মুসা বিন আবী গাসসান

১৪৯১ খ্রিস্টাব্দ।

তৃতীয়বারের মতো গ্রানাডা অবরোধ করেছেন ক্যাস্টোলার শাসক পঞ্চম ফার্ডিন্যান্ড। শেষবারের মত অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে নামলো গ্রানাডাবাসী। তরুণরা সিদ্ধান্ত নিলো শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত তারা খ্রিস্টানবাহিনীর মোকাবিলা করবে। এই সময়ে তরুণদের নেতৃত্বে ছিলেন মুসা বিন আবী গাসসান। তিনি দীপ্তকন্ঠে ঘোষণা দেন, খ্রিস্টান সম্রাট জেনে রাখুক, আরবদের জন্মই হয়েছে বর্ষা নিক্ষেপ ও ঘোড়ায় আরোহণের জন্য। শত্রুদের বিলাসবহুল প্রাসাদে অবস্থান করার চেয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ করে গ্রানাডার কোনো ভগ্নদেয়ালের নিচে নিজের কবর নির্ধারণ করা আমার কাছে অধিক প্রিয়। (১)

শুরু হলো যুবকদের প্রতিরোধ। আল হামরা প্রাসাদে বসে ইতিপূর্বে করা নিজের ভুলের মাশুল দিচ্ছিলেন দূর্বল শাসক সুলতান আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনুল আহমার আস সগির।

টানা সাত মাস যুবকদের সাথে খ্রিস্টানবাহিনীর লড়াই চলতে থাকে। ফার্ডিন্যান্ডের বাহিনী গ্রানাডার বাইরে থাকা গ্রামগুলোর উপর হামলা করে সবকটি গ্রাম দখল করে নেয়। শুধু ফাখখার গ্রামটি তখনো তারা দখল করতে পারেনি। এই গ্রামের দখলকে কেন্দ্র করে মুসলিমবাহিনীর সাথে তাদের বেশ কয়েকটি লড়াই হয়। খ্রিস্টানদের অনেক সেনা নিহত হয়। তবু তারা গ্রামটির দখল নিতে পারছিল না। মুসলমানরা প্রায়ই খ্রিস্টান শিবিরে গেরিলা হামলা চালাতো।

অবরোধ ও প্রতিরোধ দীর্ঘ হয়ে উঠে। মুসলমানদের সেনাসংখ্যাও কমতে থাকে। শীতের শুরুতে তীব্র তুষারপাত হয়। বন্ধ হয়ে যায় বাশারাহগামী সড়ক। ফলে বাহির থেকে গ্রানাডায় রসদ আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। বেড়া যায় দ্রব্যমূল্য ও ভিক্ষাবৃত্তি।

আবু আবদুল্লাহ ক্রমেই নিজের ও নিজ পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠছিলেন। তিনি আত্মসমর্পনে আগ্রহী ছিলেন কিন্তু জনরোষের কথা ভেবে চুপ ছিলেন। অবরোধের শুরুতেই সুলতান এবং তার আমীরদের অনেকে নিজ মালিকানার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

গ্রানাডার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। শহরের বিশিষ্ট নাগরিকদের একাংশ সুলতানের সাথে দেখা করে তাকে আত্মসমর্পণ করার অনুরোধ জানান। সুলতান এমন কিছুর অপেক্ষায়ই ছিলেন। তিনি দ্রুত আমিরদের পাঠালেন ফার্ডিন্যান্ডের কাছে। দ্রুত উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়ে যায়। মাক্কারীর বর্ননা মতে, এই সমঝোতা-চুক্তিতে মোট ৬৭টি শর্ত ছিল। চুক্তির ধারাগুলো ছিল চমকপ্রদ। যেমন, খ্রিস্টানরা মুসলমানদের মসজিদে প্রবেশ করবে না। মুসলমানদের আদালত ও বিচারকার্য শরিয়াহ অনুসারেই হবে (২), কোনো মুসলমানকে ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হবে না, মুসলমানদের সম্পত্তির মালিকানা তাদের হাতেই থাকবে, কোনো খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে কোনো বাধা দেয়া হবে না। কোনো মুসলমান খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে আদালতের মাধ্যমে তার ফায়সালা হবে। তদন্ত করা হবে তাকে কেউ চাপ দিয়েছে কিনা। (৩)

