বই: হিন্দুস্তান কী কদীম ইসলামী দরসগাহে
লেখক: আবুল হাসানাত নদভী
প্রকাশক: দারুল মুসান্নেফিন, শিবলী একাডেমী, আজমগড়, ভারত।
প্রকাশকাল : ১৯২২
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামল নিয়ে উর্দু ফার্সিতে প্রচুর ইতিহাসগ্রন্থ লেখা হয়েছে। বরাবরের মতোই ইতিহাস রচয়িতাদের ঝোঁক ছিল রাজা বাদশাহদের যুদ্ধ, শিকার আর বিয়েশাদী ইত্যাদীর বর্ণনার দিকেই। ইবনে খালদুন ‘মুকাদ্দিমা’য় যে বিন্যাসের কথা বলেছেন তা ছিলো অনুপস্থিত। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাই আফসোস করে বলেছেন ‘দিল্লীর উপকন্ঠে খেলারত বালকদের কথা ইতিহাস বইতে আছে কিন্তু আলায়ী ও সার্মাদ অনুপস্থিত’ (দ্রষ্টব্য : গুবারে খাতির)
বিশ্বের অন্য যেকোনো ভূখন্ডের মতো ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকরাও সচেষ্ট ছিলেন ইলমের প্রচার প্রসারে। তারা প্রচুর মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে ওয়াকফ নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু এসবের বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে স্বতন্ত্র কোনো বই রচিত হয় নি। ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে দায়সারা ভাবে কিছু আলোচনা আছে যার পরিমান খুবই সামান্য। সম্ভবত এ কারনেই প্রথম দিকে আল্লামা শিবলী নোমানী মনে করতেন ভারতবর্ষে মাদ্রাসার কোনো আলাদা কাঠামো ছিল না। পরে অবশ্য তিনি এ নক্তব্য থেকে সরে এসেছিলেন।
এই শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে মানাজির আহসান গিলানী ‘হিন্দুস্তান মে মুসলমানো কা নিজামে তালিম ও তরবিয়ত’ রচনা করেছেন যাতে ভারতবর্ষে মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেখানে মাদরাসাগুলোর পরিচিতি বিশদভাবে উঠে আসে নি।
কেমন ছিল সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো?? কারা ছিলেন সেখানে উস্তাদ?? কারা ছিলেন ছাত্র?? কী ছিলো সেখানের পাঠ্যক্রম?? সেই প্রতিষ্ঠানগুলো কি এখনো টিকে আছে নাকি অনেক আগেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে??
এসব প্রশ্ন ইতিহাসের সচেতন পাঠককে ভাবায়। কিন্তু এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কোনো ইতিহাসগ্রন্থ রচিত হয় নি।
আগ্রহী পাঠকের এসব প্রশ্নের জবাব নিয়েই উপস্থিত ‘হিদুস্তান কী কদীম ইসলামী দরসগাহে’। লেখক আবুল হাসানাত নদভী। যিনি আল্লামা শিবলী নোমানী ও সাইয়েদ সোলাইমান নদভীর স্নেহধন্য। বিদগ্ধ লেখক প্রচুর পরিশ্রম করে ভারতবর্ষের প্রাচীন মাদরাসাগুলো সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। সাহায্য নিয়েছেন উর্দু, ফার্সি ইতিহাসগ্রন্থের। ভ্রমন করেছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল।নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের সাথে। যেমন ঢাকার হাকিম হাবিবুর রহমানের সাথে তার পত্রালাপ ছিল।
হিন্দুস্তান কী কদীম ইসলামী দরসগাহে বইয়ের প্রথম সংস্করণ
সর্বশেষ সংস্করণ
এই বইতে লেখক বিবরণ দিয়েছেন প্রাচীন অনেক মাদরাসার। আলোচনা করেছেন সেখানকার উস্তাদ, ছাত্র ও পাঠ্যক্রম নিয়ে। আলোচনার শুরু সুলতান মাহমুদ গজনভীর সময়কাল থেকে। লেখকের আলোচনা এগিয়েছে বিভিন্ন শহরকে কেন্দ্র করে। একে একে আলোচনা করেছেন দিল্লী, সহেলি, লখনৌ, বিহার, আজমগড়, লাহোর, পাটনা, জৌনপুর, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিনাত্য, বালাগ্রাম ও অন্যান্য এলাকার। বিভিন্ন মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, প্রতিষ্ঠাকাল ও ছাত্র উস্তাদদের আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি তিনি বিবরণ দিয়েছেন এসব মাদরাসার পাঠ্যক্রম ও সমকালীন জনজীবনে এসব মাদ্রাসার প্রভাব।
লেখক ঢাকা শহরের প্রাচীন কয়েকটি মাদরাসার বর্ণনাও দিয়েছেন। বইটি থেকে আলোচনা তুলে দিচ্ছি:
১. শায়েস্তা খাঁর অসমাপ্ত কেল্লা (লালবাগ কেল্লা) থেকে দুই ফার্লং দূরে খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ। চমৎকার এই মসজীদটি দোতলা। সামনে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। নিচতলায় ছিল মাদরাসা। ছাত্রদের থাকার জন্য অনেকগুলো কক্ষ ছিল, যা এখনো টিকে আছে।
(বি:দ্র: মুনতাসির মামুন তার ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির’ নগরী বইতে এই মসজিদের আলোচনা করেছেন।
তবে সেখানে মাদ্রাসার কথা নেই।)
২. শায়েস্তা খান বুড়িগঙ্গার তীরে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মান করেন। মাদ্রাসাটি ১৮৫০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিলো। ঢাকার বিখ্যাত বুজুর্গ শাহ নুরী র., যিনি ঢাকা শহর থেকে প্রায় চার মাইল দূরে মগবাজার নামক গ্রামে থাকতেন, তিনি ‘কিবরিয়্যাতে আহমার’ নামক কিতাবে লিখেছেন তিনি প্রতিদিন নিজ গ্রাম থেকে হেটে এই মাদরাসায় যেতেন।
বইটি পড়লে বুঝা যায় লেখক কী পরিমান পরিশ্রম করে বইটি লিখেছেন। ওয়াকিয়া নবিশদের লিখনী আর সম্রাটদের যুদ্ধযাত্রার বিবরণের মাঝে চাপা পরা এইসব মাদ্রাসার ইতিহাস তুলে আনা সত্যিই কঠিন ও সময়সাপেক্ষ কাজ। একটু উদাহরণ দেই। ‘তারীখে ফিরোজশাহি’তে ফিরোজশাহ প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত মাদ্রাসাটির আলোচনা আছে ফিরোজশাহের জীবনির পঞ্চম অধ্যায়ে। যদিও সেখানে এই মাদ্রাসার আলোচনা এসেছে ফিরোজশাহের আমলে নির্মিত বিভিন্ন ইমারতের সৌন্দর্যের বর্ননা হিসেবে। সেখানে ফিরোজশাহ নির্মিত এই মাদ্রাসাটির বিবরণ পাওয়া গেলেও অন্যান্য শহরে ফিরোজশাহ কর্তৃক নির্মিত মাদ্রাসার আলোচনা নেই। সেজন্য লেখককে দারস্থ হতে হয়েছে অন্যান্য ইতিহাসগ্রন্থের। বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ ছেকে মাদ্রাসার ইতিহাস তুলে আনার এই কঠিন কাজটিই লেখক করেছেন।
তবে মনে রাখতে হবে এটি লেখকের অনুসন্ধানে পাওয়া মাদ্রাসাসমূহের বর্ননা এবং এটি পূর্ণাংগ তালিকা নয়। । এই তালিকার বাইরেও অনেক মাদ্রাসা ছিল। যেমন লেখক বাংলার মাদ্রাসাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করলেও সেখানে সোনারগায়ে প্রতিষ্ঠিত শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার মাদ্রাসার আলোচনা নেই। বিশুদ্ধ মত অনুসারে বাংলায় এই মাদ্রাসাতেই প্রথম সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসগ্রন্থের পাঠদান শুরু হয়। ইবনে বতুতা এই মাদ্রাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই মাদ্রাসার আলোচনা না থাকা খানিকটা আশ্চর্যকর। ভারতবর্ষের মাদ্রাসাগুলো নিয়ে আব্দুস সালাম নদভীর একটি প্রবন্ধ আছে ‘তালীম কী তরক্কী’ নামে, যা প্রথমে মাসিক মা’আরিফে ছাপা হয়। পরে এটি ‘ হিন্দুস্তান কে মুসলমান হুকুমরানো কে আহদ কে তামাদ্দুনি কারনামে’ বইতে সংকলিত হয়। সেখানেও এই মাদ্রাসার আলোচনা নেই। কারণ তিনি মূলত আবুল হাসানাত নদভীর লেখা থেকেই বেশীরভাগ তথ্য নিয়েছেন। ভারতবর্ষের মাদ্রাসাগুলো সম্পর্কে আরেকটি আলোচনা পাওয়া যায় বিস্ময়কর লেখক আব্দুল হাই হাসানির ‘আল হিন্দ ফি আহদিল ইসলামী’ গ্রন্থে। সেখানে বেশকিছু ক্ষেত্রে তিনি আবু হাসানাত নদভীর চেয়েও বেশী আলোচনা করেছেন। যেমন আবুল হাসানাত নদভী আগ্রা, পাঞ্জাব ও রোহিলাখন্ডের মাদ্রাসার আলোচনা করেন নি। আব্দুল হাই হাসানি করেছেন। সেই বইতে বাংলার মাদ্রাসার জন্য আলাদা শিরোনাম থাকলেও সোনারগায়ের সেই মাদ্রাসা অনুপস্থিত। যদিও লেখকের (আব্দুল হাই হাসানি) বিস্ময়কর গ্রন্থ ‘নুজহাতুল খাওয়াতিরে’ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার জীবনি আলোচনা করা হয়েছে। এই মাদ্রাসার আলোচনা আছে , বিখ্যাত দরবেশ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানির পত্রাবলী এবং মানাকিবুল আসফিয়া, এম এ রহিমের লেখা বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ড. কে এম আইয়ুবের হিস্ট্রি অব ট্রাডিশনাল ইসলামিক এডুকেশন ইন বাংলাদেশ ইত্যাদী গ্রন্থে।
বাংলার আরো দুটি বিখ্যাত মাদ্রাসা ছিল আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে নির্মিত দরসবাড়ি মাদ্রাসা এবং নওগায় প্রতিষ্ঠিত তকিউদ্দিন আরাবীর মাদ্রাসা। এই বইতে এই মাদ্রাসাগুলোর আলোচনাও আসে নি।
বইয়ের শেষে লেখক আব্দুল হাই হাসানির একটি প্রবন্ধ সংযুক্ত করেছেন, যা ভারতবর্ষে মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমের ইতিহাস নিয়ে লেখা। মূল প্রবন্ধটি আব্দুল হাই হাসানির আস সাকাফাতুল ইসলামিয়া ফিল হিন্দ বইতে আছে।
ভারতবর্ষের প্রাচীন মাদ্রাসা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী পাঠকের জন্য হিন্দুস্তান কী কদীম ইসলামী দরসগাহে বইটি এক অসামান্য উপহার, সন্দেহ নেই।