মসুলে একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আবুল কাসেম জাফর বিন হামদান মোসুলি (মৃত্যু ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী। তার লাইব্রেরীতে দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত প্রচুর বই ছিল। লাইব্রেরী প্রতিদিন খোলা হতো।
দূর থেকে আসা লোকদের জন্য ছিল থাকার ব্যবস্থা। একটা নির্দিষ্ট স্থান ছিল, যেখানে আবুল কাসেম জাফর ইমলার দরস দিতেন তার লিখিত বইপত্র (যেমন আল বাহের ফিল আখবার) , ফিকহ, কবিতা ও ইতিহাসের ঘটনাবলী থেকে।
শুধু আবুল কাসেম জাফরই নন, এমন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুসলিম শাসক, আমীর ও আলেম-উলামাদের অনেকেই। আব্বাসী খলিফারা বাগদাদে, উমাইয়া খলীফারা আন্দালুসে এবং ফাতেমীরা মিশরে এসব গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ, কায়রোর দারুল হিকমাহ, মাগরিব ও আন্দালুসের গ্রন্থাগারগুলো ছিল খলীফাদের প্রতিষ্ঠিত। এসব গ্রন্থাগারের বেশিরভাগই ছিল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার ধারা এতটাই ব্যপকতা লাভ করে, পরবর্তী সময়ে জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী নয় এমন আমীর কিংবা উজিররাও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা শুরু করেন। আলেম-উলামাদের খুব কমই এমন ছিলেন , যাদের ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল না।
উমাইয়া আমলে বড় কোনো গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত না হলেও আব্বাসীদের অভ্যুদয়ের পর অনুবাদ ও রচনা কর্মকান্ড বিপুল উতসাহে শুরু হয়। আত্মপ্রকাশ ঘটলো ওয়াররাকদের , কাগজও হয়ে উঠলো সহজলভ্য। এসময় থেকেই গ্রন্থাগার গড়ে উঠতে থাকে। আব্বাসী যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত ও বৃহত্তম গ্রন্থাগার বাইতুল হিকমাহ বা খাজানাতুল হিকমাহ, যদিও এই গ্রন্থাগার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আমাদের সামনে নেই। বাইতুল হিকমাহর খ্যাতি বিশ্বজুড়ে কিন্তু আজো নিশ্চিতভাবে জানা হয় নি কে এই গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা? খলীফা হারুনুর রশীদ নাকি খলীফা মামুনুর রশীদ? এই গ্রন্থাগারের অবস্থান কোথায় ছিল সে প্রশ্নের মীমাংসাও এখনো হয় নি। ড. আহমদ আমীন ও অন্যান্য গবেষকদের মতে খলীফা হারুনুর রশীদই এই গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা । এর স্বপক্ষে মজবুত দলীল হলো ইবনে নাদীমের বক্তব্য। তিনি লিখেছেন, আবু সাহল ফযল বিন নওবখত খলীফা হারুনুর রশীদের বাইতুল হিকমাহতে কর্মরত ছিলেন। খলীফা হারুনুর রশীদের সময়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও মামুনের শাসনামলে এটি সম্প্রসারিত হয়, এর কর্মসূচীও বিস্তৃত হয়। মামুন ছিলেন প্রচন্ড বিদ্যানুরাগী। দর্শনে তার আগ্রহ সর্বজনবিদিত। মামুন একবার রোম সম্রাটের কাছে প্রতিনিধি দল পাঠান। এই দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন হাজ্জাজ ইবনে মাতার, ইবনুল বিতরীক ও অন্যান্যরা। তারা রোম থেকে বেছে বেছে বেশকিছু গ্রন্থ নিয়ে আসেন। সাইপ্রাস দ্বীপবাসিদের সাথে সন্ধির পর মামুন তাদের কাছে গ্রীক গ্রন্থভান্ডার চেয়ে পাঠান। সাইপ্রাসের শাসক গ্রন্থগুলো পাঠালে মামুন সাহল বিন হারুনকে ঐ গ্রন্থাগারের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। বাইতুল হিকমাহর গ্রন্থাগারিকদের মধ্যে ছিলেন বীজগনিতের জনক মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারেজমীও। বাইতুল হিকমাহর কর্মকান্ডের মধ্যে ছিল অন্য ভাষার জ্ঞান-বিজ্ঞান আরবীতে অনুবাদ করা। হুনাইন ইবনে ইসহাক, হাজ্জাজ ইবনে মাতার, ইবনুল বিতরিক, আমর ইবনুল ফররুখান, ইসহাক ইবনে হুনাইন প্রমুখ বিভিন্ন সময় বাইতুল হিকমাহতে অনুবাদের দায়িত্বে ছিলেন।
বাইতুল হিকমাহর নাম নিয়েও আছে দ্বিমুখী বর্ননা। ইবনে নাদীম ও আল কুতফী বাইতুল হিকমাহ নামে একে অভিহিত করলেও ইয়াকুত হামাভী একে বলছেন খাজানাতুল হিকমাহ। বাইতুল হিকমাহর অবস্থান সম্পর্কে ড. আহমদ আমীনের বক্তব্য হলো, সম্ভবত এটি খলীফার প্রাসাদ এলাকার ভেতরেই ছিল। ৫৫৬ হিজরীতে (১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ) তাতারীদের হাতে বাগদাদ পতনের আগ পর্যন্ত বাইতুল হিকমাহ টিকে ছিল এটা বেশ জোরের সাথেই বলা যায়।
আব্বাসীয় যুগ থেকে শুরু হওয়া গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার এই ধারা শীঘ্রই বেগবান হয়। মুসলিমবিশ্বের আনাচে কানাচে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে গ্রন্থাগার। ড. মোস্তফা আস সিবাঈর মতে , ততকালীন মুসলিমবিশ্বের এমন কোনো গ্রাম পাওয়া মুশকিল ছিল যেখানে কোনো গ্রন্থাগার ছিল না । এ থেকে শহরগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে ছিল গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের জন্য নির্মান করা হতো আলাদা ভবন। সেই ভবনে থাকতো বিভিন্ন কক্ষ। একেক কক্ষে একেক বিষয়ের গ্রন্থ। সাহিত্য গ্রন্থের কক্ষ, ফিকহ গ্রন্থের কক্ষ, বিজ্ঞান গ্রন্থের কক্ষ, ইতিহাস গ্রন্থের কক্ষ ইত্যাদী। পাঠকের জন্য থাকতো আলাদা কক্ষ।গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হতো কাগজ কলম। কোনো কোনো গ্রন্থাগারে আবার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। শুরুতে উল্লেখ করা আবুল কাসেম জাফরের গ্রন্থাগারটি এমনই। গ্রন্থাগার দেখভালের দায়িত্বে নিযুক্ত হতেন যুগের অন্যতম খ্যাতনামা শিক্ষাবীদ্গন।ইমাম গাজালী কিছুদিনের জন্য জামেয়া নিজামিয়ার গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব পালন করছেন। ভারতবর্ষের বিখ্যাত কবি আমীর খসরু প্রথম জীবনে দিল্লীর শাহী গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ছিলেন। ইবনে সীনা ছিলেন সামানীয় শাসকের শাহী গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব নিয়োজিত। পাঠকদের কে বই সরবরাহ করার জন্যেও কিছু লোক নিয়োগ দেয়া হতো। তাদেরকে বলা হতো মুতানাবিল। অনুবাদক ও লিপিকাররাও থাকতেন তাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে। ওয়াররাকরা ব্যস্ত থাকতেন বই বাধাইয়ের কাছে। প্রচুর কর্মচারী নিযুক্ত থাকতেন এসব গ্রন্থাগারে। বিজাপুরস্থ আদীল শাহী গ্রন্থগারে কর্মরত ছিলেন ষাট জন কর্মচারী। স্পেনের খলীফা দ্বিতীয় হাকামের গ্রন্থাগারে ৫০০ কর্মী নিয়োজিত ছিল। আব্দুর রহমান খান খানানের গ্রন্থাগারে কর্মরত ছিলেন ৯৫ জন। ত্রিপোলীর বনু আম্মার গ্রন্থাগারে ১৮০ জন লিপিকার ছিলেন। ছোট বড় সব গ্রন্থাগারেই থাকতো পুস্তক তালিকা বা ক্যাটালগ। ক্যাটালগ দেখে সহজেই যে কোনো বই খুজে বের করা যেতো। প্রতিটি তাকের সাথে একটি ক্যাটালগ থাকতো , যাতে তাকে থাকা বইগুলোর নাম লেখা থাকতো। এসব গ্রন্থাগার থেকে জামানত দিয়ে বই বাইরে নেয়া যেতো, তবে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জামানত দেয়ার প্রয়োজন হতো না। এসকল গ্রন্থাগারের আয়ের উতস ছিল নানা ধরনের। অধিকাংশ গ্রন্থাগারেরই নিজস্ব ওয়াকফ থাকতো। অনেক সময় প্রতিষ্ঠাতারা নিজেরাই ব্যায়ভার বহন করতেন। মুহাম্মদ বিন আব্দুল মালেক আয যাইয়াত তার গ্রন্থাগারের নকল নবীশ ও লিপিকারদের মাসিক দুই হাজার দিনার ভাতা প্রদান করতেন। হুসাইন বিন ইসহাক ছিলেন খলীফা মামুনের অনুবাদক। খলীফা তার অনূদিত গ্রন্থকে স্বর্ণ দিয়ে ওজন করে তাকে অনুবাদের বিনিময় দান করতেন। ইয়াকুত আল হামাভী হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীতে মার্ভ ভ্রমন করেন। সেখানে তখন ১২ টি পাবলিক লাইব্রেরী ছিল। এর মধ্যে একটি লাইব্রেরীর সংগ্রহ ছিল ১২ হাজার বই। ইয়াকুত হামাভী সেখান থেকে ২০০ বই ঘরে এনে পড়েছেন। ৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ফাহানে একটি লাইব্রেরী স্থাপিত হয়। ৯৬৫ সালে স্থাপিত হয় নিশাপুরের লাইব্রেরী। কাজী আবু আল মুতরিফের ইন্তেকাল হয় ১১০১ খ্রিস্টাব্দে। তার সংগ্রহের বইপত্র বিক্রয় করা হয় চল্লিশ হাজার দিনারে।
পাঠাগারের ইতিহাস বলতে গেলে অবশ্যই আসবে স্পেনের নাম। উমাইয়া শাসকরা স্পেনে প্রচুর পাঠাগার নির্মান করেছেন ও অর্থ বরাদ্দ করেছেন । দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের রাজত্বের শুরুর দিকেই কর্ডোভাতে একটি পাঠাগার নির্মান করা হয় । কালক্রমে এটি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থাগারে পরিনত হয়। তৃতীয় আবদুর রহমান এটি আরো সম্প্রসারন করেন। তার পুত্র মুহাম্মদ অনেক বইপত্র সংগ্রহ করেন। খলীফা হাকামের বিখ্যাত গ্রন্থাগারে ৬০ লাখ বই ছিল। বার্বারদের হাতে এটি ধবংস হয়। আলমেরিয়ার শাসক আবু জাফর ইবনে আব্বাসের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ৪ লক্ষ বই ছিল।
আবুল মোজাফফর ইবনে আফতার । আল মুজাফফারিয়া নামক ৫০ খন্ডের একটি বিশ্বকোষ প্রণেতা। তারও একটি বিশাল কুতুবখানা ছিল। টলেডো ও সারগোসাতে বড় বড় গ্রন্থাগার ছিল। গ্রানাডায় বানু যুবাইদি ও ইবনে ফুরকানের গ্রন্থাগারের কথা ইতিহাসবিখ্যাত। শাফি বিন আলী (মৃত্যু ৭৩০ হিজরী/১৩২৯ খ্রিস্টাব্দ) যখন ইন্তেকাল করেন তখন তার গৃহে বিশ সিন্দুক ভর্তি বই পাওয়া যায় । অতিরিক্ত পড়াশোনার কারনে শেষ বয়সে তিনি অন্ধ হয়ে যান। কিন্তু বইয়ের সাথে অধিক সম্পর্কের কারনে তিনি যেকোনো বইতে হাত দিয়ে বলতে পারতেন এটি এই বই, আমি অমুকের কাছ থেকে কিনেছি। তার কাছে কোনো বই চাওয়া হলে তিনি দাঁড়িয়ে তাকে হাত হাত দিতেন এবং বইটি বের করে দিতেন। আল্লমা আলী বিন আহমাদ আল আমাদিও (মৃত্যু ৭১০ হিজরী/১৩১১ খ্রিস্টাব্দ) শেষ বয়সে অন্ধ হয়ে যান। তিনি তাকের যেকোনো বইতে হাত দিয়ে বইটির মোট খন্ড, তার হাতে থাকা খন্ডের কথা এবং বইটি কোন হস্তলিপিতে লেখা তা বলতে পারতেন। ইবরাহীম বিন ইসহাক হারবির কুতুবখানায় ১২০০০ বই ছিল। ইসরাইল বিন ইউনুস সাবিয়ী মৃত্যুকালে তার গৃহে বই ছাড়া আর কোনো কোনো আসবাব রেখে যান নি। মুহাম্মদ বিন আব্বাস বিন ফুরাতের গৃহে ছিল আঠারো সিন্দুকভর্তি বই। ইবনে উকদাহর (মৃত্যু ৩৩২ হিজরী/৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) সংগ্রহে ছিল প্রচুর বই। কখনো তার বই সরাতে হলে ৬০০ উটের প্রয়োজন হতো।
উলামায়ে কেরাম ইলমের জন্য বিশ্বের নানাপ্রান্তে সফর করতেন। এই সফরেও তাদের সাথে থাকতো নিজস্ব কুতুবখানা। যাহরাভীর (মৃত্যু ৪২৭ হিজরী/১০৩৫ খ্রিস্টাব্দ) বইপত্র আটজন কুলি বহন করতো।ইবনে মানদাহ (মৃত্যু ৩৯৫ হিজরী/১০০৪ খ্রিস্টাব্দ) চল্লিশ উটভর্তি বইপত্র নিয়ে চলাফেরা করতেন। বারকানি, বাগদাদের বিখ্যাত আলেম, সফরে বের হলে তার সাথে থাকত দুই সিন্দুকভর্তি বই।
নিশাপুরে প্রচুর কুতুবখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মসজিদ ও মাদরাসার জন্য অনেক বইপত্র ওয়াকফ করে দেয়া হতো। স্বয়ং নিজামুল মুলক তার মাদ্রাসার জন্য প্রচুর বই ওয়াকফ করেন, যার মধ্যে ছিল ইবরাহিম হারবির লেখা দশ খন্ডের একটি সংকলনও। আবু হাতেম বিন হিব্বান (মৃত্যু ৩৫৪ হিজরী/৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ) তার সকল বই আলে যিয়াদের কুতুবখানায় ওয়াকফ করে দেন। মাদরাসা দারুস সুন্নাহর কুতুবখানার জন্য প্রচুর হাদিসের কিতাব ওয়াকফ করা ছিল। আকিল মসজিদেও বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য বই ওয়াকফ করা ছিল, যা শুধু উলামাদের ব্যবহারের অনুমতি ছিল। গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেই এর প্রতিষ্ঠাতারা ক্ষান্ত হতেন না । তারা মনোযোগ দিতেন বই সংগ্রহের প্রতি। মুসলিম বিশ্বের আনাচে কানাচে ঘুরে তাদের প্রতিনিধিরা সংগ্রহ করতো দুষ্প্রাপ্য, দুর্লভ বই। গড়ে উঠতো বইয়ের এক সমৃদ্ধ সংগ্রহ । কায়রোতে ফাতেমী খলীফারা যে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন মাকরেযির মতে ১৬ লাখ বই ছিল। যদিও অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে সেখানে ২০ লাখ বই ছিল। ত্রিপলীর বনু আম্মার গ্রন্থাগারে দশ লাখ বই ছিল। চলুন, এবার মুসলিমবিশ্বের খ্যাতনামা কিছু গ্রন্থাগারের কথা জেনে আসা যাক।
আদাদ উদ দৌলার কুতুবখানা
আদাদ উদ দৌলা সিরাজে একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা গড়ে তোলেন । ভূগোলবিদ মাকদেসি এই কুতুবখানার বিস্তারিত বিবরণ লিখেছেন। পাঠাগারের ভবনটি ছিল সুরম্য অট্টালিকা। এর একপাশে ছিল নহর, অন্যপাশে সবুজ উদ্যান। এখানে এলে এক নিমিষেই যে কারো প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। অট্টালিকাতে ৩৬০ টি কক্ষ ছিল। এসব কক্ষে আদাদ উদ দৌলা তার খেয়াল খুশিমত অবস্থান করতেন। কুতুবখানাটি ছিল বড় একটি হলঘরে।হলঘরে ছিল তিন গজ চওড়া ও মানুষ সমান উচু মাচান। মাচানের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তাক। তাক ভর্তি শুধু বই আর বই। সকল প্রকার জ্ঞান বিজ্ঞানের বই সেই কুতুবখানায় ছিল। ছিল সুবিন্যস্ত ক্যাটালগও।
আবুল হাসান মোহাম্মদের কুতুবখানা
৪৫২ হিজরীতে (১০৬০ খ্রিস্টাব্দ) আবুল হাসান মুহাম্মদ বিন হেলাল বিন মহসিন তার কুতুবখানাটি সর্বসাধারনের জন্য ওয়াকফ করে দেন । সাবুর বিন আরদশীরের কুতুবখানা পুড়ে যাওয়ার সংবাদে তিনি অত্যন্ত পেরেশান হন। ইলম বিলুপ্তির আশংকায় নিজের কুতুবখানা ওয়াকফ করে দেন। বাগদাদের পশ্চিম প্রান্তে ইবনু আবি আউফ সড়কে এটি অবস্থিত ছিল। এই কুতুবখানায় প্রায় চার হাজার বই ছিল। উলামায়ে কেরাম নিয়মিত এখানে আসা যাওয়া করতেন। এখানে বিতর্কের মজলিস বসতো। কুতুবখানাটি অবশ্য বেশিদিন টিকে নি। কোনো এক বিচিত্র কারনে আবুল হাসান এই কুতুবখানার সকল বই বিক্রি করে অর্জিত অর্থ সদকা করে দেন।
ইবনে শাহের কুতুবখানা
আবু মানসুর ইবনে শাহ মারওয়ান ছিলেন বসরার উযির। তিনি একটি কুতুবখানা ওয়াকফ করে দেন। এই কুতুবখানায় উলামায়ে কেরাম ও ছাত্ররা আসতো। এখানে অনেক মূল্যবান বইপত্র ছিল। ইবনে আসিরের বর্ননামতে ৪৮৩ হিজরিতে এই কুতুবখানা পুড়ে যায়।
জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদের কুতুবখানা
নিজামুল মুলক জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদ প্রতিষ্ঠার সময় (৪৫৮ হিজরী) মাদ্রাসার জন্য একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। কুতুবখানাটির অবস্থান ছিল মাদ্রাসার ভবনের এক অংশে। এখানে প্রচুর বই ছিল। নিজামুল মুলক বাগদাদ এলেই এই কুতুবখানায় আসতেন। বই পড়তেন।বিভিন্ন সময় আবু বকর জাকারিয়া ইয়াহইয়া বিন আলী তাবরেযী, মুহাম্মদ বিন আহমাদ, আলি বিন আহমাদ বিন বাকেরী প্রমুখ এই কুতুবখানার পরিচালক ছিলেন। ৫৮৯ হিজরীতে খলীফা নাসির লিদিনিল্লাহর প্রাসাদ থেকে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য বই কুতুবখানায় আনা হয়। ইবনুল জাওযি এই কুতুবখানার ক্যাটালগ দেখেছেন। তার মতে সেখানে ৬ হাজার বই ছিল।
মুস্তানসিরিয়া মাদ্রাসার কুতুবখানা
জামিয়া নিজামিয়া প্রতিষ্ঠার অর্ধ শতাব্দী পর জামিয়া মুস্তানসিরিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। খলীফা মুস্তানসির বিল্লাহ সিংহাসনে আরোহনের দুই বছর পর এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজামিয়া বাগদাদে শুধু শাফেয়ী মাজহাবের ফিকহ পড়ানো হতো। শাফেয়ী ছাড়া অন্যদের সেখানে পড়ার সুযোগ ছিল না। মুস্তানসিরিয়াতে চার মাজহাবের ছাত্ররাই পড়তে পারতো। এই মাদ্রাসার অবস্থান ছিল দজলা নদীর উত্তর প্রান্তে , খলীফার প্রাসাদের কাছাকাছি। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সময়েই এখানে একটি কুতুবখানা নির্মাণ করে। খলীফা আদেশ দেন শাহী কুতুবখানা থেকে এখানে বইপত্র স্থানান্তর করতে। ২৯০টি ভারবাহী জন্তুতে করে প্রায় ৮০০০ বই আনা হয়। পরে এই কুতুবখানায় অনেক ওয়াররাক, আমীর ও আলেমরা তাদের বই উপহার দিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জ্ঞানীগুনিরা এই কুতুবখানা পরিদর্শনে আসতেন। ইবনে বতুতা ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে এই কুতুবখানা পরিদর্শন করেন। তিনি এখানে সংঘটিত একটি মোনাজারার মজলিসেও বসেন। ৬৩৪ হিজরীতে (১২৪৫ খ্রিস্টাব্দ) নুরুদ্দিন আরসালান শাহ বিন ইমাদুদ্দিন যিংকী এই কুতুবখানায় আসেন। তিনি এখানে এক ঘন্টা অবস্থান করেন। ৬৯৬ হিজরীতে (১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ) আসেন পারস্যের আমীর মাহমুদ গাজান তাতারী। সমকালীন আলেমদের অনেকেই এই কুতুবখানা থেকে উপকৃত হয়েছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন, ফকিহ আলাউদ্দিন আলী বিন ইয়াকুব, ফখরুদ্দীন হাসান বিন মুহাম্মদ, কওয়ামুদ্দিন হিবাতুল্লাহ বিন আহমদ, ঈসা বিন কুসাইস। কুতুবখানার পরিচালককে দৈনিক ১০ রিতল পরিমান রুটি, ৪ রিতল পরিমান গোশত দেয়া হত। মাসিক ভাতা ছিল ১২ দিনার।
ফাদেলিয়া মাদ্রাসার কুতুবখানা
আবু আলী আব্দুর রহীম বিন আলী বিন মুহাম্মদ লাখমী আসকালানী (মৃত্যু ৫৯৬ হিজরী/১২০০ খ্রিস্টাব্দ) , যিনি কাজী ফাদেল নামেই অধিক পরিচিত, ছিলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর উযির। তিনি ৫৮০ হিজরীতে (১১৮৪ খ্রিস্টাব্দ) কায়রোতে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। এই মাদ্রাসায় মালেকি ও শাফেয়ী মাজহাবের ছাত্ররা পড়তো। এই মাদ্রাসার নাম ছিল ফাদেলিয়া মাদ্রাসা। কাজি ফাদেল এই মাদ্রাসায় একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা গড়ে তোলেন। ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী এই মাদ্রাসায় প্রায় এক লাখ বই ছিল। এর মধ্যে হজরত উসমানের রা. যুগে খত্তে কুফিতে লিখিত একটি কুরআনুল কারিমও ছিল। কাজি ফাদেল এটি ৩০ হাজার দিনারে ক্রয় করেন।
মাহমুদিয়া মাদ্রাসার কুতুবখানা
৭৯৭ হিজরীতে (১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দ) কায়রোতে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন জামালুদ্দিন মাহমুদ বিন আলী (মৃত্যু ৭৯৯ হিজরী/১৩৯২ খ্রিস্টাব্দ)। এই মাদ্রাসায় একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা ছিল। কুতুবখানার বইপত্র সম্পর্কে কোন স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে হিজরী নবম শতাব্দীর শুরুতে মাকরেজি এই কুতুবখানার বর্ননা দিতে গিয়ে লিখেছেন , মিসর ও শামে এর সমতূল্য কোনো কুতুবখানা নেই। মাকরেজি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল মাওয়ায়েজ ওয়াল ইতিবার বিজিকরিল খিতাতি ওয়াল আসার’ রচনার সময় এই কুতুবখানার দারস্থ হন।
আদেলিয়া মাদ্রাসার কুতুবখানা
দামেশকে এই মাদ্রাসার নির্মাণ কাজ শুরু করেন নুরুদ্দীন মাহমুদ যিংকী । শেষ করেন আল মালিকুল আদেল। মাদ্রাসাটি তার নামেই প্রসিদ্ধি অর্জন করে। এই মাদ্রাসায় একটি বড় কুতুবখানা ছিল। সেখানে উলামাদের মজলিস বসতো। বিভিন্ন ফতোয়া দেয়া হতো। মূলত এই কুতুবখানার বেশিরভাগ বইয়ের মালিক ছিলেন কুতুবুদ্দীন নিশাপুরী (মৃত্যু ৫৭৮ হিজরী/১১৮২ খ্রিস্টাব্দ)। মাদ্রাসার নির্মাণকাজ শেষ হলে তার বইপত্র এই কুতুবখানায় নিয়ে আসা হয় । পরে বিভিন্ন সময় আরো বই বৃদ্ধি করা হয়। এই কুতুবখানার কিছু কিছু বই আজো দামেশক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।
নুরিয়া মাদ্রাসার কুতুবখানা
৫৪৩ হিজরীতে (১১৪২ খ্রিস্টাব্দ) নুরুদ্দীন যিংকী হালাবে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসা তার নামে প্রসিদ্ধি পায়। মাদ্রাসার একটি নিজস্ব কুতুবখানা ছিল। উলামাদের অনেকে তাদের বইপত্র এই মাদ্রাসায় ওয়াকফ করে দিয়েছেন। এমন কয়েকজন হলেন, ফকীহ আবু বকর ইবনে আহমাদ আয যাহের (মৃত্যু ৫৫৩ হিজরী/ ১১৫৮ খ্রিস্টাব্দ ), মুহাদ্দিস আবু বকর রায়িনি মুহাম্মদ বিন শারিহ (মৃত্যু ৫৬৩ হিজরী/১১৬৭ খ্রিস্টাব্দ) ও মুহাদ্দিস আহমদ বিন মাহমুদ বিন ইবরাহিম জাওহারি (মৃত্যু ৬৪৩ হিজরী/১২৪৫ খ্রিস্টাব্দ)
শরফিয়া মাদ্রাসার কুতুবখানা
হালাবে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন শরফুদ্দিন আব্দুর রহমান আজমি (মৃত্যু ৬৫৮ হিজরী/ ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দ) । এই মাদ্রাসায় শাফেয়ী মাজহাবের ছাত্ররা পড়তে পারতো। এখানে একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা ছিল। এই কুতুবখানায় হাদিস, তাফসীর, ফিকহ, নাহু, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদী বষয়ের বই ছিল। ৬৫৮ হিজরীতে তাতারীরা হালাবে প্রবেশ করলে এই মাদ্রাসা ধবংস করে দেয়।
হিজরী চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত মসজিদই ছিল মুসলমানদের শিক্ষালয়। সেখানেই পড়াশোনা হতো। দামেশকের জামে উমাভী, কায়রোর জামে আজহার , বাগদাদের জামে মানসুর কিংবা কর্ডোভার জামে কর্ডোভা, প্রত্যেকটি মসজিদই ছিল অনুপম শিক্ষা নিকেতন। কর্ডোভার মসজিদে ইউরোপ থেকে আসা অমুসলিম ছাত্ররাও পড়তো। তখনো মাদ্রাসার আলাদা কাঠামো গড়ে উঠে নি। এ কারনে মসজিদ্গুলোতেও গড়ে উঠে কুতুবখানা ।
জামে উমাভীর কুতুবখানা
জামে উমাভীতে একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা ছিল। এখানে প্রচুর বই ওয়াকফ করা হয়। ৪৬১ হিজরী (১০৬৮ খ্রিস্টাব্দ) আগুন লেগে এই কুতুবখানা পুড়ে যায় । হারিয়ে যায় অমূল্য সব গ্রন্থরাজী। তবে এখান থেকে উদ্ধারকৃত কিছু গ্রন্থ বর্তমানে দামেশক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। একটি গ্রন্থে লেখা আছে ‘তিন খন্ডের এই বইটি সওাব ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় জামে উমাভীতে ওয়াকফ করলাম। আব্দুল মুনইম বিন আহমদ । জিলকদ ২৯৮ হিজরী। অগ্নিকান্ডের পরেও এখানে অনেক বই ওয়াকফ করা হয়েছে। এমনই একজন আহমদ বিন আলী বিন ফজল বিন ফুরাত (মৃত্যু ৪৯৪ হিজরী/ ১১০০ খ্রিস্টাব্দ)। তার সম্পর্কে ইবনে আসাকির লিখেছেন , ‘তিনি তার ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ জামে উমাভিতে ওয়াকফ করে দেন।
জামে কাইরাওয়ানের কুতুবখানা
উত্তর আফ্রিকার বিখ্যাত মসজিদ জামে কাইরাওয়ান । এখানে গড়ে উঠে শিক্ষালয়। শিক্ষার জন্য বই প্রয়োজন। মসজিদেই গড়ে উঠে বড় একটি কুতুবখানা । বিভিন্ন বিষয়ের প্রচুর বই ছিল এই কুতুবখানায়। ইবনে খালদুন তার মুকাদ্দিমার একটি কপি এই কুতুবখানায় ওয়াকফ করে দেন। সুলতান আহমদ মানসুর সাদী তার শাসনামলে এই কুতুবখানাকে আরো প্রসারিত করেন।
ইমাম ওয়াকেদীর পাঠাগার
প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন উমর বিন ওয়াকেদ আল আসলামী (১৩০-২০৭ হিজরী/ ৭৪৭-৮২৩ খ্রিস্টাব্দ) , ইমাম ওয়াকেদী নামেই যিনি সুপরিচিত, তিনি ছিলেন হাফেজে হাদীস, সিয়ার ও মাগাজির আলেম। তার ছিল নিজস্ব পাঠাগার। ইবনে নাদীম লিখেছেন, ইমাম ওয়াকেদীর মৃত্যুর পর দেখা যায় তার সংগ্রহে ৬০০ সিন্দুক ভর্তি বই ছিল। প্রতিটি সিন্দুক বহন করতে দুইজন লোক লাগতো। তিনি বেচে থাকতে দুজন মামলুক নিয়োগ দিয়েছিলেন যারা দিন-রাত বইয়ের অনুলিপি তৈরী করতো।
আবিল বাকার কুতুবখানা
কিছু কিছু ঐতিহাসিকের মতে এটিই মুসলিমবিশ্বের প্রথম কুতুবখানা , যা জনসাধারনের জন্য ওয়াকফ করে দেয়া হয়। বসরায় এই কুতুবখানা প্রতিষ্ঠা করেন আবুল ফারাজ বিন আবিল বাকা (মৃত্যু ৪৯৯ হিজরী/১১০৫ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন আরবী ভাষায় পন্ডিত। তিনি এই কুতুবখানা ওয়াকফ করে দেন। হাফেজ শামসুদ্দিন জাহাভীর ভাষ্যমতে এই কুতুবখানায় ১২ হাজার বই ছিল।
উবাইদুল্লাহ বিন আলীর কুতুবখানা
উবাইদুল্লাহ বিন আলী বিন নসর (মৃত্যু ৫৪১ হিজরী/৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন হাম্বলী মাজহাবের একজন বিখ্যাত ফকিহ। সাহিত্য, চিকিতসাবিজ্ঞান, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন এসব বিষয়ে তার প্রচুর পড়াশোনা ছিলো। তার সংগ্রহে প্রচুর বই ছিল। তিনি বাগদাদে একটি কুতুবখানা নির্মাণ করেন এবং ছাত্রদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। রাজনৈতিক কারনে তাকে গ্রেফতার করা হলে এই কুতুবখানার বইপত্র নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয়।
ফাতাহ বিন খাকানের কুতুবখানা
ফাতাহ বিন খাকান ছিলেন খলিফা মুতাওয়াক্কিলের মন্ত্রী। ২৪৭ হিজরীতে (৮৬১ খ্রিস্টাব্দ) খলীফার সাথেই নিহত হন। তিনি উচুমাপের আলেম ছিলেন। তার নিজস্ব কুতুবখানাতে প্রচুর বই ছিল। তিনি লোক নিয়োগ করে এই কুতুবখানার জন্য বই লেখাতেন, অনুলিপি প্রস্তুত করতেন। তার এই কুতুবখানার জন্যই আবু উসমান বিন আমর বিন মাহবুব জাহেজ “ আত তাজ ফি আখলাকিল মুলুক’ গ্রন্থটি রচনা করেন। এই কুতুবখানায় মাহবুব বিন হারেস তাগলবী ও মুহাম্মদ বিন হাবিব প্রমুখ লেখালেখির কাজ করতেন, যদিও তাদের গ্রন্থাবলীর নাম জানা যায় নি।
ইবনুল আমিদের কুতুবখানা
ইবনুল আমিদ ছিলেন বুয়াইহিদের উযির। জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে একশো সিন্দুক ভর্তি বই ছিল। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে তিনি বই সংগ্রহ করতেন।
সাহেব বিন আব্বাদের কুতুবখানা
সাহেব বিন আব্বাদ ছিলেন ইবনুল আমিদের ছাত্র। তিনিও প্রচন্ড জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। তিনিও উযির হয়েছিলেন। ইতিহাসে সর্বপ্রথম তাকেই সাহেব উপাধী দেয়া হয়। তার নিজস্ব কুতুবখানার বই চারশো উটে বহন করতে হতো। সফরে গেলে তিনি ত্রিশ উট বোঝাই বই নিয়ে যেতেন। তার এই কুতুবখানার ক্যাটালগ ছিল দশ খন্ডে বিভক্ত। উইল ড্যুরান্ট তার দি স্টোরি অব সিভিলাইজেশন বইতে এই কুতুবখানার কথা উল্লেখ করেছেন।
হুনাইন বিন ইসহাকের কুতুবখানা
হুনাইন বিন ইসহাক ছিলেন একজন বিখ্যাত অনুবাদক। তিনি গ্রীক, সুরিয়ানি, ফার্সী ইত্যাদী ভাষা থেকে বইপত্র আরবীতে অনুবাদ করতেন। তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করে বইপত্র সংগ্রহ করতেন। তার নিজস্ব একটি কুতুবখানা ছিল। এই কুতুবখানায় চিকিতসাবিজ্ঞান ও গ্রীক দর্শনের প্রচুর বই ছিল।
ইমাদুদ্দিন ইস্ফাহানীর কুতুবখানা
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাদুদ্দিন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইস্ফাহানীর (মৃত্যু ১২০০ খ্রিস্টাব্দ) জন্ম ইস্ফাহানে। বেড়ে উঠেছেন দামেশকে, পড়াশোনা বাগদাদে। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দরবারে পৌছান এবং তার সাথে মিসর সফর করেন। আইয়ুবীদের হাতে ফাতেমী সাম্রাজ্যের পতন হলে ফাতেমীদের বইপত্র বিক্রির ঘোষণা দেয়া হয়। তখন সপ্তাহে দুদিন ফাতেমীদের বইপত্র বিক্রি করা হতো। এই সুযোগে ইমাদুদ্দিন ইস্ফাহানি স্বল্পমূল্যে প্রচুর বই সংগ্রহ করেন। এছাড়া সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাকে প্রচুর বই উপহার দেন। এভাবে তার একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা হয়ে যায়।
ইবনে যিয়াতের পাঠাগার
ইবনে যিয়াত ছিলেন মু’তাসিম ও ওয়াসিকের যুগে আব্বাসী সাম্রাজ্যের উযির। পুরো নাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল মালেক বিন আবান বিন হামযাহ (১৭৩-২৩৩ হিজরী/৭৮৯-৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন আরবী ভাষা ও সাহিত্যের খুব উচুস্তরের পন্ডিত। তার ব্যক্তিগত পাঠাগারে ছিল বিভিন্ন বিষয়ের বইপত্রের এক বিশাল সংগ্রহ। সেই পাঠাগারে কয়েকজন অনুবাদক ছিলেন যারা গ্রীক ও অন্যান্য ভাষা থেকে বইপত্র আরবীতে অনুবাদ করতেন। তাদের মাসিক ভাতা ছিল এক হাজার দিরহাম। বইপত্র সংগ্রহে তার ছিল অদম্য নেশা। জাহেয বলেন, আমি ইবনে যিয়াতের সাথে দেখা করতে গেলাম। ভাবলাম তার জন্য কিছু উপহার নিয়ে যাই। তাকে উপহার দেয়ার জন্য সিবাওয়াইয়ের বইয়ের চেয়ে উত্তম কিছু পেলাম না । ইবনে যিয়াতের কাছে পৌছে তাকে বললাম, আপনাকে উপহার দেয়ার জন্য এর চেয়ে উত্তম কোনো বই পাই নি। ইবনে যিয়াত বললেন, তুমি কী করে ভাবলে আমার পাঠাগারে এই বইটি নেই? আমি বললাম, আমি মোটেও এমন ভাবি নি। তবে এটি স্বয়ং ফাররার হাতে লেখা। আমি ফাররার মিরাছ থেকে এটি কিনেছি। একথা শুনে ইবনে যিয়াত প্রচন্ড খুশী হন।
কাজী ফাযেলের পাঠাগার
আব্দুর রহীম বিন আলী বিন সাঈদ আল লাখমী (৫২৯-৫৯৬ হিজরী/১১৩৫-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর মন্ত্রী। প্রসিদ্ধি পেয়েছেন কাজী ফাযেল নামে। তার সম্পর্কে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বলেছিলেন, ভেবো না আমি তলোয়ার দ্বারা দেশ শাসন করি, আসলে আমি ফাযেলের কলম দ্বারা শাসন করি। কাজী ফাজেল কায়রোতে একটি মাদরাসা ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পরিচিত ছিল ফাজেলিয়া নামে। এটি ছিল তার সময়ের সেরা পাঠাগার। এখানে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল।
ইবনুল জাওযির পাঠাগার
জামালুদ্দিন আবুল ফারাজ আব্দুর রহমান বিন আলী বিন মোহাম্মদ আল জাওযি (৫০৮-৫৯৭ হিজরী/১১১৪-১২০১ খ্রিস্টাব্দ) সেসকল আলেমদের একজন যারা অধিক লেখালেখির জন্য বিখ্যাত। তিনি হাদীস, তাফসির, ফিকহ, সীরাত, মানাকিব, ইতিহাস, কবিতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন। তার ব্যক্তিগত পাঠাগারটিও ইতিহাসে বিখ্যাত।
নিজামুল মুলক তুসীর পাঠাগার
জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদের প্রতিষ্ঠাতা, আবু জাফর মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ হাসান নাসিরুদ্দীন তুসী (মৃত্যু ৫৯৭ হিজরী), নিজামুল মুলক তুসি নামেই যিনি প্রসিদ্ধ, তার ছিল সুসজ্জিত একটি পাঠাগার। শাম, বাগদাদ ও জাযিরা থেকে তিনি প্রচুর বই সংগ্রহ করেন। তার সংগ্রহে প্রায় চার লাখ বই ছিল।
ইবনে ফুরাতের পাঠাগার
আবুল হাসান মুহাম্মদ বিন আব্বাস বিন আহমাদ বিন মুহাম্মদ বিন ফুরাত (৩১৯-৩৮৪ হিজরী/৯৩১-৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদের মুহাদ্দিসদের অন্যতম। আবুল কাসেম আজহারী লিখেছেন, তার মৃত্যুর পর তার ঘরে ১৮ টি বাক্সভর্তি বই পাওয়া যায়। এছাড়া অন্যান্য বইগুলো চুরী হয়ে যায়।
মিসরে ফাতেমীরা যেসকল পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। মিসরে ফাতেমীদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পরে আইয়ুবী ও মামলুকদের শাসনকালে প্রচুর কুতুবখানা গড়ে উঠে। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মত এখানেও আলেমদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে প্রচুর বই ছিল। বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ বিন আবু বকর কুফীর (মৃত্যু ৬৬৭ হিজরী/১২৬৭ খ্রিস্টাব্দ) ব্যক্তিগত কুতুবখানায় প্রচুর বই ছিল। তিনি সব বই ছাত্রদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। শায়খ জালালুদ্দিন কুনুভী (মৃত্যু ৬৭২ হিজরী/১২৭২ খ্রিস্টাব্দ) যখন দরস নিতে বসতেন তখন তার চারপাশে থাকতো কিতাব আর কিতাব । শায়খ ইয়াহইয়া বিন আব্দুল ওয়াহহাব শাফেয়ীর (মৃত্যু ৭২১ হিজরী/১৩২১ খ্রিস্টাব্দ) সংগ্রহেও প্রচুর বই ছিল। তিনি তার সব বই জহির মসজিদের কুতুবখানায় দান করে দেন।
জামে ইবনে তুলুনের কুতুবখানা
মিসরের বিখ্যাত মসজিদ জামে ইবনে তুলুন। ২৬৩ হিজরীতে (৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ) এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন মিসরের অধিপতি আহমাদ ইবনে তুলুন। মসজিদের জন্য প্রচুর ওয়াকফ বরাদ্দ করা হয়। মসজিদের ভেতরেই প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি কুতুবখানা । পরবর্তী শাসকরাও এই কুতুবখানায় বইপত্র দান করেছেন। মাকরেজির ভাষ্যানুসারে হাকেম বি আমরিল্লাহ যখন জামে আহমাদ বিন তুলুনে আসেন তখন তিনি ৮১৪ কপি কোরআন শরিফ ওয়াকফ করেন । এই কুতুবখানায় দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিতসাবিদ্যা, ইতিহাস ইত্যাদী বিষয়ে প্রচুর বই ছিল।
দারুল হিকমাহ
এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন হাকেম বি আমরিল্লাহ। ৩৯৫ হিজরীর ১০ জমাদাল উখরা পাঠাগারটি উদ্বোধন করা হয়। ততকালে এতবড় সংগ্রহ আর কোথাও ছিল না। বিভিন্ন শাস্ত্রের প্রাচীন ১৮০০০ বই সংগ্রহ করা হয় এই পাঠাগারে। লোকেরা এখানে আসতো বই পড়তে, ওয়াররাকরা আসতো অনুলিপি প্রস্তুত করতে।
হাকামের পাঠাগার
স্পেনে খলীফা হাকাম একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। বিশুদ্ধ মত অনুসারে এই পাঠাগারে বিভিন্ন শাস্ত্রের চার লক্ষ বই ছিল। পাঠাগারের পুস্তক তালিকা ছিল ৪৪ খন্ডে বিভক্ত। প্রতি খন্ডে পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫০।
ইবনে খশাবের পাঠাগার
ইবনে খশাব (মৃত্যু ৫৬৭ হিজরী) ছিলেন নাহু শাস্ত্রের একজন প্রসিদ্ধ আলেম। এছাড়া তাফসীর, হাদীস, মানতেক ও দর্শনেও তার খ্যাতি ছিল। তিনি বই সংগ্রহ করতে ভালোবাসতেন। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহেও প্রচুর বই ছিল।
আমীর আবুল ফজলের কুতুবখানা
নিশাপুরের আমীর আবুল ফজল উবাইদুল্লাহ বিন আহমদ (মৃত্যু ৪৩৬ হিজরী/১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ) তার গৃহে একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা গড়ে তোলেন। এই কুতুবখানায় অনেক দুষ্প্রাপ্য বই ছিল। বিখ্যাত লেখক সাআলাবি তার বিভিন্ন গ্রন্থ লেখার সময় এই কুতুবখানা থেকে উপকৃত হন। পরে সাআলাবি তার ফিকহুল লুগাহ ও অন্যান্য গ্রন্থের একটি কপি এই কুতুবখানায় প্রেরণ করেন।
জামিয়া নিজামিয়া নিশাপুরের কুতুবখানা
নিশাপুরের সবচেয়ে বড় কুতুবখানা ছিল জামিয়া নিজামিয়া নিশাপুরের কুতুবখানা। নিজামুল মুলক প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য নিজামিয়ার (সংখ্যা নিয়ে খানিকটা মতভেদ আছে। আল্লামা তাজুদ্দিন সুবকির মতে নিজামিয়া ছিল ৯ টি। আর ড নাজি মারুফের মতে ১০ টি) মধ্যে নিজামিয়া নিশাপুরের অবস্থান ছিল বাগদাদের নিজামিয়ার পরেই। অবশ্য এটি বাগদাদের নিজামিয়ার কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদরাসার কুতুবখানায় সকল শাস্ত্রের বইপত্র ছিল। সবচেয়ে বেশি ছিল শাফেয়ী মাজহাবের বইপত্র। এই কুতুবখানায় এমন কিছু দুষ্প্রাপ্য বই ছিল যা তখন অন্য কোনো কুতুবখানায় ছিল না । যেমন : হাকিম আবু উবাইদ আব্দুল ওয়াহেদের লিখিত কিতাবুল হায়াওয়ান, এবং আবু আব্দুল্লাহ মাসুমি রচিত দর্শনের বইপত্র।
মোহাম্মদ বিন ফজলের কুতুবখানা
মোহাম্মদ বিন ফজল মুফিদ ইবনে খুজাইমা (মৃত্যু ৩৮৭ হিজরী/৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন নিশাপুরের বিখ্যাত মুহাদ্দিস। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে প্রচুর বই ছিল। এর অধিকাংশই তিনি তার দাদার উত্তরাধিকার থেকে পেয়েছিলেন। হাকেম আবু আব্দুল্লাহ নিশাপুরি তার বইপত্র রচনায় এই কুতুবখানা থেকে প্রচুর সাহায্য নিয়েছেন।
নিশাপুরে এধরনের আরো কিছু ব্যক্তিগত কুতুবখানা ছিল আলেমদের। যেমন ; উমর বিন আহমদ বিন ইবরাহিমের (মৃত্যু ৪১৭ হিজরী/ ১০২৬ খ্রিস্টাব্দ) কুতুবখানা, আবু আব্দুর রহমান সালেমির (মৃত্যু ৪১২ হিজরী/১০২১ খ্রিস্টাব্দ) কুতুবখানা, যাইনুল ইসলাম আব্দুল করিম বিন হাওয়াজিন আবুল কাসেম কুশাইরির (মৃত্যু ৪৬৫ হিজরী/১০৭৩ খ্রিস্টাব্দ) কুতুবখানা , ইমামুল হারামাইন জুওয়াইনির (মৃত্যু ৪৭৮ হিজরী/১০৮৫ খ্রিস্টাব্দ) কুতুবখানা।
ভারতবর্ষের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটা সময় পর্যন্ত পড়ালেখার অধিকার একচেটিয়াভাবে ব্রাক্ষ্মনদের ছিল। এই পড়ালেখা হতো মন্দীর কিংবা মন্দীর সংলগ্ন ভবনে। তাদের লিখিত বইপত্রও এসব স্থানেই থাকতো। বৌদ্ধ ধর্মের উথানের পর মন্দীর ছাড়াও পৃথক শিক্ষালয় গড়ে উঠে। তৈরী হয় বড় বড় ছাত্রাবাস। এসব শিক্ষালয়ে স্বতন্ত্র লাইব্রেরী বা পাঠাগার থাকতো যাকে পুস্তক ভান্ডার বলা হতো। বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েও বড় একটি পাঠাগার ছিল। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং এই পাঠাগার থেকে অনেক বইয়ের প্রতিলিপি তৈরী করেন। এছাড়া পাটালীপুত্র, গুজরাট, মালোয়াহ ইত্যাদী অঞ্চলের বৌদ্ধ শিক্ষালয়গুলোতেও অনেক পাঠাগার ছিল। ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে যুদ্ধবিজয়ের ফলে এসব মন্দীর ও শিক্ষালয় থেকে অনেক বই মুসলমানদের হাতে আসে।কেউ কেউ মনে করেন মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষে বইপত্র অপ্রতুল ছিল। যারা এই মত প্রকাশ করেন তারা দলীল হিসেবে শাহ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিসে দেহলভীর ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি যখন ফার্সী ভাষায় ‘তাফসিরে ফাতহুল আযিয’ লিখছিলেন তখন অনেক খোজাখুজি করেও তাফসীরে কাবির পান নি। পরে শাহী কুতুবখানা থেকে কয়েকদিনের জন্য তাফসিরে কাবির ধার এনেছিলেন। যদিও ঘটনাটি সত্য এবং এর ঐতিহাসিক ভিত্তিও আছে তবু এই একটি ঘটনা দ্বারা কোনো সামগ্রিক সিদ্ধান্ত নেয়া বোকামি। সে যুগের অন্যান্য আলেমদের লেখা থেকেই বোঝা যায় তখন ভারতবর্ষে কী পরিমান বইপত্র পাওয়া যেতো। স্বয়ং শাহ আব্দুল আযিযের বইপত্র ও ফতোয়াতে তিনি যেসব কিতাব থেকে রেফারেন্স দিয়েছেন তা দেখলেই উপরোক্ত সিদ্ধান্তের অসারতা প্রমান হয়। তার এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেলভীর বইপত্রে যেভাবে ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য ফকিহদের বই থেকে রেফারেন্স দিয়েছেন সেভাবে ইবনে তাইমিয়া কিংবা ইবনে হাযম আন্দালুসির বইপত্র থেকেও প্রচুর রেফারেন্স দিয়েছেন, যা দ্বারা বুঝা যায় ভারতবর্ষে তখন তাদের বইপত্র সহজলভ্য ছিল। হাদীসের যেসকল অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি থেকে তারা রেফারেন্স দিয়েছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী, যাকে শাহ আব্দুল আযিয ‘ভারতবর্ষের বায়হাকি’ বলতেন, তিনিও তার তাফসীরে মাজহারীতে প্রচুর হাদিস এনেছেন। যা থেকে বুঝা যায় তখন হাদিসের কিতাবগুলোও বেশ সহজলভ্য ছিল ভারতবর্ষে। মোল্লা মুহিব্বুল্লাহ বিহারী তার রচিত মুসাল্লামুস সুবুত কিতাবের শেষে যেসকল কিতাবের তালিকা দিয়েছেন তাতে- শরহে বাযদাবী, উসুলে সারাখসি, কাশফে বাযদাবী, কাশফুল মানার, তাওজিহুত তালবি, ইবনে হুমামের রচনাবলী, কাজী বায়যাভী ও তাফতাজানীর বইপত্র এবং শাফেয়ি ফিকহের বিভিন্ন বইপত্রের নাম আছে। এ থেকেও সেকালের উলামায়ে কেরামের কাছে থাকা বইপত্র সম্পর্কে অনুমান করা যায়। ফতোয়ায়ে আলমগিরী, যা সম্রাট মহিউদ্দীন আলমগীরের তত্ত্বাবধানে রচিত হয়েছে, তার শেষে ফিকহের যেসব কিতাবাদির নাম দেয়া হয়েছে, তাতেও ‘সেকালে বইপত্র ছিল না’ এই ধারনার অপনোদন হয়। শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভীর ছেলে শাহ নুরুল হক দেহলভী ফার্সী ভাষায় বুখারী শরীফের একটি ব্যখ্যাগ্রন্থ লেখেন। তাতে তিনি ফতহুল বারি, উমদাতুল কারী, ইরশাদুস সারি ইত্যাদী গ্রন্থের সাহায্য নেন। এসব ঘটনা থেকে পরিস্কার বুঝা যায় সেযুগেও প্রচুর বইপত্র পাওয়া যেত। এছাড়া ইতিহাসের পাতা ঘেটে সেকালের যেসব কুতুবখানার সন্ধান মিলেছে তাতে এই মত আরো শক্তিশালী হয়। মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত কিছু পাঠাগারের আলোচনা করা যাক :
তাতারখানের কুতুবখানা
তাতারখান। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময়কালের বিখ্যাত আলেম। ফতোয়া তাতারখানিয়ার লেখক। তার নিজস্ব সমৃদ্ধ কুতুবখানা ছিল। তারীখে ফিরোজশাহির ভাষ্যমতে , তার কাছে সবসময় আলেম উলামাদের ভীড় লেগেই থাকতো। তিনি একটি তাফসীরও রচনা করেন। এই তাফসীর রচনার জন্য তিনি প্রচুর তাফসীর গ্রন্থ সংগ্রহ করেন।
গাজীখানের কুতুবখানা দ
গাজী খান ছিলেন সুলতান ইবরাহীম লোদীর দরবারের একজন বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত আমীর। কেল্লার ভেতরে তার নিজস্ব সমৃদ্ধ একটি কুতুবখানা ছিল। ৯৩২ হিজরীতে বাবরের হাতে কেল্লার পতন হলে এই কুতুবখানাও বাবরের হাতে আসে। তুজুকে বাবরীতে বাবর লিখেছেন , ‘সোমবার কেল্লায় ঘুরে বেড়ানোর সময় গাজী খানের কুতুবখানা দেখতে যাই। চমৎকার কিছু কিতাব হাতে পাই। কিছু হুমায়ুনকে দেই বাকিগুলো কামরান মির্জার কাছে কাবুলে পাঠাই। বেশিরভাগই ছিল ধর্মীয় বইপত্র’।
নিজামুদ্দীন আউলিয়ার পাঠাগার
দিল্লীর বিখ্যাত বুজুর্গ নিজামুদ্দীন আউলিয়ার খানকাহে একটি বড় পাঠাগার ছিল। সেই পাঠাগার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। পান্ডুয়ার খানকাহর প্রতিষ্ঠাতা আখি সিরাজ সেই পাঠাগারে পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে অনেক বই পান্ডুয়া নিয়ে আসেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, আখি সিরাজের খানকাহতেই বাংলার প্রথম গ্রন্থাগার গড়ে উঠে।
উসমানপুরের পাঠাগার
আহমেদাবাদে একজন বুজুর্গ ছিলেন শায়খ উসমান (মৃত্যু ৮৫৭ হিজরী) নামে। তিনি সাবেরী নদীর পাড়ে উসমানপুর নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান মুহাম্মদ শাহ গুজরাটির মাধ্যমে তিনি সেখানে একটি মসজিদ ও মাদরাসা নির্মান করেন। মাদরাসার পাশের ভবনে একটি পাঠাগার ছিল যাতে অনেক বইপত্র থাকতো। এই পাঠাগার অনেকদিন টিকে ছিল। পরে মারাঠা হামলায় পাঠাগারটি ধবংস হয়।
বাবরের পাঠাগার
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ছিলেন কবি। সাহিত্যচর্চায় তার প্রচুর আগ্রহ ছিল, কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে। থিতু হয়ে বসার সুযোগ পেয়েছেন কম। জীবনের শেষদিকে কাবুল ও দিল্লীর নিয়ন্ত্রন নেয়ার পর যখনই অবসর হতেন জ্ঞানচর্চায় মগ্ন হতেন। তার নিজস্ব পাঠাগার ছিল।
হুমায়ুনের কুতুবখানা
হুমায়ুন ছিলেন পিতার মতো সাহিত্যবোদ্ধা, কবি । নানাস্থান থেকে আগত কবি সাহিত্যিকদের ভীড় জমেছিল তার দরবারে। প্রায়ই বসতো সাহিত্যের মজলিস। বিখ্যাত তুর্কী এডমিরাল সাইয়েদ আলী রইস তার সফরনামায় বেশ কয়েকবার এসব মজলিসের কথা বলেছেন। হুমায়ুনের নিজস্ব শাহী কুতুবখানা ছিল। তবাকাতে আকবরীর ভাষ্যমতে, ৮ রবিউল আউয়াল সন্ধ্যায় হুমায়ুন শাহী কুতুবখানা থেকে বের হয়ে নিচে নামছিলেন। সিড়িতে তিনি পা পিছলে পড়ে যান। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। এই আঘাতেই তার মৃত্যু হয়।
আকবরের কুতুবখানা
আকবর যদিও খুব বেশি লেখাপড়া করে নি, তবুও তার জ্ঞানপিপাসা ছিল তীব্র। তার দরবারে ভারতবর্ষের সেরা জ্ঞানীগুনিদের সমাবেশ ঘটেছিল। তার শাসনকালেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভারতবর্ষে প্রচুর উন্নতি সাধন করে। আকবর অনুবাদক নিযুক্ত করে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বইপত্র ফার্সীতে অনুবাদ করা শুরু করেন। আকবরের ছিল তীব্র বইয়ের নেশা। নতুন কোনো বইয়ের সন্ধান পেলেই তা সংগ্রহ করতেন। প্রতিরাতে তাকে কেউ একজন বই পড়ে শোনাতে হতো। যতটুকু শুনতেন সেখানে দাগ দিয়ে রাখতেন। পরেরদিন এর পর থেকে শুনতেন। আকবর পৈত্রিক সুত্রেই একটই কুতুবখানা পেয়েছিলেন। এছাড়া গুজরাট, জৈনপুর, বিহার, কাশ্মীর, বাংলা বিজয়ের পর তার হাতে যেসকল বই আসে তাও তিনি এই কুতুবখানায় সংযুক্ত করেন। তার এই কুতুবখানা ছিল আগ্রার কেল্লায়।
জাহাংগীরের কুতুবখানা
অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের মতো জাহাংগীরও ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তার আত্মজীবনি পড়লে এ ব্যাপারে পরিস্কার ধারনা পাওয়া যায়। শাহী কুতুবখানা ছাড়াও তার নিজস্ব কুতুবখানা ছিল। এর দায়িত্বে ছিলেন মাকতুব খান। জাহাংগীর কোথাও সফর করার সময়ও এই কুতুবখানা তার সাথে রাখতেন। তিনি যখন গুজরাট যান তখন সেখানকার উলামায়ে কেরাম তার সাথে দেখা করতে আসেন। তুজুকে জাহাংগীরিতে জাহাংগির লিখেছেন তিনি তাদের সবাইকে এই কুতুবখানা থেকে বিভিন্ন বই, যেমন, তাফসিরে কাশশাফ, তাফসীরে হুসাইনি, রওজাতুল আহবাব ইত্যাদী উপহার দেন।
শাহজাহানের কুতুবখানা
শাহজাহানের একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা ছিল। একজন জার্মান পর্যটক ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে সুরাট ভ্রমন করেন। তিনি তার ভ্রমনকাহিনীতে লিখেছেন শাহজাহানের কুতুবখানায় ২৪ হাজার বই ছিল। ১৬৫৮ সালের পর এই কুতুবখানার বইগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজরা এক বিরাট অংশ নিয়ে যায় লন্ডনে, রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটিতে। এই কুতুবখানার প্রচুর বই ভারতের বিভিন্ন কুতুবখানায় আজো সংরক্ষিত আছে।
আলমগীরের কুতুবখানা
আলমগীরের আমলেও সম্রাটের নিজস্ব কুতুবখানা ছিল। এই কুতুবখানার দায়িত্বে ছিলেন মুহাম্মদ সালেহ। এই কুতুবখানার একটি কোরআন বর্তমানে কলকাতার রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারে আছে।
খানে খানানের কুতুবখানা
খানে খানান মির্জা আব্দুর রহীম ছিলেন বৈরাম খার ছেলে। তিনিও ছিলেন বইপ্রেমিক। তিনি আহমেদাবাদের শাসক থাকাকালীন সেখানে একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা গড়ে তোলেন। বইপত্রের দেখাশোনা, অনুলিপি তৈরী করা , বাধাই করা ইত্যাদী কাজের জন্য প্রচুর কর্মচারী নিয়োগ দেন। মাওলানা ইবরাহীম নুক্কাশ এই কুতুবখানাতেই কর্মরত ছিলেন। সমকালীন সকল লেখকদের বইপত্র এই কুতুবখানায় ছিল। এছাড়াও অনেক দুষ্প্রাপ্য বইপত্র যেমন খাজা হুসাইন সুনায়ির কালাম, দিওয়ানে নাজিরি, দিওয়ানে উরফি সিরাজি, মোল্লা নুরুদ্দীন যহুরির হাতে লেখা কবিতাসমগ্র, মোহাম্মদ ওকুয়ি নিশাপুরীর হাতে লেখা কাসিদার পান্ডুলিপি ইত্যাদিও ছিল। সুলতান হুসাইন লিখিত তাসাউফের বিখ্যাত গ্রন্থ মাজালিসুল উশশাক ৯৯৯ হিজরীতে এই কুতুবখানায় আনা হয়। এই বইতে ১৫২ টি ইরানী চিত্রকলার ছবি আছে। বর্তমানে এই বইটি রামপুরের কুতুবখানায় আছে। আকবর তার সিংহাসনে আরোহনের ২৪ বছর পূর্তিতে খানে খানানকে তাবিরুর রু’ইয়া নামক একটি বই উপহার দেন। সেটিও এই কুতুবখানায় ছিল। বর্তমানে এটি হায়দারাবাদের কুতুবখানা আসফিয়া তে আছে। ৯৩০ হিজরীতে হেরাতের মীর আলী ইউসুফ জুলেখা নামে একটি বই লিখেন। এটিও খানে খানানের কুতুবখানায় ছিল। পরে এটি তিনি জাহাংগীরকে উপহার দেন। জাহাংগির এই বইয়ের উপরের পৃষ্ঠায় কিছু টীকা লেখেন। বর্তমানে বইটি পাটনার বাংকীপুর কুতুবখানায় আছে।
নুরজাহানের কুতুবখানা
নুরজাহানও বই ভালোবাসতেন। তার নিজস্ব কুতুবখানা ছিল। তিনি প্রায়ই বইপত্র কিনে এটি সমৃদ্ধ করতেন। নুরজাহান ৩ মোহর দিয়ে মির্জা কামরানের দেওয়ান সংগ্রহ করেন। এর প্রথম পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন , ‘মূল্য ৩ মোহর। নুরুন নেসা বেগম’। এই লেখা থেকে বোঝা যায় বইটি তিনি নুরজাহান উপাধী পাওয়ার আগে সংগ্রহ করেছেন। বইটি বর্তমানে পাটনার বাংকিপুর কুতুবখানায় আছে।
মুনইম খানের পাঠাগার
ইনি সম্রাট আকবরের শাসনামলে জৌনপুরের শাসক ছিলেন। বই সংগ্রহের নেশা ছিল। গোমতী নদীর উপর একটি সেতু নির্মান করেন। এর পাশেই ছিল তার কুতুবখানা। যখনই কোনো বইয়ের সংবাদ পেতেন, দ্রæত সংগ্রহের চেষ্টা চালাতেন। তার সংগ্রহে মির্জা কামরানের দুষ্প্রাপ্য দিওয়ান এবং কুল্লিয়াতে সাদির একটি কপি ছিল।
ফয়েজির কুতুবখানা
ফয়েজি ছিলেন আবুল ফজলের ভাই এবং মোল্লা মোবারক নাগোরির পুত্র । পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো তিনিও ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী ও বিদ্যানুরাগী। তার নিজস্ব কুতুবখানা ছিল। সেখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দুষ্প্রাপ্য বইপত্র সংগ্রহ করেন। এই কুতুবখানার বেশিরভাগ বইপত্রই ছিল লেখকদের হাতে লেখা। সাহিত্য, চিকিতসা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, তাসাউফ, হাদিস, তাফসীর, ফিকহ ইত্যাদী বিষয়ের বইপত্র ছিল এই কুতুবখানায়। মুনতাখাবুত তাওয়ারিখের বর্ননানুযায়ী মোট বইয়ের সংগ্রহ ছিল ৪৬০০। ফয়েজির মৃত্যুর পর সব বই শাহী কুতুবখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
শেখ ফরীদের পাঠাগার
শেখ ফরীদ বুখারী ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের একজন আমীর। নিজস্ব একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে অনেক বইপত্র সংগ্রহ করেন। দিওয়ানে হাসান দেহলভীর একটি দুষ্প্রাপ্য কপি তার পাঠাগারে ছিল।
কুতুবুল মুলকের কুতুবখানা
শুধু সম্রাট নয় আমীর কিংবা সভাসদরাও ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। তারাও নিজ নিজ গৃহে গড়ে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ কুতুবখানা। কুতুবুল মুলক এমনই একজন। নিজের কুতুবখানার জন্য তিনি প্রচুর পরিমান বই সংগ্রহ করেন। সেকালে তুজুকে জাহাংগিরী খুব একটা পাওয়া যেতো না। তিনি নিজের কুতুবখানার জন্য অনেক কষ্টে এর একটি কপি সংগ্রহ করেন। পরে শাহজাদা সুলতান মুহাম্মদ বিন আলমগীর এই কপিটি নিয়ে যান। বর্তমানে এটি পাটনার খোদাবখশ লাইব্রেরীতে আছে।
নবাব লোহারুর কুতুবখানা
মুঘল শাসনামলের শেষদিকে নবাব লোহারু ছিলেন একজন বিদ্বান ব্যক্তি। তার দরবারেও ঘটেছিল জ্ঞানীগুনিদের সমাবেশ। দিল্লীর বিখ্যাত কবি গালিবের সাথে ছিল তার সুসম্পর্ক। তার নিজস্ব কুতুবখানা ছিল, যাতে বিভিন্ন শাস্ত্রের প্রচুর বইয়ের সংগ্রহ ছিল। দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করা ছিল তার শখ। গালিবের ভাষ্যমতে তাতে বিশ হাজার বই ছিল। ১৮৫৭ সালে আজাদী আন্দোলনের সময় এই কুতুবখানা লুন্ঠন হয়।
গুজরাটের শাহী কুতুবখানা
গুজরাটে যখন স্বাধীন সালতানাত গড়ে উঠলে সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত প্রচার প্রাসার হয়। সুলতান আহমদের (মৃত্যু ৮৪২ হিজরী) শাসনকালে এই ধারা আরো বেগবান হয়। প্রচুর মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ নির্মান করা হয়। সুলতান নিজে একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা গড়ে তোলেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে সুলতান মুহাম্মদ শাহ (মৃত্যু ৮৫৫ হিজরী) এই কুতুবখানার বইপত্র শময়ে বুরহানির ছাত্রদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। এই কুতুবখানা ৯৮০ হিজরী পর্যন্ত টিকে ছিল। আকবর যখন গুজরাট বিজয় করেন তখন এই কুতুবখানার বইপত্র ভাগ করে দেন। এর কিছু অংশ শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী, মোল্লা আব্দুল কাদের বাদায়ুনী, ফয়েজি, ইনারা পান। বাকি বইপত্র শাহী কুতুবখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
খানকাহ সারখিযের কুতুবখানা
শায়খ আহমদ কাঠোরি (মৃত্যু ৮৪৯ হিজরী) আহমেদাবাদে একটি মসজিদ ও খানকাহ নির্মান করেন। তার খানকাহতে একটি কুতুবখানা ছিল। একবার তিনি সেই কুতুবখানা থেকে মাসাবিহুস সুন্নাহ বের করে উপস্থিত লোকদের পড়ে শুনান।
শাহ আলমের কুতুবখানা
গুজরাটের বিখ্যাত বুজুর্গ সাইয়েদ মুহাম্মদ শাহ আলম (মৃত্যু ৮৮০ হিজিরী) একজন উচুমাপের আলেম ছিলেন। অধ্যয়নের প্রচন্ড নেশা ছিল। তার সংগ্রহে প্রচুর দুষ্প্রাপ্য বই ছিল। মাওলানা সদরে জাহান যখন তার সাথে সাক্ষাত করতে যান তখন তিনি ইমাম রাযীর একটি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ দেখান, ইতিপূর্বে মাওলানা সদরে জাহান যার নামও শোনেন নি। শাহ আলমের উত্তরসুরীরা এই কুতুবখানা আরো স¤প্রসারিত করেন। সাইয়েদ জাফর বদরে আলমের সময়কাল ছিল এই কুতুবখানার স্বর্ণযুগ। তিনি নিজের হাতে প্রচুর বইয়ের অনুলিপি তৈরী করে এই কুতুবখানায় যোগ করেন। মারাঠাদের আক্রমনের সময় এই কুতুবখানার প্রচুর বই নষ্ট হয়। কিছু কিছু বই উত্তরাধীকারিদের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
আল্লামা তাহের পাটনীর কুতুবখানা
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা তাহের পাটনীর গৃহে তার নিজস্ব একটি কুতুবখানা ছিল। তিনি আরব ও আজম থেকে প্রচুর বই সংগ্রহ করেছিলেন। কালের আবর্তে সেসব বই হারিয়ে যায়। ১৯৩২ সালেও শায়খ আবু জাফর নদভী সেই কুতুবখানার কিছু বই আল্লামা তাহের পাটনীর বংশধরদের কাছে দেখেছিলেন।
শাহ ওয়াজিহুদ্দীনের কুতুবখানা
আল্লামা শাহ ওয়াজিহুদ্দীন গুজিরাটি (মৃত্যু ৯৯৮ হিজরী) আহমেদাবাদের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের একজন। ৯৩৪ হিজরীতে তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসা ১২৩৬ হিজরী পর্যন্ত টিকে ছিল। মাদ্রাসার সাথেই একটি কুতুবখানা ছিল। দুইটি বড় কক্ষে বইপত্র রাখা ছিল। বিভিন্ন শাস্ত্রের প্রচুর বইপত্র ছিল। সময়ের আবর্তন ও গোমতী নদীর ভাংগনে এই কুতুবখানার বইপত্র হারিয়ে যায়।
সালিমা সুলতানার পাঠাগার
ইনি সম্রাট হুমায়ুনের ভাগ্নি। কবি ছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তুজুকে জাহাঙ্গীরিতে তার যোগ্যতার প্রশংসা করেছেন। বই সংগ্রহের নেশা ছিল। নিজস্ব পাঠাগার ছিল।
মাখদুম ইবরাহীমের কুতুবখানা
কাঠিওয়ারে ১০৯৯ হিজরীতে (১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দ) একটি বড় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শায়খ মাখদুম ইবরাহীম বিন সুলাইমান। এই মাদরাসা উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল। মাদরাসার সাথেই একটি কুতুবখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মাদরাসা বন্ধের পর গত শতাব্দী পর্যন্ত এই কুতুবখানা টিকে ছিল।
মাদরাসা হেদায়েত বখশের কুতুবখানা
আহমেদাবাদে হেদায়েত বখশ নামে একটি মাদরাসা নির্মান করা হয়। মাদরাসার ভেতরে একটি বড় কুতুবখানা গড়ে উঠে, এই কুতুবখানায় সকল শাস্ত্রের বইপত্র ছিল। আলেম উলামা ছাড়া সাধারন মানুষও এই কুতুবখানা থেকে উপকৃত হতো। মারাঠা আক্রমনে এই কুতুবখানার বেশিরভাগ বই নষ্ট হয়। অল্পকিছু বই হায়দরাবাদের পীর মুহাম্মদ শাহ খানকায় সংরক্ষিত আছে।
শায়খ হাযরামীর কুতুবখানা
শায়খ হাযরামী (মৃত্যু ১০৩৮ হিজরী) ছিলেন আহমেদাবাদের বিখ্যাত বুজুর্গ। বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আন নুরুস সাফির ফি আইয়ানিল করনিল আশির’ এর রচয়িতা তিনি। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে প্রচুর বই ছিল।
মহিসুরের শাহী কুতুবখানা
নওয়াব হায়দার আলী যখন মহিসুরে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন , তখন সেখানে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা বৃদ্ধি পায়। তার পুত্র টিপু সুলতানও ছিলেন পিতার মতো বিদ্যানুরাগী। তিনি মহিসুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বড় একটি কুতুবখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে টিপু সুলতান যখন শহীদ হন এবং শ্রীরংগাপত্তম ইংরেজদের দখলে আসে তখন শাহী মহলের অন্য সবকিছুর মতো এই কুতুবখানাও ইংরেজরা লুন্ঠন করে। বেশিরভাগ বইপত্র লন্ডনের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে ম্যাজিস্ট্রেট অবশিষ্ট বইপত্রের তালিকা প্রকাশ করেন। তা নিম্মরুপ :
কুরআনুল কারীম — ৪৪ টি
হাদিস গ্রন্থ — ৪২ টি
গনিত– ৭৫ টি
তাসাউফ — ৫২ টি
হিন্দী কবিতার বই– ২৩ টি
চিত্রকলা — ১৯ টি
জ্যোতির্বিদ্যা –২০ টি
ভাষা সংক্রান্ত — ৪৫ টি
কবিতা — ১৯ টি
ফিকহ — ৯৫ টি
তাফসীর– ৪১ টি
চিকিতসা শাস্ত্র– ৬২ টি
আখলাক সংক্রান্ত — ২৪ টি
দর্শন– ৫৪ টি
সাহিত্য — ১৮ টি
অভিধান — ২৯ টি
মাদরাসা আরাবিয়ার কুতুবখানা
বিহারের অন্তর্গত সাসারাম একটি বিখ্যাত জায়গা। শেরশাহ এখানেই জন্মগ্রহণ করেন। হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুতে শাহ কবীর দরবেশ নামে একজন বুজুর্গ এখানে একটি খানকাহ ও মাদরাসা নির্মান করেন। মাদরাসার নাম মাদরাসা আরাবিয়্যা। এই মাদরাসায় একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা ছিল। এই কুতুবখানা ‘৪৭ এর দেশভাগের সময় লুন্ঠিত হয়।
সাদেকপুরের কুতুবখানা
মৌলভী আহমদ উল্লাহ সাহেব পাটনার সাদেকপুরে একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর এই কুতুবখানার বেশিরভাগ বইপত্র লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। অল্পকিছু বইপত্র বর্তমানে পাটনার খোদা বখশ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।
ফারুকীদের শাহী কুতুবখানা
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকালের শেষদিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন সালতানাত গড়ে উঠে। এমনই একটি সালতানাত ফারুকী সালতানাত। হিজরী সপ্তম শতাব্দীর শেষদিকে এই সালতানাত গড়ে উঠে। ১০০৫ হিজরীতে আকবরের হাতে এই সালতানাতের পতন হয়। ফারুকিরাও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে ছিল। তাদেরও ছিল সমৃদ্ধ কুতুবখানা। ঐতিহাসিক আবুল কাসিম ফেরশতা ১০১৩ হিজরীতে এই কুতুবখানা সফর করেন এবং বইয়ের সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন।
লখনৌর কুতুবখানা
মুঘলদের সূর্য অস্তমিত হলে লখনৌতে গড়ে উঠে নবাবদের শাসন। তাদের হেরেমে উপড়ে পড়ে জীবনের হাসি-কান্না। তাদের দরবারের ভীড় করতে থাকে কবি সাহিত্যিকরা। লখনৌ হয়ে উঠে কবিদের শহর, কবিতার শহর। এ সময় লখনৌতে প্রচুর মাদরাসা গড়ে উঠে। প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রচুর কুতুবখানা। শাহী কুতুবখানা ছিল গোমতি নদীর তীরে, রোমি দরজার পাশে। ১৮৫৭ সালে একজন ইংরেজ অফিসার এই কুতুবখানা দেখেছিলেন। পরে অবশ্য এটি লুট করা হয়। মোতীবাগ মহলে ছিল আরেকটি কুতুবখানা। এখানে বেশিরভাগই ছিল সাহিত্যের বইপত্র। এখানে তিন হাজারের বেশি বই ছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য কুতুবখানা ছিল ফররুখ বখশ মহলে। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর আদেশে শাহী কুতুবখানার বাইরে এই কুতুবখানা গড়ে তোলা হয়। এইসব কুতুবখানায় আরবী, ফার্সী, উর্দু, হিন্দী, সংস্কৃত, তুর্কী এবং পশতু ভাষার বইপত্র ছিল। সাহিত্য ছাড়াও ইতিহাস, তাসাউফ ও জীবনিগ্রন্থ ছিল। লখনৌর বিখ্যাত এলাকা কাকোরিতেও অনেক কুতুবখানা গড়ে উঠে। একটি কুতুবখানা ছিল আমীর মহলে ।আউধের বিখ্যাত শহর ফিরিংগী মহল। এখানেই জন্ম নিয়েছেন মোল্লা নিজামুদ্দীন ফিরিংগি মহল্লী, যার নামে প্রবর্তিত হয়েছে দরসে নেজামি। এখানে জন্মেছেন প্রচুর উলামায়ে কেরাম। ইতিহাস যাদের স্মরণ করে ‘উলামায়ে ফিরিংগী মহল’ নামে । মোল্লা নিজামুদ্দিন এখানে একটি মাদরাসা ও বড় কুতুবখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ফিকহের প্রচুর বই ছিল। লখনৌর কাছাকাছি একটি শহর সলীমগড়। এখানের শাসনকর্তাকে রাজা নামে ডাকা হতো। সলীমগড়ের রাজা একটি বড় কুতুবখানা প্রতিষ্ঠা করেন যাতে প্রায় সকল শাস্ত্রের বইপত্র ছিল। এখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য বইপত্র ছিল। ফেরদৌসির শাহনামার একটি কপি ছিল যার ততকালীন মূল্য ছিল ১০ হাজার
বিলগ্রামের কুতুবখানা
শুরু থেকেই বিলগ্রামে প্রচুর আলেম উলামা জন্মগ্রহন করেছেন। ইলমের আলোয় আলকিত করেছেন চারপাশ। শায়খ আব্দুল ওয়াহেদ, শায়খ নিজাম, কাজী মাহমুদ, কাজী কামাল, মীর আব্দুল ওয়াহেদ, মুফতী আমীর হায়দার, সাইয়েদ গোলাম আলী আজাদ প্রমুখ ছিলেন বিলগ্রামেরই বাসিন্দা। ইলমচর্চার প্রচার প্রসারের কারনে বিলগ্রামেও গড়ে উঠেছিল প্রচুর কুতুবখানা। কাজী আবুল ফাতাহ শায়খ কামাল ছিলেন আকবরের শাসনকালে বিলগ্রামের কাজী। তার নিজস্ব কুতুবখানা ছিল । সেখানে সরফ, নাহু, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, তাফসির, অলংকার শাস্ত্রের প্রচুর বই ছিল। কাজী সাহেবের হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। তিনি নিজের হাতের প্রচুর বইয়ের অনুলিপি প্রস্তুত করেন। আব্দুল ওয়াহেদ বিলগ্রামীর সংগ্রহেও প্রচুর বই ছিল। সাইয়েদ আব্দুল্লাহ বিলগ্রামী তার ব্যক্তিগত কুতুবখানায় প্রচুর দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করেছিলেন। শাহ তৈয়ব নামক একজন আলেমের কুতুবখানাতেও প্রচুর বই ছিল। নবাব মীর আলমগীরের সংগ্রহেও একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা ছিল।
রামপুরের কুতুবখানা
মুঘল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হলে রোহিলাখন্ডে কয়েকটি স্বাধীন রিয়াসত প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনই একটি রিয়াসত রামপুরের রিয়াসত। নবাব ফয়জুল্লাহ খানের সময়ে এখানে একটি কুতুবখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় বইপত্রের অনুবাদ ও অনিলিপি প্রস্তুতের কাজ। নবাব সাইয়েদ মুহাম্মদ সাইদ খানের সময় এই কুতুবখানার জন্য এক হাজার চারশো স্বর্নমুদ্রার বই ক্রয় করা হয়। এই সময় হুমায়ুন নামা, আকবরনামা, খাজানাতুল আলম, তারীখে নাদেরী, খুলাসাতুত তাওয়ারিখ, তারীখে জাহান খফী, তারীখে মজমায়ে মাহফিল, ইত্যাদী ইতিহাস গ্রন্থ ঐ কুতুবখানায় ছিল। নবাব সাইয়েদ মুহাম্মদ ইউসুফের সময় এই কুতুবখানার জন্য দুই হাজার সাতশো রুপী সমমূল্যের বই ক্রয় করা হয়। নবাব কলব আলী খানের সময় ৪৩ হাজার ছয়শো আট রুপীর বই কেনা হয়। তাফসীর, হাদিস, আসমাউর রিজাল, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, ইলমুল কালাম, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, রসায়ন, চিকিতসাবিদ্যা, সাহিত্য, অলংকারশাস্ত্র, অভিধান, নাহু, সুরফ এসব বিষয়ে প্রচুর বই ছিল এই কুতুবখানায়। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী এই কুতুবখানায় ২৪১১৫ টি বই ছিল।
জৌনপুরের কুতুবখানা
তুঘলকদের রাজত্ব শেষ হলে জৌনপুরে গড়ে উঠে স্বাধীন শর্কী সালতানাত। শর্কীরা কনৌজ থেকে বাংলা পর্যন্ত খাজনা আদায় করতেন। এই সালতানাত খুব দ্রæতই সমৃদ্ধ হতে থাকে। এখানে গড়ে উঠে প্রচুর মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ। এই সময়ে জৌনপুরে অন্তত ১৪ টি মাদরাসা গড়ে উঠে। যেখানে সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেমরা পড়াতেন। এখানেও প্রচুর কুতুবখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মৌলভী মাশুক আলীর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ৫ হাজার বই ছিল। শাহজাহানের সময় জৌনপুরের মুফতী ছিলেন মুফতী সাইয়েদ আবুল বাকা। তিনি ছিলেন তার যুগে স্মরনশক্তির জন্য বিখ্যাত। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহেও প্রচুর বই ছিল।
আদীল শাহী কুতুবখানা
বাহামনি সাম্রাজ্যের পতন হলে দক্ষিনাত্যে ৫ টি নতুন সালতানাত গড়ে উঠে। বারিদ শাহী, কুতুব শাহী, নিজাম শাহী , আদিল শাহী ও ইমাদ শাহী সালতানাত। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল আদিল শাহী সালতানাত। ইরানের শাসকদের সাথে তাদের সুসম্পর্ক ছিল। ইরাক, পারস্য ও আজারবাইজান থেকে প্রচুর জ্ঞানিগুনি বিজাপুর আগমন করেন। এখানেও অন্যান্য অঞ্চলের মতো প্রচুর মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ নির্মান করা হয়। বিজাপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় শাহী কুতুবখানা।এই কুতুবখানায় ৬০ জন কর্মচারী ছিল। স্বয়ং আদীল শাহের নিজস্ব একটি কুতুবখানা ছিল যা তিনি সফরের সময়েও তার সাথে রাখতেন। সেখানে বড় বড় চারটি সিন্দুকে বইপত্র ছিল।
সেকালেও কুতুবখানা পরিচালনার জন্য লোক নিয়োগ দেয়া হতো। একজন লাইব্রেরিয়ানের অধিনে থাকতো আরো কিছু পদ। মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহের বাইরে সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে যেসব কুতুবখানা নির্মান করা হতো তার জন্য আলাদা ভবন নির্ধারন করা হতো। ভবন নির্মানের সময় আলোবাতাসের প্রতি খেয়াল রাখা হতো। কুতুবখানার সর্বোচ্চ পরিচালককে বলা হতো নাজেম। তাকে কখনো কখনো মুতামিদও বলা হতো। এর পরের পদটি ছিল মুহতামিমের । তার কাজ ছিল নাজেমের তত্ত¡াবধানে কুতুবখানার দেখভাল করা। এই পদের অধিকারী হতে যোগ্যতার প্রয়োজন হতো। বিভিন্ন শাস্ত্রের বইপত্র ও লেখক সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হতে হতো। মুহতামিমের একজন সহকারী থাকত, যাকে নায়েব বলা হতো। কুতুবখানা দেখভাল করা ছাড়াও বইপত্র নির্বাচন করা, ক্রয় করা এবং শাস্ত্রীয় বিচারে সেগুলো বন্টন করা এসব মুহতামিমের দায়িত্বে ছিল। মুহতামিমের অধিনে কয়েকজন মুন্সী বা ক্লার্ক থাকতো, যাদের কাজ ছিল রেজিস্টার বইতে বইপত্রের নাম তালিকা করা, বইতে নাম্বার লাগানো ইত্যাদী। আরো কিছু কর্মচারি থাকতো যাদেরকে সাহহাফ বলা হতো। এদের কাজ ছিল তাক থেকে বই বের করা, ধুলোবালু পরিস্কার করা, বইয়ের কোনো পাতা নষ্ট হলে সেটা আলাদা করা। বই বাধাইয়ের কাজেও কয়েকজন কর্মচারী নিয়োগ করা হতো। আরো থাকতো মুসাওইয়ির বা চিত্রশিল্পী, যারা বইয়ের প্রচ্ছদে সুন্দর সুন্দর ছবি একে দিতেন। আরেকটি পদ ছিলো লিপিকারকদের । প্রতিটি কুতুবখানাতেই কয়েকজন লিপিকারক থাকতো যাদের কাজ হতো বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা বইয়ের অনুলিপি প্রস্তুত করা। তাদের অনুলিপি সমাপ্ত হলে বইটি পাঠানো হতো মুসাহহির কাছে। তিনি মূল বইয়ের সাথে মিলিয়ে দেখতেন কোথাও কোনো ভুল হয়েছে কিনা। কিছু কিছু কুতুবখানায় আরেকটি পদ ছিল জাদওয়াল সাজ। যারা বইয়ের সূচীপত্রে বিভিন্ন ডিজাইন করতেন। বেতনের বিচার করলে নাজেমের পর সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন মুহতামিম। তারপর নায়েবে মুহতামিম ও অন্যান্যরা।
তথ্যসূত্র :
১। মিন রাওয়াউই হাদারাতিনা– ড. মোস্তফা আস সিবাঈ
২। মাশরেকি কুতুবখানা — আব্দুস সালাম নদভী
৩। আল কিতাব ফিল হাদারাতিল ইসলামিয়া– ড ইয়াহইয়া ওহিব জুবুরী
৪। হিন্দুস্তান কে মুসলমান হুকুমরানো কে আহদ কে তামাদ্দুনি কারনামে — দারুল মুসান্নেফিন , আযমগড়
৫। তারিখুস সাক্বাফাতুল ইসলামিয়া — ওয়াজেহ রশীদ নদভী
৬। আহসানুত তাকাসিম ফি মারিফাতিল আকালিম, — আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বিন আহমদ মাকদিসী।
৭। হিন্দুস্তান মে মুসলমানো কা নেজামে তালিম ও তরবিয়ত– সাইয়েদ মানাজির আহসান গিলানী।
৮। ওয়াররাকু বাগদাদ ফিল আসরিল আব্বাসি – ড খাইরুলাহ সাইদ
৯। মাওসুআতুল ওয়াররাকাহ ওয়াল ওয়াররাকিন- – ড খাইরুল্লাহ সাইদ
১০। দুহাল ইসলাম– ড. আহমদ আমিন।
১১। কিসসাতু আন্দালুস– ড. রাগেব সিরজানি
১২। মা যা কদ্দামাল মুসলিমুনা লিল আলম– ড. রাগেব সিরজানি
১৩। জামিয়া নিজামিয়া বাগদাদ কা ইলমি ওয়া ফিকরি কিরদার, এক তাহকিকি জায়েযা – ড. সুহাইল শফীক