চুক্তি হয়ে গেল।

এই সংবাদ পেয়ে আল হামরা প্রাসাদে উপস্থিত হলেন মুসা বিন আবী গাসসান। সুলতান ও তার আমিরদের লক্ষ্য করে তিনি বললেন, আপনারা কি নারী শিশুদের জন্য কান্না রেখে যাচ্ছেন? আমরা পুরুষ, আমাদের রয়েছে অন্তর, যা অশ্রু প্রবাহের জন্য নয়, বরং রক্ত প্রবাহিত করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। হায়, গ্রানাডার সম্ভ্রান্তরা আজ প্রতিরোধযুদ্ধে যেতে ভয় পাচ্ছে।

এই বলে মুসা থামলেন। দরবারে পিনপতন নীরবতা। মুসা আবার কথা শুরু করেন, আপনারা নিজেকে নিজে ধোঁকা দিবেন না। খ্রিস্টানরা কখনোই তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে না। আপনারা তার মহত্ত্বের প্রতি আস্থা রাখবেন না। সামনে যে দিনের আশংকা আমি করছি তার চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ বিষয়। এই নগরীতে নেমে আসবে ধবংস, লুন্ঠিত হবে আমাদের বসতবাড়ি, সম্ভ্রম হারাবে আমাদের নারীরা। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বন্দীশালা, চাবুক ও জিঞ্জির। আজ যারা সৌভাগ্যের মৃত্যুকে ভয় করছে, শীঘ্রই তারা এসব নির্যাতনের মুখোমুখি হবে। আল্লাহর কসম, আমি কখনোই এসব প্রত্যক্ষ করবো না। (৪)

এই বলে মুসা বিন আবী গাসসান দরবার ত্যাগ করেন। তিনি বাড়িতে যান এবং অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বেরিয়ে আসেন। এরপর তিনি পনেরোজন খ্রিস্টান সেনার একটি দলের সাথে লড়াই করতে থাকেন। অস্ত্রের আঘাতে তার শরীর টুকরো-টুকরো হয়ে যায়। (৫)

মুসা বিন আবী গাসসান যে আশংকা করেছিলেন , গ্রানাডার পতনের পর ঠিক তা-ই হয়েছিল। আন্দালুসের মুসলমানদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল নির্মম নির্যাতনের।

সূত্র
——————–
১। দাওলাতুল ইসলাম ফিল আন্দালুস, ৫ম খন্ড, ২৩৮ পৃষ্ঠা– মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইনান।
২। এখানে সাইয়েদ মানাজির আহসান গিলানী রহিমাহুল্লাহর একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। হিন্দুস্তান মে মুসলমানো কা নেজামে তালিম ও তরবিয়ত গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, পৃথিবীতে কিছুই নতুন নয়। সবকিছুই পুরনো কিছু থেকে কাটছাঁট ও ধার করা। চুক্তির এ অংশে ফার্ডিন্যান্ড যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, বর্তমানেও তা দেয়া হচ্ছে। সেকালে আবু আবদুল্লাহ ও গ্রানাডার মুসলমানরা তা বিশ্বাস করেছিল , একালে আমরা বিশ্বাস করছি। সেকালে ফার্ডিন্যান্ড এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি, একালেও কেউ তা করছে না। তবে বিশ্বাসের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিদিনই। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষাগ্রহণ করে না।
৩। নাফহুত তীব, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৫২৭– মাক্কারি।
৫। দাওলাতুল ইসলাম ফিল আন্দালুস, ৫ম খন্ড, ২৫৬ পৃষ্ঠা– মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইনান।

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন