চেঙ্গিস খানের হামলা

দূতহত্যার সংবাদ শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন চেঙ্গিস খান। তার নিষ্ঠুর চেহারায় জমা হলো অশ্রুবিন্দু। হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন তিনি। খুলে ফেললেন মাথার ক্যাপ, একটানে ছিড়লেন জামার বুকের অংশ। ছুটলেন নিজের ঘোড়ার দিকে। খুটি থেকে হ্যাচকা টানে ছুটিয়ে নিলেন প্রিয় ঘোড়া নাইমানকে। জিন ছাড়াই ঘোড়ার কেশর চেপে রওনা হলেন বুরখান খালদুন পর্বতের দিকে। তাঁর পিছু নিল সন্তান ও সেনাপতিরা। তাতারদের কাছে পবিত্র পর্বত বলে স্বীকৃত বুরখান খালদুনের সামনে পৌঁছে তিনি কোমরবন্ধ খুলে গলায় লটকে দিলেন। এর অর্থ হলো তিনি দেবতাদের সামনে আত্মসমর্পণ করেছেন। এরপর আর্তনাদ করে উঠলেন চেঙ্গিস খান। পর্বতের গিরিখাদে প্রতিধ্বনিত হলো তাঁর সেই করুণ কণ্ঠের আর্তনাদ। তিন দিন পর পর্বত থেকে নেমে এলেন তিনি। তাঁর চেহারায় তখন প্রশান্তি বিরাজ করছে। যখন তিনি মুখ খুললেন, বোঝা গেল স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তিনি। দৃঢ়কণ্ঠে নিজের অনুসারীদের বললেন, ‘আসমানে যেমন দুটি সূর্য থাকতে পারে না, তেমন জমিনেও দুজন বাদশা থাকতে পারবে না।‘(১)

এরপর তিনি সংক্ষিপ্ত একটি বার্তা পাঠালেন খাওয়ারিজম শাহের উদ্দেশে। সেই পত্রে লেখা ছিল, ‘যুদ্ধ চেয়েছিলে, যুদ্ধ হবে। এরপর কী হবে আমার জানা নেই, শুধু ঈশ্বর জানেন।’(২)

মঙ্গোলিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাতারদের নির্দেশ দেওয়া হলো গোবি মরুভূমির দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে একত্রিত হতে। চেঙ্গিস খানের বার্তা নিয়ে দূতরা ছুটতে লাগল রাজ্যের সর্বত্র। তাতাররা একত্রিত হতে শুরু করল। রক্তের গন্ধ পেয়ে হাঙ্গর যেভাবে ছুটে আসে, ঠিক সেভাবেই ছুটে আসছিল তাতাররা। এই প্রথম তারা সুযোগ পাচ্ছে পর্বতমালার ওই পাড়ে আক্রমণ করার, যেখানে আছে সমৃদ্ধ শহর ও সভ্যতা।

চেঙ্গিস খানের নির্দেশে একত্র হওয়া তাতারদের মোট সংখ্যা কত ছিল তা নিয়ে দু-ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার ভাষ্যমতে এ সময় তাতারদের সংখ্যা ছিল ৮ লাখ। তাবাকাতে নাসিরির বর্ণনামতে তাদের সংখ্যা ছিল ৭ লাখ। (৩)

৬১৬ হিজরির রজবে এই বিশাল বাহিনী রওনা হলো খাওয়ারিজম আক্রমণের উদ্দেশ্যে। খ্রিষ্ট্রীয় হিসেবে সময়টা তখন সেপ্টেম্বর ১২১৯। গোবি থেকে বের হয়ে এই বাহিনী সফর শুরু করল বৈকাল হ্রদের তীর ঘেষে। সেখান থেকে খাওয়ারিজমের দূরত্ব তখন ২ হাজার কিলোমিটার। পুরো পথটিই ছিল অনাবাদী, যেখানে রসদপ্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এ জন্য চেঙ্গিস খান যাত্রার শুরুতেই পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছিলেন। তার বাহিনীতে ছিল অস্ত্র নির্মাতা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, অনুবাদক ইত্যাদি নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ। সেনাদের সেবা করতে তাদের মহিলাদেরও সঙ্গে রাখা হয়েছিল। প্রতি ১০ জন সেনার জন্য দিনে তিনটি বকরির শক্ত মাংস বরাদ্দ ছিল। সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল পর্যাপ্ত রসদ। চলার পথে গতি যেন কমে না যায় এ জন্য প্রতিজন সেনার সঙ্গে কয়েকটি করে ঘোড়া ছিল। একটি ঘোড়া ক্লান্ত হলে অন্যটিতে চড়ে বসত সেনারা। বিশাল এই সেনাবাহিনী যখন রওনা হতো তখন তাদের দৈর্ঘ্য হতো ১৫০ মাইল। তবে এই বিশাল সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা চেঙ্গিস খান বেশ সাফল্যের সঙ্গেই বজায় রেখেছিলেন।

সে বার শীতের শুরুতে তীব্র তুষারপাত হয়েছিল। বরফ ঢেকে ফেলেছিল সবকিছু, এমনকি বালুর ঢিবিও। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়াও তাতারবাহিনীর গতি কমাতে পারেনি। তারা নিজেদের উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল দৃঢ় পদক্ষেপে। তারা এগিয়ে যাচ্ছিল দক্ষিণ দিকে—উপর থেকে দেখলে মনে হতো কালো পিপীলিকার একটি সারি এগিয়ে যাচ্ছে খাবারের উদ্দেশ্যে। বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেই তারা ৭ হাজার ফুট উঁচু গিরিখাত অতিক্রম করে তিয়েনশানের উপরে ‘পি লু’ বা ‘গ্রেট নর্থ রোডে’ প্রবেশ করে। প্রাচীনকাল থেকেই মধ্যএশিয়ার সঙ্গে চীনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই রাস্তা ব্যবহার করা হতো। এখানে পৌঁছে চেঙ্গিস খান তাঁর বাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেন। নিজের বড় ছেলে জোচি খানকে তিনি ২০ হাজার সৈন্য দিয়ে খাওয়ারিজমের উত্তরপূর্ব সীমান্তে পাঠিয়ে দেন। চেঙ্গিস খানের অনুমান ছিল খাওয়ারিজম শাহ এদিক দিয়েই আক্রমণের আশঙ্কা করবে। ফলে জোচিকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল সে যেন খাওয়ারিজম শাহকে সেখানে ব্যস্ত রাখে। ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়বে খাওয়ারিজমের অন্যান্য সীমান্ত। এই ফাঁকে চেঙ্গিস খান এগিয়ে যাবে বুখারার দিকে। পিতার আদেশে জোচি এগিয়ে গেল খাওয়ারিজমের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের দিকে।
এদিকে চেঙ্গিস খানের চূড়ান্ত পত্র পাওয়ার পর থেকেই সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ বুঝতে পেরেছিলেন যুদ্ধ অনিবার্য। ফলে তিনি যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। ইতিমধ্যে গোয়েন্দারা সংবাদ জানাল তাতাররা উত্তর-পূর্ব সীমান্তের দিকে এগিয়ে আসছে। সুলতান তাঁর বিশ্বস্ত সভাসদ শিহাবুদ্দিন খুয়ুফির কাছে পরামর্শ চাইলেন। শিহাবুদ্দিন খুয়ুফি বললেন, ‘আপনি যুদ্ধের ঘোষণা দিন। জনগণকে বলে দিন তারা যেন সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। তারপর সেনাবাহিনী নিয়ে সাইর নদী অতিক্রম করে তাতারদের অপেক্ষা করুন। ক্লান্ত তাতাররা সফর শেষ করে পৌঁছামাত্রই আপনার তাজাদম সেনারা তাদের উপর আক্রমণ করবে। সুলতান এ পরামর্শ পছন্দ করলেও অন্য সভাসদরা এর বিরুদ্ধে মত দিলেন। তাদের মতে নদী পার হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ সময় সুলতান আলাউদ্দিন দুটি বড় ধরনের পদক্ষেপ নিলেন।

1. সেনাবাহিনীর প্রয়োজন মেটাতে জনগণের কাছ থেকে দুই বছরের কর অগ্রীম নেওয়ার আদেশ দিলেন।
2. সমরকন্দ শহরের চারপাশে ৩৬ মাইল দীর্ঘ মজবুত একটি প্রাচীর নির্মাণের আদেশ দিলেন। সুলতানের ইচ্ছা ছিল প্রয়োজনে এখানে সেনা জমায়েত করে তাতারদের মোকাবিলা করা হবে।।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে সুলতানের এই দুই সিদ্ধান্তই ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। প্রথমত অতিরিক্ত কর নেওয়ার কারণে জনগণ প্রশাসনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে যুদ্ধে সুলতানকে তারা তেমন কোনো সাহায্য করেনি। আর সমরকন্দের প্রাচীর নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই তাতারদের সঙ্গে লড়াই শুরু হয়ে যায়। ফলে সুলতানের উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি।
যুদ্ধের প্রস্তুতির পর সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ ৪ লাখ সেনার একটি বাহিনী নিয়ে উত্তর-পূর্ব সীমান্তের দিকে রওনা হলেন। ৬১৬ হিজরির ৮ শাওয়াল এই বাহিনী বুখারা পৌঁছায়। (৪)

এখানে সুলতান আলাউদ্দিন তাঁর পুত্র জালালুদ্দিনকে ১৫ হাজার সেনা দিয়ে নির্দেশ দিলেন সাইর নদী অতিক্রম করে জোচির উপর আক্রমণ করতে। শাহজাদা জালালুদ্দিন তাঁর বাহিনী নিয়ে সাইর নদী অতিক্রম করে তাতারদের অপেক্ষায় রইলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল তাতারদের আচমকা আক্রমণ করে চমকে দেওয়া। কিন্তু তাতাররা গোয়েন্দা মারফত আগেই সংবাদ পেয়ে যায়। ফলে তারা গতিপথ বদলে ফেলে এবং ভিন্নপথে এগিয়ে এসে হামলা চালায়। জালালুদ্দিন বীরত্বের সঙ্গে তাদের পালটা জবাব দেন; কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। জালালুদ্দিন বুঝতে পারেন, ময়দান ছেড়ে সরে পড়াই উত্তম হবে। তিনি সেনাদের নিয়ে নিরাপদে তাতারদের বেষ্টনী থেকে ফিরে আসেন এবং পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে বিস্তারিত পরিস্থিতি জানান। (৫)

এবার জোচির মোকাবিলায় খাওয়ারিজম শাহ নিজেই ময়দানে নেমে আসেন। তিনি বাহিনীর বেশিরভাগ অংশ সাইর নদীর তীরে রেখে নিজে একটি বাহিনী নিয়ে নদী অতিক্রম করেন। জোচিও তাঁর বাহিনী নিয়ে নদীর ওই পাড়ে অপেক্ষা করছিল। জোচির সভাসদরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল লড়াই না করে পিছু হটতে। জোচি জবাব দিয়েছিল—‘ময়দান থেকে পালিয়ে গেলে পিতাকে কী করে মুখ দেখাব?’ (৬) তবে সে সুলতান আলাউদ্দিনকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল। তাতে লিখা ছিল—‘আমরা এখানে যুদ্ধ করতে আসিনি। চেঙ্গিস খানও আমাদের যুদ্ধ করতে বলেননি। তবে তোমরা যুদ্ধ শুরু করলে আমরা পিছু হটব না।’
মূলত এই কথা বলে জোচি সুলতানকে অসতর্ক করতে চাচ্ছিল। জবাবে সুলতান আলাউদ্দিন লিখেছিলেন—‘চেঙ্গিস খান তোমাদের যুদ্ধ না করার আদেশ দিয়েছে; আর আল্লাহ আমাদের জিহাদ করার আদেশ দিয়েছেন।’(৭)

এরপর আর ফিরে আসার উপায় থাকে না। শুরু হয় তীব্র যুদ্ধ। খাওয়ারিজমের বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। প্রায় সবার সঙ্গেই বর্ম ছিল। অপরদিকে তাতারদের হাতে ছিল তির-ধনুক; আর পরনে পশুর চামড়ার আলখেল্লা। ফলে তাদের ব্যাপারে সুলতান আলাউদ্দিন ছিলেন বেশ নিশ্চিন্ত; আর এভাবেই নিজের বিপদ নিজে টেনে এনেছিলেন তিনি। প্রাচীন প্রবাদমতে, শত্রুকে খাটো করে দেখতে নেই; অথচ এই কাজটিই করেছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ।

যুদ্ধ শুরু হতেই সুলতান টের পেলেন তাতাররা সত্যিকারের লড়াকু। তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে খাওয়ারিজম বাহিনীর রক্ষণব্যুহ অতিক্রম করছিল, একই সঙ্গে সামনে যাকে পাচ্ছিল তাকে পাইকারিভাবে হত্যা করছিল। তাদের আঘাতের সামনে প্রশিক্ষিত খাওয়ারিজম বাহিনীকেও অসহায় মনে হচ্ছিল। একের পর এক আক্রমণে তাতাররা সুলতানের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে তোলে। এমনকি সুলতানের নিজের জীবনের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়। মনে হচ্ছিল তাতাররা শীঘ্রই সুলতানকে বন্দি করে ফেলবে।

এ সময় শাহজাদা জালালুদ্দিন বিদ্যুতবেগে একের পর এক আক্রমণ চালাতে থাকেন তাতারদের বাহিনীতে। তাঁর আক্রমণের সামনে তাতারদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারাও অসহায়বোধ করে। এমনকি তাতাররা একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে পেছাতে থাকে।(৮) ইতিমধ্যে রাত নেমে আসে। এ সময় দুই বাহিনী পিছু হটে নিজেদের শিবিরে ফিরে আসে। ইবনুল আসিরের মতে এই যুদ্ধ তিন দিন অব্যাহত ছিল। তবে জুয়াইনি ও অন্য ইতিহাসবিদদের মতে এই যুদ্ধ এক দিনেই সমাপ্ত হয়।(৯)

এই যুদ্ধে মুসলমান বাহিনীর প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় ২০ হাজার সেনা নিহত হয়। রাতের বেলা পুরো ময়দানে শুধু সেনাদের লাশ পড়ে ছিল। রক্তের গন্ধ বাতাসকে ভারী করে তুলেছিল। যদিও সেদিন যুদ্ধের কোনো নিষ্পত্তি হয়নি, তবু তাতাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা আর লড়বে না আপাতত। জোচির আদেশে তাঁবুগুলো সব আগের মতোই রাখা হয়। বাইরে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আগুন। সারা রাত খাওয়ারিজমের বাহিনী ভেবেছিল তাতাররা শিবিরে অবস্থান করছে; কিন্তু সকালে দেখা গেল তারা সবাই তাঁবু ফেলে রাতেই চলে গেছে।
তাদের এই পলায়নকে সুলতান আলাউদ্দিন নিজের বিজয় হিসেবে ধরে নিলেন। তিনি একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং অনেককে পুরস্কৃত করেন। (১০)

এ সময় চেঙ্গিস খান তাঁর মূল বাহিনী নিয়ে গ্রেট নর্থ রোড ধরে খাওয়ারিজমের পশ্চিম সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তীব্র তুষারপাত তাতারদের কষ্ট দিচ্ছিল; কিন্তু তারা সেসব সয়েই যাত্রা অব্যাহত রেখেছিল। বিস্তীর্ণ প্রান্তর অতিক্রম করে তাতাররা সাইর নদীর তীরে এসে পৌঁছায়। জায়গাটা ছিল আরাল সাগরের কাছাকাছি। (১১) কয়েকদিন পূর্বে সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ যেখানে জোচির বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, সেই অঞ্চল থেকে এটি ছিল বহু দূরে অবস্থিত।(১২)
এখানে জোচির পক্ষ থেকে চেঙ্গিস খানের কাছে দূত আসে। দূতের মাধ্যমে চেঙ্গিস খান সদ্য সংঘটিত যুদ্ধের কথা জানতে পারেন। তিনি জোচির সাহায্যে ৫ হাজার সেনার একটি বাহিনী পাঠান এবং তাকে নির্দেশ দেন খাওয়ারিজম শাহ সীমান্ত এলাকা থেকে সরা মাত্রই নদীর তীরবর্তী শহরগুলো ধ্বংস করে সমরকন্দের দিকে এগিয়ে যেতে।

এদিকে জোচির বাহিনী সরামাত্র খাওয়ারিজম শাহও সীমান্ত এলাকা থেকে সরে আসেন। তিনি সীমান্ত থেকে দূরে এসে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ভাবছিলেন। এই সময়ে শত্রুর গতিবিধি জানতে শক্তিশালী গোয়েন্দাবিভাগ দরকার ছিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে খাওয়ারিজম শাহের এমন কোনো গোয়েন্দাদল ছিল না। এমনকি তাঁর গোয়েন্দাদের মধ্যে কিছু ছিল তাতারদের চর, যা পরে প্রমাণিত হয়েছিল।

জোচির একজন সেনাপতি খেপ নয়ন ছোট একটি বাহিনী নিয়ে লুটতরাজ করতে করতে সমরকন্দের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সুলতান আলাউদ্দিন যখন এ সংবাদ পেলেন খেপ নয়ন তখন সমরকন্দ থেকে ২০০ মাইল দূরে অবস্থান করছিল। এই সংবাদ সুলতানকে আতংকিত করে তোলে। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্র ততক্ষণে ১ হাজার মাইল দীর্ঘ এলাকা জুড়ে বিস্তৃতিলাভ করেছিল। খেপ নয়নের বাহিনী সম্পর্কে সুলতানের সঠিক ধারণা ছিল না। তিনি ভেবেছিলেন এটি বড় বাহিনী, তাই আতংকিত হয়েছিলেন; অথচ পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে সুলতান জানতেন, এই বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য সমরকন্দের শক্ত প্রাচীরই যথেষ্ট।
সুলতান আলাউদ্দিন যুদ্ধসভার আয়োজন করলেন। এই সভায় উজির, সেনাপতি ও গুরুত্বপূর্ণ সভাসদরা উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় শাহজাদা জালালুদ্দিনের পরামর্শ ছিল খাওয়ারিজমের বাহিনীকে বিভক্ত না করে একত্র রাখা হোক এবং তাতারদের সঙ্গে একত্রে লড়া হোক। অভিজ্ঞ যোদ্ধা জালালুদ্দিনের এই পরামর্শ ছিল সামরিক দিক থেকে শতভাগ সঠিক; কিন্তু সুলতান আলাউদ্দিন পুত্রের পরামর্শ গ্রহণ করলেন না। তাঁর ইচ্ছা ছিল সেনাদের বিভক্ত করে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেবেন এবং কেল্লাবন্দি হয়ে তাতারদের মোকাবিলা করবেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে সুলতান আলাউদ্দিন তাঁর ২ লাখ সেনাকে পৃথক করেন এবং সাম্রাজ্যের নানা স্থানে তাদের ছড়িয়ে দেন।

ইতিহাসবিদ নাসাবি সুলতানের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সেনাদেরকে বিভক্ত করে ফেলা ছিল সুলতান আলাউদ্দিনের বড় একটা ভুল। তিনি যদি সেনাদের একত্রে রেখে কোনো ময়দানে তাতারদের বিরুদ্ধে লড়তেন, তাহলে চেঙ্গিস খানকে সহজেই পরাজিত করতে পারতেন।’(১৩)

সেনাদের বিভক্ত করে অবশিষ্ট ১ লাখ ১০ হাজার সেনা নিয়ে সুলতান আলাউদ্দিন রওনা হলের সমরকন্দের দিকে।(১৪) সুলতানের দৃষ্টিতে সে সময় সমরকন্দের সুরক্ষা ছিল সবচেয়ে জরুরি। কারণ, তিনি জেনেছিলেন খেপ নয়নের বাহিনী সমরকন্দের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। খেপ নয়নের কাজ ছিল সুলতানকে সমরকন্দের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া এবং এখানে তাকে ব্যস্ত রাখা। এই ফাঁকে চেঙ্গিস খান তাঁর মূল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল বুখারার দিকে, যে শহরকে সুরক্ষিত মনে করে সুলতান আলাউদ্দিন বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেননি। এদিকে জোচি তাঁর বাহিনী নিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রচণ্ড খুনখারাপি করতে করতে পিতার আদেশমতো এগিয়ে যাচ্ছিল।

এসবই ছিল ৬১৬ হিজরির ঘটনা, যখন মুসলিমবিশ্ব একই সময়ে দুদিক থেকে আক্রান্ত হয়েছিল। এ সময় চেঙ্গিস খান ধেয়ে এসেছিল পূর্ব থেকে, অপরদিকে ক্রুসেডাররা ধেয়ে এসছিল পশ্চিম দিক থেকে। মিসর ও সিরিয়ার সুলতান আল মালিকুল আদিলের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য তাঁর পুত্রদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। তারা জড়িয়ে পড়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে। তাদের এই দুর্বলতা দেখে আশান্বিত হয়ে ওঠে ক্রুসেডাররা। তারা আবারও বায়তুল মাকদিস দখলের স্বপ্ন দেখতে থাকে। ৬১৬ হিজরির ২৭ শাবান(১৫) চেঙ্গিস খান যখন বৈকাল হ্রদ ও বালকাশ হ্রদের মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থান করছিল, ঠিক সে সময় ইউরোপিয়ান ক্রুসেডাররা মুসলিমবিশ্বের পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে দিময়াত শহর দখল করে নেয়। এই শহরটি ছিল ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। সামরিক কৌশলের দিক থেকে শহরটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে একই সময়ে মুসলিমবিশ্ব দু-ধরনের আক্রমণের শিকার হলো।

ইতিহাসবিদ ইবনুল আসির এ সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন ব্যক্ত করেছেন এভাবে, ‘মুসলিমবিশ্ব তাতার ও ক্রুসেডারদের হামলার শিকার হলো। আল্লাহর রহমত না থাকলে ক্রুসেডাররা অল্পদিনেই সিরিয়া পর্যন্ত দখল করে নিত। এই দুই বিপদের চেয়েও বড় বিপদ ছিল যেসব এলাকার মুসলমানরা এই দুই শত্রুর হামলা থেকে নিরাপদ ছিল, তারা নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিল। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এখন আমরা আল্লাহর কাছে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সাহায্য ও বিজয়ের দুআ করছি।’(১৬)

তথ্যসূত্র
১। চেঙ্গিস খান, ভাসিলি ইয়ান, অনুবাদ অরুণ সোম : ১৩২,
২। চেঙ্গিস খান, হ্যারল্ড ল্যাম্ব, ১১১
৩। তাবাকাতে নাসিরি : ১/৩৬৭।
৪। ১৭ ডিসেম্বর, ১২১৯।
৫। তারিখুল ইসলাম, ৪৪/২৪০
৬। চেঙ্গিস খান, ১১৩
৭। সিরাতু জালালুদ্দিন, ৪৭
৮। তারিখে জাহাকুশা, ২/১০২
৯। তারিখে জাহাকুশা, ২/১০৪
১০। চেঙ্গিস খান, ১০৫
১১। আরাল সাগর মূলত একটি হ্রদ। বিশালাকৃতির কারনে এটিকে সাগর বলা হয়। উত্তর থেকে সাইর নদী এবং দক্ষিণ থেকে আমু দরিয়া এসে মিলিত হয়েছে এর সঙ্গে। এর অবস্থান কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তান জুড়ে। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে এটি ছিল বিশ্বের চতুর্থতম হ্রদ। বর্তমানে এর বেশিরভাগ অংশই শুকিয়ে গেছে। এটি এখন আরালকুম মরুভূমি নামে পরিচিত।
১২। হামদুল্লাহ কাজবিনির বর্ণনামতে, জোচির সঙ্গে সুলতান আলাউদ্দিনের লড়াই হয়েছিল কাশগড়ের সীমান্তবর্তী এলাকায়।
১৩। সিরাতু জালালুদ্দিন : ৯০/৯১।
১৪। রাওজাতুস সাফা : ৪/৮২৪।
১৫। ৭ নভেম্বর ১২১৯।
১৬। আল-কামিল ফিত-তারিখ , ৭/৫৭১

বই – সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ
মূল- ইসমাইল রেহান
পরিমার্জিত সংক্ষিপ্ত অনুবাদ – ইমরান রাইহান
প্রকাশক – কালান্তর প্রকাশনী

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন