দরসবাড়ি মাদরাসায় নেমে আসা সোনালি রোদ

আমবাগানের ভেতর দিয়ে একটা পায়ে হাটা পথ চলে গেছে । তালহা ভাই বললেন, মাদরাসাটা এদিকেই। আমরা বাগানের ভেতর ঢুকি। এখন আমের মৌসুম। প্রচুর আম ধরেছে। বাতাসে কেমন একটা অচেনা সুবাস। বাতাস স্থির হয়ে আছে। আজ খুব গরম পড়ছে, দরদর করে ঘামছি সবাই, ঘামের স্রোত গলা থেকে বুকের দিকে নেমে যায়, মনে হচ্ছে জামার ভেতর তেলাপোকা হাটছে। জায়গাটা নির্জন, আশপাশে বাড়িঘরও নেই, দূরে মাঠে একজন কৃষককে কাজ করতে দেখা যায়, তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় শালিক পাখি। একটু দূরে, গাছের ফাক দিয়ে একটা কাঠামো দেখা যায়, তালহা ভাইয়ের দিকে তাকাতেই তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি দেন। বুঝতে পারি ওটাই দরসবাড়ি মাদরাসার ধ্বংসাবশেষ। বুকের ভেতর একটা শিহরণ খেলা করে।

হেটে মাদরাসার সামনে চলে আসি। ছোট একটা লোহার গেট। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকি। চোখে পড়ে মাদরাসার বিশাল অবকাঠামো। ছবিতে অনেকবার দেখেছি, তবে সামনাসামনি এই প্রথম। রোদের তীব্রতায় চোখ মেলা কঠিন, আমরা হেটে মাদরাসার অবকাঠামোর ভেতর প্রবেশ করি। মাদরাসার গঠন বর্গাকৃতির। চারপাশে ছোট ছোট কক্ষ। কেমন আনমনা হয়ে যাই। আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, একদিন এখানে কোলাহল ছিল, হাদিসে রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শব্দাবলী উচ্চারিত হতো, আর আজ তা নীরব, নির্জন।

একটা কক্ষে প্রবেশ করি। কক্ষের প্রবেশমুখে সরু গলির মত। ভেতরে প্রশস্ত কক্ষ। ছাদ ক্ষয়ে গেছে অনেক আগেই, দেয়ালের উচ্চতাও নেমে এসেছে অর্ধেকে। ভেতরে ঘাস জন্মেছে। কল্পনার চোখে দেখি, কুপি জ্বালিয়ে এই কক্ষে কিতাব পড়ছে ছাত্ররা। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠে। কেমন ছিল এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সময়টা। এখানে কারা পড়তেন? কারা পড়াতেন?
আফসোস, এই মাদরাসা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য এখনো আমাদের হাতে আসেনি। এতটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠা হয়েছে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ)। এখন যদিও এ মাদরাসার অবস্থান চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনামসজিদ স্থালবন্দরের কাছে, কিন্তু সুলতানী আমলে এই মাদরাসা ছিল গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য আধুনিক গবেষকদের কারো কারো মতে এই মাদরাসা মূল শহরের বাইরে ছিল। উদ্ধারকৃত শিলালিপি থেকে জানা যায় এ মাদরাসার প্রতিষ্ঠা হয় ৯০৯ হিজরী তথা ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে।

শিলালিপিটির ভাষ্য নিম্মরুপ-
সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি আলিমদের আশ্রয়দানকারীদের সৌভাগ্য দান করেন, যারা তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করেন, তাদের অনুগ্রহ করেন, তাদের সম্মানকারীদের সম্মান দেন, এবং তাদের সাহায্যকারীদের উচ্চ মর্যাদা দেন। আল্লাহর রাসুলের প্রতি দরুদ যিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আলিমদের আশ্রয়দান করবে আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিন আশ্রয়দান করবেন এবং তার সহচর ও বংশধররা নিরাপদ মর্যাদা লাভ করবে। সুলতান আলাউদ্দিন আবুল মুজাফফর হোসেন শাহ বিন সাইয়েদ আশরাফ আল হুসেন ও তার বংশধরদের রাজত্ব আল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করুন। এই বৃহৎ ও মনোরম মাদরাসা তিনি ৯০৯ হিজরীতে প্রতিষ্ঠা করেন। (১)

এই মাদরাসার উস্তাদ শাগরেদদের বিষয়ে ইতিহাস নীরব। জানা যায়নি কত খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এখানে পঠন পাঠনের কাজ চলেছে? এখানের পাঠ্যক্রমই বা কী ছিল। বুকের ভেতর একটা কষ্ট দোলা দেয়। কত কত মাদরাসার ইতিহাস আমরা জানি, ছাত্র শিক্ষকদের জীবনি পড়ি, পাঠ্যক্রম সম্পর্কে জানি কিন্তু নিজের দেশের এই মাদরাসাটি সম্পর্কে কেউ আমাদের তেমন কিছু জানায়নি। আবদুল কাদের নাইমি দিমাশকির ‘আদ দারিস ফি তারিখিল মাদারিস’ গ্রন্থে অন্তত মাদরাসাটির কথা আসতে পারতো। যেহেতু লেখকের জীবদ্দশাতেই এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠা। সেখানে এই মাদরাসার উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই আবুল হাসানাত নদভীর ‘হিন্দুস্তান কি কদিম ইসলামী দরসগাহে’ গ্রন্থেও। অথচ সেখানে উল্লেখ আছে গিলানের এক মাদরাসার কথা, যার সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য মাদরাসার ভবন ছিল বৃহদাকার একটি অট্টালিকা। আর মাওলানা মানাজির আহসান গিলানী জানাচ্ছেন, বৃহদাকার সেই ভবনের অবস্থা। সেখানে একসাথে বিশজনের বেশি অবস্থান করার সুযোগ ছিল না। ‘আল হিন্দ ফি আহদিল ইসলামী’ গ্রন্থে আবদুল হাই হাসানি ভারতবর্ষের অনেক প্রাচীন মাদরাসার কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সেখানেও অনুপস্থিত দরসবাড়ি মাদরাসার কথা। গোলাম হুসেন সলিমের ‘রিয়াজুস সালাতিনে’ আলাউদ্দিন হুসেন শাহের শাসনামল সম্পর্কে আলোচনা থাকলেও, নেই এই মাদরাসা সম্পর্কে আলোচনা। এজন্য ইতিহাসের এক আকর্ষণীয় অধ্যায় আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে গেছে।

তবে ইতিহাসের নানা বিবরণ থেকে এই মাদরাসার পাঠ্যক্রম অনুমান করা যায়। আবুল ফজল ও অন্যান্যদের বিবরণ থেকে জানা যায়, বাংলার মাদরাসাসমূহে কোরআন, হাদিস, ধর্মতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতিবিদ্যা ইত্যাদী পড়ানো হতে। মানাজির আহসান গিলানী ও আবদুল হাই হাসানী নদভীর লেখা থেকে যেমনটা জানা যায়, সেসময় হাদিসের উচ্চতর পাঠ কেবল মাশারিকুল আনোয়ার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলার মাদরাসাসমূহে যুদ্ধবিদ্যার পাঠও দেয়া হতো। এখানে ‘হেদায়াতুর রমি’ নামে একটি পুস্তিকা পাঠ্য ছিল, যা তীরন্দাজি শেখানোর জন্য পড়ানো হত। মাদরাসা ও অন্যান্য স্থাপত্যের দেয়ালে যে ক্যালিগ্রাফি দেখা যায় তা থেকে অনুমান করা যায় ক্যালিগ্রাফি বা লিপিকলাও ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে মাদরাসায় পাঠ্য ছিল। (২)

‘ইমরান, এদিকে আসো’ আজমল ভাইয়ের কন্ঠ শুনে সম্বিত ফিরে পাই। আজমল ভাই, তালহা ভাই আর দাদা ইসহাক এক কোনে বসেছেন। আমি হাটতে হাটতে অনেকটা মাঝে চলে এসেছি। এখানে একটা কাঠামো দেখা যাচ্ছে। এটি সম্পর্কে গবেষকরা স্থির কোনো সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেননি। কারো মতে এটি ছিল লাইব্রেরী, কারো মতে হলরুম কিংবা জলাধার।
মাদরাসার কক্ষগুলো হেটে দেখা শেষ। সবগুলো একরকম। বড় অনাদরে পড়ে আছে। এসব কক্ষে বসেই ছাত্রদের কেউ কেউ মীর সাইয়েদ শরিফ জুরজানির মত দেয়ালের সাথে তাকরার করতো, ভাবতেই বিষণ্ণ লাগে।

আজমল ভাইয়েরা বসেছেন মাদরাসার উত্তর-পূর্ব কোনে। দেয়ালের উপর। পাশে একটা আমগাছ ঠায় দাঁড়িয়ে ছায়া দিচ্ছে। বসি, একটা শীতল বাতাস শরীর ছুয়ে যায়। এখান থেকে পুরো মাদরাসার কাঠামো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারপাশে মোট কক্ষের সংখ্যা ৪০ টি। কক্ষগুলো বর্গাকার। প্রতিপার্শ্বের পরিমাপ ৩ মিটার করে। মাদরাসার কাঠামোটিও বর্গাকার। প্রতিপার্শ্বের পরিমাপ ৫৫.৫০ মিটার। পশ্চিম পার্শ্বের কক্ষগুলোর সাথে তিনটি মেহরাব দেখা যায়। ওখানেই ছিল মাদরাসার মসজিদ। কালের আবর্তনে মাদরাসাটি হাড়িয়ে গিয়েছিল মাটির নিচে। ১৯৭৩-৭৫ খ্রিস্টাব্দে মাটি খনন করে এই মাদরাসা আবিস্কার করা হয়।

রোদের তেজ কমে গেছে। গাছের ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। আমরা চুপচাপ বসে আছি। কারো মুখে রা নেই।
‘এবার মনে হয় উঠা যায়’ অনেকক্ষণ পর তালহা ভাই মুখ খোলেন।
‘চলেন’ আজমল ভাই সায় দেন।
আমরা উঠে দাড়াই। শেষবারের মত মাদরাসার দিকে ফিরে তাকাই। মাদরাসার কাঠামো দেখে বুকের ভেতর শূন্যতা জাগে।
আমবাগানের ভেতর দিয়ে আসার সময় ভাবি, কোনো একদিন হয়তো খোদা বক্স লাইব্রেরী কিংবা এশিয়াটিক সোসাইটির বইয়ের তাকে খুজে পাওয়া যাবে প্রাচীন কোনো পান্ডুলিপি, যেখানে মিলবে এই মাদরাসার সবিস্তার ইতিহাস।
যাতায়াত
ঢাকা থেকে বাসে চাপাইনবাবগঞ্জ শহর। চাপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে বাস, সি এন জি বা অটোরিক্সায় ছোট সোনা মসজিদ। ছোট সোনা মসজিদ থেকে ভ্যান বা রিকসায় দরসবাড়ি মাদরাসা।

———-
১। সুলতানী আমলে বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার উতপত্তি ও বিকাশ, পৃষ্ঠা ২৯- আবদুল করিম। ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
২। বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ১ম খন্ড, ১৪৬-১৪৯ পৃষ্ঠা– ড এম এ রহিম। বাংলা একাডেমী।

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন