মাওলানা আহমাদুল্লাহ শাহ

২১ নভেম্বর, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ।

লখনৌর বিখ্যাত পত্রিকা তিলসামে একটি সংবাদ ছাপা হয়। সংবাদটি অনেকেরই চোখ এড়িয়ে যায়। সংবাদটির ভাষ্য ছিল, সম্প্রতি এখানে আহমাদুল্লাহ শাহ নামে এক ব্যক্তির তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। তার পোষাক দরিদ্র সুফীদের মত, কিন্তু চলাফেরা সম্ভ্রান্ত আমীরদের মত। তিনি মুতামিদ্দৌলার সরাইয়ের পাশে অবস্থান করেন। স্থানীয়দের মাঝে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। সপ্তাহে দুয়েকদিন তার আস্তানায় মানুষের বেশ সমাগম হয়। তার মজলিসগুলোও সাধারণ মজলিসের মত হয় না। সেখানে খানিকটা অস্বাভাবিকতার ছাপ দেখা যায়।

আপাতদৃষ্টিতে তিলসামে প্রকাশিত সংবাদটি সাধারণ সংবাদ। একজন নিরীহ সুফির পাশে লোকজন ভীড় করছে, বিশাল ভারতভূমিতে এটি সবযুগেই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু লখনৌর ঘটনা কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এর কিছুদিন আগেই লখনৌর শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর নবাবী কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এ নিয়ে জনমানুষের মনে জমে ছিল অসন্তোষ। সম্ভাবনা ছিল যে কোনো সময় এখানকার স্থানীয়রা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে পারে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়। স্থানীয় পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয় আহমাদুল্লাহ শাহকে নজরে রাখতে ।

কে এই আহমাদুল্লাহ শাহ?

এক নজরে তার পরিচয় জেনে নেয়া যাক। মাওলানা আহমাদুল্লাহ শাহর জন্ম মাদরাজে, ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে৷ স্থানীয় আলেমদের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হয়। এসময় তিনি আরবী, উর্দু, ফার্সী ও ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন৷ কিছুকাল তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। অল্পসময়েই তিনি সমরবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন।

তারুণ্যের প্রথমদিকে কয়েকবার মারাঠা ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং সাহসিকতার প্রমাণ দেন। কিছুদিন হায়দারাবাদ অবস্থান করেন৷ পরে ইংল্যান্ড সফর করেন৷ ফেরার পথে হজ্ব আদায় করেন। এসময় তিনি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করে সেখানকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন। তার এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে কাজে এসেছিল।

দেশে ফিরে তিনি রাজস্থানের বিখ্যাত বুজুর্গ সাইয়েদ ফরমান আলী শাহর মুরিদ হন৷ পীরের নির্দেশ ছিল গোয়ালিয়র যেতে হবে৷ মাওলানা আহমাদুল্লাহ শাহ গোয়ালিয়র চলে যান। ফরমান আলি শাহর ইন্তেকালের পর তিনি সাইয়েদ মেহরাব আলির মুরিদ হন৷ সাইয়েদ মেহরাব আলী ছিলেন বালাকোটের অমর যোদ্ধা সাইয়েদ আহমদ শহীদের সোহবত ধন্য৷ বুকের ভেতর লালন করতেন জিহাদের জযবা ও শাহাদাত লাভের অদম্য আগ্রহ।

নিজের মুরিদদের তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করতেন। সাইয়েদ মেহরাব আলী বুকের ভেতর যে অগ্নিশিখা লালন করতেন, তা তিনি আহমাদুল্লাহ শাহর মধ্যেও সঞ্চার করেন। আহমাদুল্লাহ শাহ প্রচন্ড প্রভাবিত হন। সেই থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জিহাদই হয়ে উঠেছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান।

গোয়ালিয়র থেকে আহমাদুল্লাহ শাহ আগ্রা চলে যান। এখানে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন মাহফিলে উপস্থিত হতেন৷ জনসাধারণকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। প্রতি সোমবার লোকজনকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতেন৷ একজন সুফী হিসেবে খানকাহর অন্ধকার কোনে বসে থাকাটাই তার জন্য স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আহমাদুল্লাহ শাহ বেছে নিয়েছিলেন অন্য পথ। ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করাকেই বানিয়েছেন নিজের জীবনের মাকসাদ।

শীঘ্রই আহমাদুল্লাহ শাহ ইংরেজদের নজরদারীর শিকার হন। তিনি এবার লখনৌ চলে যান। সে সময় লখনৌর সদরুস সুদুর ছিলেন মাওলানা ফজলে হক খাইরাবাদী৷ তিনি ছিলেন ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতিশীল ৷ যারা ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ করছিল, তাদের তিনি ভালো চোখে দেখতেন না। মাওলানা আহমাদুল্লাহ শাহর সাথে ফজলে হক খাইরাবাদীর বেশকবার সাক্ষাত ও দীর্ঘ আলোচনা হয়। এই সাক্ষাতগুলোর প্রভাব ছিল দীর্ঘমেয়াদী।

অল্পকদিন পরেই ফজলে হক খাইরাবাদী দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন এবং লখনৌ ত্যাগ করেন৷ তিনি তার আগের দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে লোকজনকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এই ফজলে হক খাইরাবাদিই পরে আন্দামানের কারাগারে বন্দী হন এবং কাফনের কাপড়ে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের ইতিহাস লিখে খ্যাতি অর্জন করেন।

লখনৌতে আহমাদুল্লাহ শাহর দাওয়াতি কার্যক্রম সহজ ছিল না। প্রথমদিকে বেশিরভাগ লোকজন তার জিহাদের দাওয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের কথা ছিল শাসকের নির্দেশ ব্যতিত জিহাদ করা যাবে না। পরে অবস্থার উন্নতি হয়। ধীরে ধীরে তার পাশে লোকজন জমা হতে থাকে। এসময়ই তাকে নিয়ে তিলসামের সংবাদটি প্রকাশিত হয়। মাওলানা নজরবন্দীর শিকার হন। তিনি লখনৌ থেকে ফয়জাবাদ চলে আসেন। এখানে দুদিন অবস্থান করার পর স্থানীয় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে।

আহমাদুল্লাহ শাহ কারাগারে থাকতেই ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। অল্পসময়ের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন মিরাঠ, দিল্লী, বেরেলি, শাহজাহানপুর, ও বাদায়ুন হয়ে লখনৌ এবং ফয়জাবাদেও ছড়িয়ে পড়ে। ফয়জাবাদে বিদ্রোহ শুরু হতেই আহমাদুল্লাহ শাহকে কারাগার থেকে মুক্ত করা হয়। আহমাদুল্লাহ শাহ লখনৌ চলে আসেন। ফেরার পথে ৩০ জুন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বাহিনীর সাথে সিপাহীদের প্রচন্ড লড়াই হয়। এই যুদ্ধে আহমাদুল্লাহ শাহ আহত হন।

লখনৌতে বিপ্লবী সরকার গঠন করা হয়। নবাব ওয়াজিদ আলির আমিররা এখানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেলেও আহমাদুল্লাহ শাহকে কোনো পদ দেয়া হয়নি। এমনকি তার ব্যাপারে নবাব হজরত মহলের মন বিষিয়ে তোলা হয়। চাটুকাররা বলতে থাকে, আহমাদুল্লাহ শাহ শক্তিশালী হলে নিজেকেই শাসকের আসনে বসাবে। নতুন সরকারের সাথে আহমাদুল্লাহ শাহর দুরত্ব বাড়তে থাকে। এমনকি ইংরেজদের সাথে লড়াইয়েও সরকার তাকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকে।

আহমাদুল্লাহ শাহ ষড়যন্ত্র ও হিংসার শিকার হন। যথাসময়ে সাহায্য না পেয়ে কয়েকটি লড়াইয়ে তিনি পরাজিত হন। ইংরেজরা লখনৌর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আহমাদুল্লাহ শাহ খুব অসুস্থ হন। এসময়ও তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ অব্যাহত রাখেন। এসময় তিনি খোলা ময়দানে লড়াই করার চেয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে হামলা করা অগ্রাধিকার দেন। বারি নামক এলাকার নদীর পাশে তিনি তার ক্যাম্প স্থাপন করেন। এই এলাকা ছিল লখনৌ থেকে ২০ মাইল দূরে। এখান থেকে তিনি হামলা চালাতেন।

কিন্তু ততদিনে তার দলে ইংরেজদের গোয়েন্দা ঢুকে গেছে। ফলে তার বেশিরভাগ হামলার খবর ইংরেজরা আগেই জেনে যেত। আহমাদুল্লাহর শাহর কাছে আধুনিক অস্থ খুব কম ছিল। তার বেশিরভাগ যোদ্ধা তরবারী দিয়েই লড়াই করতো। তিনি দুয়েক জায়গায় অস্ত্র সাহায্য চেয়ে পত্র লিখলেও সাড়া পাননি।

এদিকে আহমাদুল্লাহ শাহর সংগ্রামের কাহিনী অন্যান্য এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মুজাহিদদের একটি অংশ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। মে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে, আহমাদুল্লাহ শাহর অসুস্থতা ততদিনে আরো বেড়েছে, অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি শাহজাহানপুরের একটি ইংরেজ ক্যাম্পে হামলা চালান।

ইংরেজ সরকার মাওলানার মাথার মূল্য ৫০ হাজার রৌপ্যমুদ্রা ঘোষণা করে। জুনের প্রথমদিকে পুবায়নের রাজা জঘন্নাথ সিং মাওলানার কাছে লিখিত একটি পত্রে বলেন, আপনি আমার এখানে আসুন। আপনার সাথে মিলে ইংরেজদের মোকাবেলা করতে যাই।

মাওলানা তার অল্পকিছু যোদ্ধাসহ ৫ জুন পায়াওয়ানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পুবায়ন পৌছে তিনি অবাক হন। শহরের কেল্লার ফটক বন্ধ। দীর্ঘক্ষন পর রাজা জঘন্নাথ সিং তার ভাইসহ আসে। আলাপ চলাকালে আচমকা জঘন্নাথ সিং এর ভাই মাওলানার বুক বরাবর গুলি চালালে মাওলানা হাতির পিঠেই শহীদ হয়ে যান। মূলত গোটা ব্যাপারটিই ছিল সাজানো নাটক। মাওলানার মাথা কেটে ইংরেজ অফিসারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

পরদিন সকালে মাওলানার কর্তিত মস্তক শহরের কোতোয়ালি দরজার উপর লটকে থাকতে দেখা গেল। মাওলানা আহমাদুল্লাহ শাহ ছিলেন আউধের মানুষের শেষ ভরসা। তার ইন্তেকালের পর ইংরেজদের বাধা দেয়ার মত আর কেউ রইলো না।

তার সম্পর্কে ইংরেজ গবেষক টি এইচ হাচিনসন লিখেছেন, সিপাহী বিদ্রোহের এই নায়ক বিদ্রোহ শুরুর আগেই ভারতের বেশিরভাগ এলাকা ঘুরেছেন। এসব অঞ্চলে তার প্রচুর ভক্ত ছিল। তাদের তিনি জিহাদের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। এভাবেই তিনি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন।

সূত্র
————————-
১। আঠঠারা সো সাত্তাওয়ান তারিখি, ইলমি আওর আদাবি পাহলু– মুহাম্মদ আকরাম চুগতাই
২। আঠঠারা সো সাত্তাওয়ান কে রাহনুমা — কওমি কাউন্সিল, নয়া দিল্লী।

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন