যদি ধরে নেই, সাহাবায়ে কেরাম মূর্তি না ভেঙ্গে রেখে দিতেন, তাহলে প্রথমে এটা প্রমান করতে হবে যে, তারা এই মূর্তিগুলো দেখেছিলেন, এবং ভাঙ্গতে সক্ষম ছিলেন; কিন্তু তারপরও ভাঙ্গেননি (১১)

শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদের আলোচনা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখি মিসরে যেসকল মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে এর বেশিরভাগই আবিষ্কার হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের যুগের পরে। বেশকিছু মূর্তি পাওয়া গেছে ফারাওদের সমাধি আবিষ্কারের সময়, সমাধির ভেতরে। গত দুই শতাব্দির মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে ফারাওদের এমন কিছু সমাধির তালিকা নিম্মরুপ-

১। আহতেপের সমাধি। আবিষ্কারের সময় ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ।
২। আহমোসের সমাধি। আবিষ্কারের সময় ১৯০৩-৫ খ্রিস্টাব্দ।
৩। আহমোসে মেরিতামুনের সমাধি। আবিষ্কারের সময় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ।
৪। ইনহাপির সমাধি। আবিষ্কারের সময় ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ।
৫। আমেনহোপের সমাধি। আবিষ্কারের সময় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ।

এসব সমাধি থেকে অনেক মূর্তি আবিষ্কার হয়েছিল। এখনও মিসরের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে নতুন নতুন মূর্তি আবিষ্কার হচ্ছে। ২০১৭ সালে কায়রোর কাছে মাটি খুঁড়ে প্রায় তিন হাজার বছর আগের একটি মূর্তি আবিষ্কার করা হয়। ২০১০ সালে ‘টাপোসিরিস ম্যাগনা’ মন্দির থেকে উদ্ধার করা হয় গ্রানাইট পাথরের একটি মূর্তি।

এবার আসা যাক স্ফিংস অফ গিজার বিষয়ে। স্ফিংস তৈরি করা হয়েছিল প্রায় চার হাজার বছর আগে। গোটা মূর্তিটি মাত্র একটি চুনাপাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিল। যার দৈর্ঘ্য ছিল ৭৩ মিটার এবং উচ্চতা ছিল ২০ মিটার। পৃথিবীতে পাথর কেটে যত ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে তার মধ্যে স্ফিংস বৃহত্তম। ১৯২৫ সালের আগ পর্যন্ত স্ফিংসের গোটা দেহটি দেখতে কেমন তা কেউ জানত না। মুখমণ্ডল ছাড়া সবটাই বালুতে ডুবে ছিল। ১৯২৫ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত এমিল বারেজ নামক এক ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালিয়ে স্ফিংসকে বালুর নিচ থেকে বের করেন। অর্থাৎ স্ফিংসটির বেশিরভাগ অংশ ১৯২৫ সাল পর্যন্ত বালুর নিচে চাপা ছিল।

আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক তাহলে। দেখা যাক, মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে কারা কারা স্ফিংসের আলোচনা করেছেন।

আবদুল লতিফ বাগদাদি মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত পর্যটক। তিনি ৫৫৭ হিজরীতে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মিসর সফরকালে স্ফিংস দেখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, পিরামিডের কাছে একটি বিশাল মূর্তি রয়েছে যার উপরের অংশ দৃশ্যমান, শরিরের বাকি অংশ মাটির নিচে। (১২)

তাহলে দেখা যাচ্ছে হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দিতেও স্ফিংসের বেশিরভাগ অংশ মাটির নিচেই চাপা ছিল। শুধু মাথার অংশ উপরে ছিল। আরেকটু পেছনে ফেরা যাক এবার। বিখ্যাত ঐতিহাসিক হিরোডোটাস। ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি জন্মগ্রহন করেন বলে ধারণা করা হয়। ইতিহাসের তথ্য অনুসন্ধানে তিনি বিভিন্ন এলাকা সফর করেন। তিনি মিসরও ভ্রমন করেন। তাঁর লিখিত দ্য হিস্টরিজ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে পুরোটাই এসেছে মিশরের আলোচনা। এখানে তিনি পিরামিড, দেবদেবী, জীবনাচার, চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনকি নীলনদের নৌকার বিবরণ ইত্যাদি এনেছেন। তিনি যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখেছেন তাঁর কথাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোথাও তিনি স্ফিংস এর কথা উল্লেখ করেননি। (১৩)

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে হিরোডোটাসের সময় স্ফিংস এর পুরোটাই সম্ভবত বালুর নিচে চাপা ছিল। হিরোডোটাসের সাথে আবদুল লতিফ বাগদাদির সময়ের ব্যবধান প্রায় ১৫০০ বছর। এ থেকে অনুমান করা যায়, স্ফিংস মাটির নিচে চাপা ছিল অন্তত হিরোডোটাসের সময় পর্যন্ত, পরে কোনোভাবে এর উপরের অংশ দৃশ্যমান হয়। কিন্তু তা কখন দৃশ্যমান হয় তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। (১৪)

এখন আমরা মূর্তির ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা দেখবো, নবিজির আমল দেখবো এরপর চিন্তা করব, এটি কী করে সম্ভব যে সাহাবায়ে কেরাম নবিজির আমল জানার পরেও এ ধরনের মূর্তিকে অক্ষত রেখে দিবেন। আমরা নবিজির আমল এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এই সিদ্ধান্তই নিব যে সাহাবায়ে কেরামের যুগে স্ফিংস মাটির নিচে লুক্কায়িত ছিল। এটি প্রকাশিত হয়েছে পরে কখনো। সম্ভবত, মুসলমানদের বিজয়ের পর থেকে আবদুল লতিফ বাগদাদির সময়কাল পর্যন্ত মাঝের কোনো সময়ে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে এর উপরের অংশ দৃশ্যমান হয়ে উঠে।
এরপরের কথা হলো, যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, সাহাবায়ে কেরামের সময়ে স্ফিংসের উপরের অংশ দৃশ্যমান ছিল, তাহলে এটিও মেনে নিতে হবে যে, এ ধরনের বিশাল পাথুরে মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার মত সরঞ্জাম সাহাবায়ে কেরামের হাতে ছিল না। সাহাবায়ে কেরামের মিসর জয়ের প্রায় ২০০ বছর পর খলিফা মামুন পিরামিড ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে অনেক দিন ব্যয় করেও এই শক্তিশালী স্থাপনা ভাঙ্গতে পারেননি। (১৫)
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই, যে সাহাবায়ে কেরাম স্ফিংস দেখেছিলেন তবুও একথা মানতে হবে যে এটি ধ্বংস করার মত শক্তিশালী সরঞ্জাম তাদের হাতে ছিল না। আগেই বলেছি, সাহাবায়ে কেরাম স্ফিংস বা এ ধরণের কোনো মূর্তি দেখেছেন এবং ইচ্ছাকৃত তা অক্ষত রেখেছেন এমন ঐতিহাসিক প্রমান নেই। মুহাম্মদ ইমারাহ যে অনুমান করেছেন তা খুবই দুর্বল এবং নিছকই অনুমান। আর নিছক অনুমান দিয়ে কোনোকিছু প্রমাণ করা যায় না।

এবার ঐতিহাসিক মাকরেজির একটি বক্তব্য দেখা যাক।

তিনি লিখেছেন, তাঁর সময়কালেও স্ফিংসের উপরের অংশ দৃশ্যমান ছিল। এ সময় স্ফিংসকে ঘিরে মানুষের কিছু বিশ্বাস ও প্রথা গড়ে উঠেছিল। এ অবস্থা দেখে ৭৮০ হিজরীতে মুহাম্মদ সাইম আদ দাহর নামে একজন সুফিসাধক স্ফিংসের চেহারার কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলেন। (১৬)
দেখুন, মাকরিজি হিজরী অষ্টম শতাব্দির কথা বলছেন। সে সময়ই একজন মুসলিম এটি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাহলে সাহাবায়ে কেরামের সেই মোবারক জামাত, যারা খাইরুল কুরুনের প্রতিনিধি, তাদের ব্যাপারে কী করে এই সন্দেহ করা যায় যে, তারা স্ফিংস দেখেও এটিকে অক্ষত রেখেছেন; ভেঙ্গে ফেলার কোনো চেষ্টা করেননি? যেখানে স্বয়ং নবিজি এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন।

পুরো আলোচনার সারকথা হলো, সাহাবায়ে কেরামের সময় কোনো অঞ্চল জয় করার পর সেখানকার উপাসনালয়ের মূর্তিগুলো অমুসলিম বাসিন্দাদের জন্য রেখে দেয়া হত। কিন্তু উপাসনালয়ের বাইরের যেসব মূর্তি সেগুলোতে কোনো ছাড় দেয়া হত না। যারা এই কথা বলেন, যে সাহাবায়ে কেরাম কিছু মূর্তি ভাঙ্গেননি, তারা তাদের দাবীর পক্ষে কোনো দলিল পেশ করতে পারেন না। তারা কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারেন না যে, সাহাবায়ে কেরাম এ ধরনের মূর্তি দেখেছেন, ভাঙ্গতে সক্ষম ছিলেন, তবু তারা তা অক্ষত রেখে দিয়েছিলেন। এই সকল গবেষকরা নিছক অনুমান করেন। তাদের এই অনুমান নানা কারণে ভুল, যা সম্পর্কে উপরে আলোকপাত হয়েছে।

শেষ কথায় আসি। ইসলামের ইতিহাসচর্চার উদ্দেশ্য হলো, ইসলামের মূল চেতনা উজ্জীবিত করা। সালাফদের আদর্শে নিজেদের সাজানো। ইসলামের মূল আবেদন ও বার্তা রক্ষা করাই এখানে মূল কাজ। অন্যগুলো শাখা-প্রশাখা। এখন শাখা-প্রশাখা সুন্দর করার জন্য যদি গোড়া কেটে ফেলা হয় তাহলে সেটা বোকামি হবে। ইমাম কারাফি রোবট আবিষ্কার করেছিলেন কি করেননি, তার এই রোবট ভাষ্কর্য ছিল নাকি অন্য কিছু, এই আলাপ অতটা জরুরি নয়, যতটা জরুরি হল মূর্তির ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান পরিষ্কার করা। মুসলিমরা এক সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা করেছেন এই কথা শক্তিশালী করার জন্য যদি সাহাবায়ে কেরামের উপর মূর্তি না ভাঙ্গার অপবাদ দিতে হয়, তাহলে আর থাকেইটা কী?
আল্লাহ আমাদের সকলকে সতর্ক থাকার তাওফিক দান করুক।

সূত্রসমূহ :

১। লেখাটি পড়তে- https://bit.ly/34y4HIm
২। সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৯৬৯
৩। সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৮৩২
৪। লিসানুল আরব, ৬/১৫ – ইবনু মানযুর। দার সাদের, বৈরুত, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ।
৫। প্রাগুক্ত, ৬/৩৯৯
৬। সিরাতে ইবনে ইসহাক, পৃষ্ঠা-৫৪৬-৫৪৭ – ইবনু ইসহাক
৭। মাগাযি, পৃষ্ঠা-৭ – ওয়াকিদি। কলকাতা সংস্করণ।
৮। ফাতহুল কাদির ৬/৫৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, ১৪২৪ হিজরী
৯। সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৪৪২০, ৪৭০২। সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৯৮০।
১০। শিবহু জাযিরাতিল আরব, ৪/১১৮৮
১১। শায়খের পুরো আলোচনা দেখুন, https://bit.ly/3b7NDez
১২। রিহলাতু আবদুল লতিফ বাগদাদি ফি মিসর, পৃ-৯৬ – আবদুল লতিফ বাগদাদি।
১৩। দেখুন, Histories, volume 1, Books 1-2 –Herodotus. Ed- A.D.Godley. Page- 275- 498. বাংলায় পড়তে দেখুন শাহেদ আলী অনূদিত ‘ইতিবৃত্ত’। প্রকাশক বাংলা একাডেমী।
১৪। স্ফিংস এর ইতিহাস জানতে দেখুন ডক্টর সালিম হাসান রচিত ‘আবুল হুল’
১৫। আল মুকাদ্দিমা, ১/১৪ – ইবনু খালদুন। দারুল বলখি, দিমাশক, ১৪২৫ হিজরী।
১৬। আল মাওয়ায়েজ ওয়াল ইতিবার বিজিকরিল খুতাতি ওয়াল আসার, ১/৩৪৮ – আল্লামা মাকরেজি। মাকতাবাতু মাদবুলি, কায়রো, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ।

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন