খাওয়ারিজমের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত সমৃদ্ধ একটি শহরের নাম কোকন্দ। (১) সাইর নদীর তীরে অবস্থিত শহরটি বিখ্যাত ছিল এর নির্মল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও উর্বর ভূমির জন্য। সুজলা-সুফলা এই শহরে বিস্তৃত ফলের বাগান ও ফসলি জমির মাঝে মাথা উঁচু করে ছিল মসজিদের মিনার। কিছুদূর পর পর গড়ে উঠেছিল গ্রাম। পাহাড়ের ঢালে বিছিয়ে থাকা সবুজ ঘাসের ডগা নড়ে উঠত দখিনা বাতাসে। উপত্যকায় চড়ে বেড়াত পশুদের পাল। সন্ধ্যায় সূর্যের আলোয় লাল হয়ে যেত সাইর নদীর পানি, তখন দিনের কাজ শেষে ক্লান্ত মানুষ ফিরত ঘরে।
কোকন্দের শাসনকর্তা তৈমুর মালিক ছিলেন নিজের সাহসিকতা, প্রজ্ঞা ও সুশাসনের জন্য বিখ্যাত। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সুনামের অধিকারী। তাঁকে মনে করা হতো রুস্তম ও সোহরাবের মতো বীর।
সুলতান আলাউদ্দিন যখন নিজের বাহিনী নিয়ে তাতারদের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে ফিরে গেলেন তখন তৈমুর মালিক বুঝতে পারলেন শীঘ্রই সীমান্তবর্তী শহরগুলো তাতারদের আক্রমণের শিকার হবে। এ জন্য তিনি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজান। শহরের নিরাপত্তা জোরদার করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল তাঁর আশঙ্কা সত্য ছিল। ৫ হাজার তাতারসেনার একটি দল শহরটি অবরোধ করে। এটি ছিল জোচির বাহিনীর অগ্রবর্তী দল। জোচি তাঁর মূল বাহিনী নিয়ে পিছু পিছু আসছিল।(২) তৈমুর মালিকের কাছে মাত্র ১ হাজার সেনা ছিল। তিনি বেশ কিছু নৌকা সংগ্রহ করে তাঁর সেনাদের নিয়ে নদীর দুই মোহনার মাঝামাঝি অবস্থিত একটি দ্বীপে চলে এলেন। এখানে তিনি কেল্লাবন্দি হয়ে তাতারদের সঙ্গে যুদ্ধের অপেক্ষায় রইলেন। (৩)
কয়েকদিন পর জোচির নেতৃত্বে মূল বাহিনী এসে দেখল তৈমুর মালিক দ্বীপে কেল্লাবন্দি হয়ে আছেন। নদী পার হওয়ার জন্য তাতারদের কাছে কোনো নৌকা নেই। তৈমুর মালিক আগেই নৌকাগুলো সব নিজের দখলে নিয়ে এসেছিলেন। তাতারসেনারা দ্বীপের দিকে তির নিক্ষেপ করতে থাকে; কিন্তু দূরত্বের কারণে তিরগুলো দ্বীপে পৌঁছতে পারছিল না। যা পৌঁছতে পেরেছিল সেগুলোও গতি হারিয়ে দুর্বল হয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। জোচি মিনজানিক বসানোর আদেশ দেয়। তাতাররা দ্বীপের উদ্দেশ্যে একের পর এক পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে; কিন্তু পাথরগুলো লক্ষ্যবস্তুর অনেক বাইরে পানিতে পড়ছিল। এভাবে কয়েকদিন চলতে থাকে।
জোচির জন্য তৈমুর মালিক বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়ান। জোচি শহরটি কবজা করতে পারছিল না। এদিকে চেঙ্গিস খানের কড়া নির্দেশ ছিল কোনো শহর পরিপূর্ণ দখল না করে সামনে এগোনো যাবে না। তাতাররা নতুন এক ফন্দি বের করে ফেলে। এটি ছিল অভাবনীয় একটি কৌশল। তারা আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ বন্দি করে আনে। তারপর তাদের মাধ্যমে আশপাশের পাহাড় থেকে বড় বড় পাথর কুড়িয়ে আনে। এই পাথরগুলো তারা পানিতে নিক্ষেপ করতে থাকে। কয়েকদিন অনবরত পাথর ফেলার পর দেখা গেল পানির নিচ থেকে পাথরের একটি রাস্তা দৃশ্যমান হচ্ছে এবং ক্রমেই তা দ্বীপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
তৈমুর মালিক পরিস্থিতির ওপর সতর্ক নজর রাখছিলেন। তিনি নিজের বিপদ বুঝতে পেরে ১২টি নৌকাভরতি সেনা পাঠালেন তাতারদের দিকে। এই সেনারা তির নিক্ষেপ করে তাতারদের অনেককে হত্যা করে। কিন্তু এই হামলা সত্ত্বেও তাতারদের কাজ চলতে থাকে। তারা কৌশল পরিবর্তন করে পাথরের পরিবর্তে মিনজানিকের মাধ্যমে শহরের দিকে উত্তপ্ত তেল ও গন্ধক নিক্ষেপ করতে থাকে। এই আক্রমণের ফলে তৈমুর মালিকের সেনাদের বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয়। পরদিন মুসলিমবাহিনী আবার হামলা চালাতে থাকে। এভাবে হামলা-পালটা হামলা চলতে থাকে। প্রায় তিন মাস এই লড়াই স্থায়ী হয়। শেষে বিরক্ত জোচি তাঁর বাহিনীর বড় অংশ নিয়ে অবরোধ তুলে চলে যায়, রেখে যায় ক্ষুদ্র একটি বাহিনী।
তৈমুর মালিক প্রতিরোধ অব্যাহত রাখেন; কিন্তু তাতারদের নির্মিত রাস্তা ক্রমেই লম্বা হচ্ছিল। তৈমুর মালিক বুঝতে পেরেছিলেন সকল চেষ্টা সত্ত্বেও তাতারদের এই রাস্তা শীঘ্রই দ্বীপের কাছে পৌঁছে যাবে। তৈমুর মালিক শুরু থেকেই বুঝতে পারছিলেন তাতারদের তিনি পরাজিত করতে পারবেন না। তিনি চাচ্ছিলেন তাতারদের সময়ক্ষেপণ করতে, যাতে এই সময়ে সুলতান আলাউদ্দিন অন্যদিকে তাতারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন। প্রায় তিন মাস কেটে যাওয়ায় তৈমুর মালিক দেখলেন তাঁর উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়েছে। আর বেশি সময় অপেক্ষা করলে তাতাররা দ্বীপে পৌঁছে যায়। এই অবস্থায় দ্বীপ ত্যাগ করাই উত্তম। এক দিন মধ্যরাতে তৈমুর মালিক তাঁর সেনাদের নিয়ে নৌকায় করে দ্বীপ ত্যাগ করে। প্রায় ৭০টি নৌকায় করে তিনি ভাটির দিকে এগিয়ে যান। (৪)
তাতার প্রহরীরা সতর্ক ছিল। তৈমুর মালিকের সেনারা দ্বীপ ত্যাগ করতেই তারা টের পেয়ে যায়। তারা তীরের পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটাতে থাকে। তৈমুর মালিকের বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছিল নদীর ভেতর দিয়ে। আর তাতাররা ধাওয়া করছিল তীর ধরে। তৈমুর মালিক এমন পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি তীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখছিলেন, যেন তাতারদের তির মুসলিমবাহিনীকে আঘাত করতে না পারে। মাঝে মাঝে মুসলিম সেনাদের নৌকাগুলো আচমকা তীরের কাছাকাছি এসে তাতারদের ওপর হামলা করছিল। এভাবে ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার মধ্যদিয়ে কয়েকদিন কেটে গেল।
সামনে জুন্দ শহরে অপেক্ষা করছিল জোচির বাহিনী। ইতিমধ্যে তাঁর কাছে সংবাদ পৌঁছেছে নদীপথে তৈমুর মালিক এগিয়ে আসছেন। জুন্দ শহরের কাছে সাইর নদী ছিল অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। জোচি এখানে নদীর দুই পাশেই মিনজানিক বসিয়ে দেয়। অপেক্ষা করতে থাকে তৈমুর মালিকের আগমনের। তৈমুর মালিক নিজের দূরদৃষ্টি দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন জুন্দ শহরে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তিনি জুন্দ শহর থেকে একদিন দূরত্বে থাকতে রাতেরবেলা নিজের বাহিনীকে তীরে নামিয়ে দেন। এখান থেকে তিনি সমতল ভূমির দিকে যাত্রা শুরু করেন।
তৈমুর মালিকের সেনারা তীরে নেমেছে টের পেয়ে তাতাররা তাদের ধাওয়া করতে থাকে। তৈমুর মালিক নিজের সেনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজে অল্প কজন সেনাসহ পেছনে থাকেন। মূল বাহিনী সামনে এগিয়ে যায়। তৈমুর মালিক পেছন থেকে তাতারদের মোকাবিলা করতে থাকেন। তাঁর সঙ্গে থাকা অল্পকজন সেনা এই সময় শহিদ হয়ে যান। একপর্যায়ে তৈমুর মালিক একা হয়ে যান। তিনজন তাতারসেনা তাকে ধাওয়া করছিল। তৈমুর মালিক দেখলেন তাঁর কাছে তিনটি তির আছে। তিনি আচমকা ঘোড়া ঘুরিয়ে একজন তাতারের চোখ বরাবর তির নিক্ষেপ করেন। নির্ভুল নিশানায় তির তাতারের চোখে আঘাত হানে। তাতার চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তৈমুর মালিক অন্য দুই তাতারের দিকে তাকিয়ে বজ্রকণ্ঠে বলেন, ‘তোমাদের জন্য আরও দুটি তির আছে আমার কাছে। এই দুইটি তির নষ্ট করতে আমার খুব আফসোস হবে। সবচেয়ে ভালো হবে, তোমরা চলে যাও।’ ভয়ে কাঁপতে থাকা দুই তাতারসেনা সঙ্গে সঙ্গে উলটো ঘুরে পালিয়ে যায়। (৫)
কোকন্দের যুদ্ধে তৈমুর মালিকের এই বীরত্ব ও সাহসিকতার গল্প মুসলিম ও তাতার দুই দলের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। একজন বীর হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল তাঁর শত্রুরাও। মাত্র ১ হাজার সেনা নিয়ে তিনি ২০ হাজার তাতারকে তিন মাস আটকে রেখেছিলেন। এরপর তিনি এমনভাবে তাতারদের ঘেরাও থেকে অধিকাংশ সেনাকে বের করে আসেন, যা ছিল বাহ্যিকভাবে অসম্ভব।
তৈমুর মালিক আরগেঞ্চের পথ ধরেন। তখন পর্যন্ত এই শহরটি ছিল তাতার হামলা থেকে নিরাপদ। এখানে কিছুদিন অবস্থান করে তিনি জানবাজ সেনাদের একটি দল গঠন করে ফেলেন। এ সময় তিনি বেশকিছুদিন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান এবং তাতারদের ওপর বেশকিছু সফল গেরিলা হামলা চালান। (৬)
এই সময় সুলতান আলাউদ্দিন তাঁর বাহিনী নিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরছিলেন। তৈমুর মালিক সুলতানের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যান এবং শাহরাস্তানা নামক স্থানে তিনি সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। (৭)
তৈমুর মালিক কিছুদিন সুলতান আলাউদ্দিনের সঙ্গে বিভিন্ন জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। পরে বাকি জীবন তিনি জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহর সঙ্গে বিভিন্ন জিহাদে অংশগ্রহণ করে কাটান। (৮)
তথ্যসূত্র
১। এই শহরকে খোকন্দ এবং খুজন্দও বলা হতো। বর্তমানে এর অবস্থান তাজিকিস্তানে।
২। তারিখু মুখতাসারিদ দুওয়াল : ২৩১।
৩। রওজাতুস সাফা : ৫/২৮।
৪। তারিখে জাহাকুশা : ১/৮১।
৫। রওজাতুস সাফা : ৫/২৮; তারিখে জাহাকুশা : ১/৮২
৬। তারিখে জাহাকুশা : ১/৮৩
৭। তারিখে খাওয়ারিজম শাহি : ১০৫
৮। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি সুলতান জালালুদ্দিনের সঙ্গে বাগ নিলাবের বিখ্যাত যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বই – সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারেজম শাহ
মূল- ইসমাইল রেহান
পরিমার্জিত সংক্ষিপ্ত অনুবাদ – ইমরান রাইহান
প্রকাশক – কালান্তর প্রকাশনী