ইতিহাস-পাঠ : প্রয়োজন নির্বাচিত অধ্যয়ন

কয়েক বছর ধরে বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার একটা জাগরণ হয়েছে বলে ধরা যায়। এ সময় ইতিহাস বিষয়ে প্রচুর বইপত্র অনুবাদ হয়েছে, মৌলিক গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। সামনেও ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃত কলেবরের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। ইতিহাস নিয়ে লিখিত বইপত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে পাঠের ক্ষেত্রে কিছুটা শূন্যতা দেখা যাচ্ছে। এই শূন্যতা হলো গুরুত্বের বিচারে বিষয় নির্ধারণের শূন্যতা। কোন বিষয়টি আগে জানা প্রয়োজন, কোন বিষয়টি বেশি জানা প্রয়োজন, জানার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা কী হবে এগুলো ঠিক না করেই, এলোপাথাড়ি পড়াশোনা করা হচ্ছে। এ ধরনের পাঠে সাধারণত গভীরতা আসে না এবং শাস্ত্রীয় রুচিবোধও তৈরি হয় না।

 

ইতিহাস একটি বিস্তৃত বিষয়। এর নানা ধাপ আছে। সিরাত, খিলাফতে রাশেদা, খিলাফতে বনু উমাইয়া, খিলাফতে বনু আব্বাস, মামলুক সাম্রাজ্য, উসমানি সাম্রাজ্য, ইসলামি শাসনব্যবস্থা, সামাজিক সাংস্কৃতিক রীতিনীতি সবকিছুই এর আওতাভুক্ত। আমরা প্রথমে কোন বিষয়টি পড়বো, কোন বিষয়টি জানা আমাদের বেশি প্রয়োজন, এটি শুরুতেই ঠিক করে নিতে হবে। আল্লামা সাখাবী রহিমাহুল্লাহ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল ইলান বিত তাওবিখ লিমান যাম্মা আহলাত তারিখ’ এ গুরুত্বের বিচারে ইতিহাসের কিছু শ্রেনীবিন্যাস করেছেন। কোন অংশ অধ্যয়ন বেশি জরুরি, কোন অংশ কম, সেটাও তিনি বলে দিয়েছেন। তার তালিকাটি মাথায় রাখলে যারা ইতিহাস পাঠে আগ্রহী তাদের বিশেষ সুবিধা হবে। আল্লামা সাখাবীর দেয়া তালিকা মতে,

 

১। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনচর্চা করা সবার জন্য আবশ্যক। আবুল হুসাইন ফারিস বলেন, নবিজির সীরাত মনে রাখা উলামা ও সুফিদের জন্য ওয়াজিব।

নবিজির সীরাত ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একজন মুসলমানের জন্য সবার আগে তার প্রিয় নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সীরাত জানা আবশ্যক। উসমানিরা কী করেছিলেন, মুঘলদের অবদান কী এসব জানার আগে সীরাত জানা প্রয়োজন। সীরাত উম্মাহর চেতনার পাঠশালা। আবু জাহল ও উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) কে আলাদা করে চেনার আয়না। সীরাতের আয়নায় চোখ রেখে চেনা যাবে মুনাফিক ও কাফের, তফাত করা যাবে শত্রু ও মিত্রের। সীরাতের পরিপূর্ণ পাঠে দূর হবে অনেক সংশয় ও সন্দেহ। পশ্চিমা মানস প্রভাবিত জনপ্রিয় স্কলার ও দাঈ’রা সীরাতের খন্ডিত অংশ সামনে এনে ইসলামের কিছু বিধান বিকৃত করার যে অপচেষ্টা চালান তা নস্যাৎ করে দিবে সীরাতের পরিপূর্ণ পাঠ। পাঠক ফিরে যাবেন মক্কা বিজয়ের দিনে। কাবার চত্বরে ঝলসে উঠা তরবারি ও মাটিতে পড়ে থাকা ইবনু খতালের রক্তাক্ত লাশ জবাব দিবে অনেক প্রশ্নের। শাতিমে রাসুলের প্রশ্নে যে কথাগুলো লুকিয়ে রাখে ‘অল্পশিক্ষিত’ জনপ্রিয় দাঈ ও ‘আলিমুল লিসান’ স্কলাররা, সীরাতের পরিপূর্ণ পাঠ সেসব অধ্যায় পাঠকের সামনে এনে দিবে। রহমাহ ও মালহামার নবিকে পাঠক আবিষ্কার করবেন নতুন করে।

 

দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে আমরা দেখছি ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় চর্চার প্রতি মানুষের আগ্রহ সীরাতচর্চার চেয়েও বেশি। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এটি গায়রতের প্রশ্ন। নবিজির জীবন সম্পর্কেই যদি না জানলাম তাহলে অন্যকিছু জেনে আমার লাভ কী? এই জানা তো অর্থহীন। আমাদেরকে সবার আগে সীরাত পাঠ করতে হবে। নবিজির জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে জানতে হবে। বাংলায় প্রকাশিত কয়েকটি সীরাত গ্রন্থের নাম দিচ্ছি।

 

-সিরাতুন নবি (কালান্তর)

-সীরাহ (রেইনড্রপস)

-সীরাতুন নবি (মাকতাবাতুল বায়ান)

-সীরাতে মোস্তফা (একাধিক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে)

-উসওয়াতুন হাসানাহ (রুহামা)

-মহানবী মহান শিক্ষক (মাকতাবাতুল হিজায)

-শামেয়েলে তিরমিযি

 

২। ইতিহাসের যেসব ঘটনা জানা আকিদা, ফিকহি মাসায়েল কিংবা উম্মাহর কল্যানের জন্য জরুরি, এগুলোও জানা জরুরী। সমাজের একটা অংশের মানুষকে অবশ্যই ইতিহাসের এই অংশের চর্চা করাতে হবে।

ইতিহাস অনেক সময় আকিদা ও ফিকহি মাসায়েলের সাথে জড়িয়ে যায়। যেমন একটি হাদিসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হলে আমাদেরকে এর বর্ননাকারীদের জীবন জানতে হবে। এটাই তো ইতিহাস। তাহলে দেখা যাচ্ছে বর্ননাকারীদের ইতিহাস না জানলে আমরা হাদিসদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। ফলে তাদের ইতিহাস জানা জরুরি। একইসাথে হাদিসের ব্যাপারে যেহেতু সমাজের শুধু একটি অংশই চর্চা করেন বা করবেন, তাই অন্যদের এসব না জানলেও সমস্যা নেই। কিন্তু যারা চর্চা করবেন তাদেরকে অবশ্যই এই বিষয়ের ইতিহাস পড়াশোনা করতে হবে।

 

৩। সাহাবায়ে কেরাম ও নেককারদের জীবনি জানা, যা জানলে নেক আমলের দিকে অন্তর উদ্বুদ্ধ হয়, তা উত্তম কাজ। যে জিনিস নেক আমলের দিকে ধাবিত করে তা নিয়ে চর্চা করাও প্রশংসনীয়।

সীরাতের পর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলে সাহাবায়ে কেরামের জীবন। বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশেদার জীবন জানা জরুরি। রোমান ও পারসিয়ান সাম্রাজ্য কীভাবে বালির প্রাসাদের মত ভেঙ্গে পড়েছিল তাদের সামনে, সেই ইতিহাস পাঠে উম্মাহ নতুন চেতনা নিয়ে জাগ্রত হবে। সম্প্রতি আলি মুহাম্মদ সাল্লাবির লেখা চার খলিফার জীবনি প্রকাশিত হয়েছে এগুলোও আমরা পড়তে পারি।

 

৪। বিভিন্ন সাম্রাজ্যের ইতিহাস, বিভিন্ন এলাকার ইতিহাস, যা জানলে দ্বীনের কোনো ক্ষতি নেই, তা জানা বৈধ।

যেমন উসমানিদের ইতিহাস, মামলুকদের ইতিহাস ইত্যাদি।

 

৫। ইতিহাসের বিভিন্ন চরিত্রদের প্রেমের ঘটনাবলী, কিংবা পাপাচারিদের এমন ঘটনাবলী পড়া যাতে আকিদা ও আখলাকের মধ্যে প্রভাব পড়ে, তা পাঠ করা হারাম।

যেমন কেউ আকবর ও যোধাবাঈর প্রেমের কাহিনী পড়তে ব্যস্ত হলো, কিংবা কাবুলে জাহাংগির ও নুরজাহানের প্রথম সাক্ষাতের বর্ননা রসিয়ে রসিয়ে পড়া তার কাছে আগ্রহের বস্তু, তাহলে তার জন্য এটি বৈধ হবে না। কারণ এটি অশ্লীলতা চর্চার নামান্তর। এজন্যই আবুল ফারাজ ইস্ফাহানির কিতাবুল আগানি সম্পর্কে ইবনুল জাওযি রহিমাহুল্লাহ শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। ইতিহাসের যে অংশ চর্চা করা হারাম বা মাকরুহ, তা ঐ সময় হারাম বা মাকরুহ হবে, যখন তা মনোরঞ্জনের জন্য চর্চা করা হবে। অনেক সময় এসব অংশ চর্চা করাও জরুরি হয়ে উঠে। যেমন কেউ সম্রাট আকবরকে নেককার সাচ্চা মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি দিল। এখন তার এই কথার জবাবে প্রকৃত বাস্তবতা তুলে আনার জন্য একজন গবেষককে সম্রাট আকবরের জীবন পড়তে হবে। তার হারেমের ঘটনাবলীও দেখতে হবে। এক্ষেত্রে এটি হারাম হবে না। এক্ষেত্রে তিনি কাজটি করেছেন সত্য তুলে আনার জন্য, গবেষণার জন্য। কিন্তু কেউ যদি হারেমের যৌনতার এসব কাহিনী শুধু মনোরঞ্জনের জন্য পড়ে তাহলে তা হারাম হবে, কারন এসব ঘটনা তাকে পাপের প্রতি আকৃষ্ট করবে, তার আমলের স্বাদ নষ্ট করে দিবে।

 

৬। কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য মুশাজারাতে সাহাবা (জংগে জামাল, জংগে সিফফিন) নিয়ে আলোচনা করা বা এগুলো চর্চা করা মাকরুহ। এর কারণ হলো, এই অংশের আলোচনা করা জরুরি কিছু নয়, আবার এর আলোচনা করার মাধ্যমে শয়তানের ধোঁকায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অনেক সময় শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মানুষ এসব অংশ নিয়ে খুব বেশি চর্চা করে এবং এক সময় সাহাবায়ে কেরামের প্রতি সম্মান হারিয়ে বসে। যদি কেউ এসব অংশের আলোচনা পড়লে তার আকিদায় বিচ্যুতির সম্ভাবনা থাকে তাহলে তার জন্য এসব অংশ পাঠ করা হারাম। (ইবনু বাত্তাহর সূত্রে মাওলানা ইসমাইল রেহান, তারিখে উম্মতে মুসলিমাহ, ১/৫৩)

 

কিন্তু ওরিয়েন্টলিস্ট ও তাদের প্রভাবিত গবেষকরা প্রায়ই সাহাবায়ে কেরামের সম্মানে যে আঘাত হানে তার জবাব দেয়ার জন্য এসব অংশের চর্চা করা, পাঠ করা জরুরি এমনকি অনেক সময় ওয়াজিব। কথাটা আরো সহজে এভাবে বলা যায়, সাধারণ পাঠক যারা সহজেই বিভ্রান্ত হবার আশংকা থাকে তাদের জন্য এই অংশগুলো নিয়ে পড়া উচিত নয়। এগুলো নিয়ে পড়বেন ও কাজ করবেন গবেষকরা। তারা অমুসলিমদের সংশয়ের জবাব দিবেন এবং সাধারণ মানুষের সংশয় দূর করবেন। তাদের ঈমান আকিদা রক্ষা করবেন। তাদের জন্য এসব অংশ চর্চা হারাম নয়। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রগুলো সম্পর্কে যার বিস্তৃত অধ্যয়ন নেই, বর্ননাগুলোর সুত্র পরম্পরা যাচাই করার সামর্থ্য যার নেই তার জন্য এই অধ্যায়গুলো নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করা মানে নিজেকে চোরাবালিতে টেনে নেয়া। মুশাজারাতে সাহাবা এমন এক ভয়ানক চোরাবালি, যে চোরাবালিতে আটকা পড়ে তলিয়ে গেছেন হিমালয় সদৃশ অনেক ব্যক্তিত্বও।

 

মুশাজারাতে সাহাবা অধ্যয়ন ও চর্চার জন্য প্রয়োজন সুদীর্ঘ অধ্যয়ন, শাস্ত্রীয় পন্ডিতদের সান্নিধ্য ও তত্ত্বাবধান, শাস্ত্রীয় রুচিবোধ ও অধ্যাবসায়। এসব ছাড়া হুট করে বাজার থেকে আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া কিনে এনে দুপাতা পড়ে কোনো মন্তব্য করে বসলে আখেরে নিজের ঈমান আমলেরই ক্ষতি করা হবে, যেই প্রবনতা ইদানিং বেশ চোখে পড়ছে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে ধারাবাহিকতার সাথে গুরুত্ব বুঝে পড়াশোনা করার তাওফিক দিন।

 

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন