বাসায় ফেরার পথে শুনলাম পাশে কোথাও ওয়াজ হচ্ছে। একবার ভাবলাম যাবো, পরে আবার মত বদলাই। কদিন ধরে জ্বরে ভুগছি। শরীর বেশ দূর্বল। এই ভেবে আর গেলাম না। এক সময় প্রচুর ওয়াজ শুনেছি। অন্তত এদেশের প্রসিদ্ধ বক্তাদের কারো ওয়াজ শোনা বাকি নেই। সবচেয়ে ভালো লাগতো শীতকালে, গ্রামাঞ্চলে ওয়াজ শুনতে। মামাতো ভাইদের সাথে দলবেধে তিন চার মাইল দূরে চলে যেতাম ওয়াজ শুনতে। শেষ বিকেলে নামতো হালকা কুয়াশা। ফসলের মাঠে পেরিয়ে দুরের গ্রামগুলো ঝাপসা হয়ে যেত। খালের পানিতে মৃদু আলোড়ন। আমরা মাটির রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে নানা গল্প করতাম। মাহফিলে প্যান্ডেলের নিচে থাকতো খড়। বাদাম বুট নিয়ে বসে যেতাম। বাদাম বুট খেতে খেতে ওয়াজ শুনতাম। নখ দিয়ে খড় কুটিকুটি করতাম। রাত বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশা বাড়তো, আমরা মাফলার আর শাল ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিতাম, ওদিকে বক্তার কন্ঠও হয়ে উঠতো করুণ। বেশ লাগতো। মাহফিল শেষ হতো মধ্যরাতে। ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে হেটে আসতাম আমরা।
সেই দিনগুলি আর নেই। বন্ধুরা সবাই এখন বেশ ব্যস্ত। ওয়াজ মাহফিলের প্রতিও আকর্ষণ কমে এসেছে নানা কারণে। ওয়াজ মাহফিল নিয়ে লোকজনও এখন বেশ দ্বিধাবিভক্ত। কিছু কিছু ওয়ায়েজের স্বেচ্ছাচারিতায় বিরক্ত হয়ে অনেকে ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্বকেই অস্বীকার করে বসছেন। আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত শিথিলতা দেখিয়ে একটি বিশেষ শ্রেনিকে বেপরোয়া হয়ে উঠার সুযোগ করে দিচ্ছেন। বিশেষ করে সুযোগসন্ধানী ইউটিউবারদের উদ্ভট সব ক্যাপশন আর কিছু অর্থলোভী জোকার বক্তাদের কারনে এখন ওয়াজ মাহফিল শুনলেই মনে হয় উদ্ভট কিছু মানুষের বিচ্ছিরি কান্ডকীর্তি।
ওয়াজ শব্দের শাব্দিক অর্থ উপদেশ, নসিহত। মূলত ওয়াজ হলো, মানুষের মধ্যে দ্বীনি ইলম প্রচার ও মানুষকে ঈমান আমলের প্রতি মনোযোগী করার একটি পদ্ধতি। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে,
وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَىٰ تَنفَعُ الْمُؤْمِنِينَ
তুমি উপদেশ দিতে থাকো, কারন উপদেশ মুমিনদেরই উপকারে আসে। (সুরা যারিয়াত, আয়াত ৫৫)
ওয়াজ মাহফিল এই আয়াতের নির্দেশের উপর আমল করার শক্তিশালী মাধ্যম। তবে ওয়ায়েজদেরও কিছু যোগ্যতা অর্জন করা আবশ্যক। তাদের কোরআন, হাদিস ও ফিকহের উপর তাদের পারদর্শিতা থাকা আবশ্যক। ইখলাসের সাথে সঠিক কথা বলার সঠিক পদ্ধতী রপ্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ। ইখলাসের সাথে উম্মাহর কল্যানের জন্য যেকথা বলা হয় তা মানুষের অন্তরে রেখাপাত করে।
তাবেয়ী উবাইদ বিন উমাইরের কথাই বলা যায়। তিনি মক্কায় বসবাস করতেন। ৬৮ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার ওয়াজের মজলিসে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বসতেন। উবাইদ বিন উমাইরের আলোচনায় প্রভাবিত হয়ে তিনি কান্নাও করতেন। (১)
ইবনে যুবাইর আন্দালুসি ৫৮১ হিজরীতে জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদের এক ওয়াজের মজলিসে বসেছিলেন। তিনি তার ভ্রমনকাহিনীতে সেই মজলিসের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে, আমরা প্রথমে জামিয়া নিজামিয়ার উস্তাদ শায়খ রাযিউদ্দিন কাযভিনির ওয়াজে বসি। দিনটি ছিল ৫ই সফর। শায়খ হাদিস ও তাফসির থেকে ওয়াজ করছিলেন। তার কথা শুনে শ্রোতারা কান্না করছিল। পুরো মজলিসে ছিল কান্নার রোল। লোকজন পাপাচার থেকে তওবা করছিল। কেউ কেউ লিখিত প্রশ্ন করছিল। শায়খ এসকল প্রশ্নের জবাব দেন। (২)
শায়খ আবুল কাসেম কুশাইরি যখন নিশাপুরের মুতাররায মসজিদে ওয়াজ করতেন তখন শ্রোতারা তন্ময় হয়ে শুনতো। তার ওয়াজ সম্পর্কে একজনের বক্তব্য ছিল, যদি শয়তানও তার মজলিসে বসে, তাহলে হয়তো সেও তওবা করে ফেলবে। (৩)
ইবনুল জাওযি রহিমাহুল্লাহ যখন বাগদাদে ওয়াজ করতেন তখন শ্রোতাদের কেউ কেউ বেহুশ হয়ে যেত। অনেকেই কান্না করতো। অন্তত বিশ হাজার ইহুদি-খ্রিস্টান তার হাতে কালিমা পড়ে মুসলমান হয়েছিল। তওবা করেছিল প্রায় এক লক্ষ লোক। (৪)
হাসান বসরির ওয়াজের মজলিসের কথাও ইতিহাসে বিখ্যাত। ওয়াজের মজলিস থেকেই তিনি জনগনের সংশোধনের কথা আলোচনা করেছেন। আবার হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মত জালিম শাসকের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণ থেকেও বিরত থাকেননি। (৫)
সমকালিন জনজীবনে এসব ওয়াজ মাহফিলের প্রভাব ছিল অপরিসীম। ইবনুল জাওযির ওয়াজে কখনো কখনো এক লক্ষ মানুষও হতো। ইমাম গাজালি যখন জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদে ওয়াজ করতেন তখন প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ একত্রিত হত। (৬) সে সময় আলেমরা মুসলিম বিশ্বের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে নিয়মিত সফর করতেন। নতুন কোনো শহরে গেলে সেখানে হাদিসের দরসে বসতেন, অথবা হাদিসের দরস দিতেন। কখনো কখনো তাদের ওয়াজের মজলিস অনুষ্ঠিত হত। ঈসা বিন আবদুল্লাহ গযনভী ৪৯৫ হিজরীতে বাগদাদে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি বেশকিছু মজলিসে ওয়াজ করেছিলেন। (৭)
ভারতবর্ষে সুলতানি আমল থেকেই ওয়াজের প্রচলন ছিল। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালে নাসিরুদ্দিন নামে একজন বিখ্যাত ওয়ায়েজ ছিলেন। সুলতান তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। সুলতান তার বসার জন্য একটি মিম্বর নির্মান করে দেন। সুলতান নিজেও তার ওয়াজে বসতেন। ওয়াজ শেষে তার সাথে কোলাকুলি করতেন। হিজরী নবম শতাব্দীতে মাওলানা শোয়াইব দিল্লীতে ওয়াজ করতেন। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী তার প্রশংসা করেছেন। মাওলানা আলাউদ্দিন আউধি দিল্লীতে ওয়াজ করতেন। ওয়াজে তারা কবিতাও আবৃত্তি করতেন। যেমন শায়খ তকিউদ্দিন তার ওয়াজে চান্দায়ন নামে একটি গ্রন্থ থেকে হিন্দী কবিতা আবৃত্তি করতেন। (৮)
তবে শুরু থেকেই ওয়ায়েজদের একাংশের প্রবনতা ছিল আজগুবি গল্প-কাহিনী বলে জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষন করা। এভাবেই অনেক জাল হাদিস ও বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনীর সূচনা হয়। এই ধরনের গল্পকারদের বলা হতো কাসসাস। জালালুদ্দিন সুয়ুতি এই ধরনের গল্পকারদের সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করে লিখেছেন, ‘তাহজিরুল খাওয়াছ মিন আকাজিবিল কাসসাস’ নামক গ্রন্থ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া এইসব গল্পকারদের বানোয়াট হাদিসগুলো একত্রিত করে দিয়েছেন ‘আহাদিসুল কাসসাস’ নামক গ্রন্থে।
ইবনুল জাওযি এ ধরনের ওয়ায়েজদের সম্পর্কে লিখেছেন, ওয়ায়েজদের অনেকের কথাই অন্তসারশূন্য। তাদের ওয়াজের বিরাট অংশ হজরত মুসা (আ) ও তুর পাহাড়ের কাহিনী এবং ইউসুফ (আ) ও জুলায়খার কাহিনী দিয়ে ভরপুর। এসব ওয়াজ নসিহতে ইসলামের ফরজ বিধান নিয়ে আলোচনা নেই, কী করে গোনাহ থেকে বাচা যায় তা নিয়েও আলোচনা নেই, তাহলে এসব ওয়াজ দ্বারা কী করে একজন সুদখোর ও ব্যাভিচারী তওবা করতে আগ্রহী হবে? ওয়ায়েজরা শরিয়তকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে, ফলে তাদের আয় বেড়েছে………। (৯)
এক সময় এই অঞ্চলে মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরির ওয়াজের মাধ্যমে হাজারো মানুষের জীবন বদলে গিয়েছিল। (১০) পরবর্তীতে এই ধারায় মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিসবাহ (র), মাওলানা সিদ্দিক আহমদ চাটগামি (র), মাওলানা আবদুল গাফফার ঢাকুবী (র), মাওলানা আবদুর রহমান জামি (র), মাওলানা দেলোয়ার হুসাইন সাইদি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। কিন্তু কিন্তু ধীরে ধীরে ওয়াজ মাহফিলগুলো হয়ে উঠেছে অন্তসারশূন্য। বেশিরভাগ শ্রোতার আকর্ষণ কিচ্ছা-কাহিনী ও সুরের মূর্ছনার দিকে। বাজারদর বাড়াতে এক শ্রেনীর বক্তাও শ্রোতাদের চাহিদা পূরনে বদ্ধপরিকর। ওয়াজের চেয়ে আওয়াজ করাটাই হয়ে উঠছে মূখ্য উদ্দেশ্য। যোগ্য আলোচকদের চেয়ে অযোগ্যদের জনপ্রিয়তাই বেশি।
তবে চাইলেই পরিস্থিতি বদলানো যায়। আলোচকদের অনেকেই এখন দলিল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার দিকে ঝুকছেন। পথটি কঠিন , তবে শ্রোতাদের অভ্যস্ত করে তুলতে পারলে পুরো ময়দানের চেহারাই বদলে যাবে।
বিশেষ করে আয়োজকদের কিছু বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। জনতার চাহিদার দিকে না তাকিয়ে যার আলোচনায় জনগনের ঈমান আমলের ফায়দা হবে তাকেই আমন্ত্রণ করা উচিত। নিজ মতের বিরুদ্ধে কাউকে পেলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে গর্জে উঠে ময়দানে ঝড় তোলা বক্তাদেরকে পরিত্যাগ করা উচিত। শহরাঞ্চলে মাঠের বাইরে অনেকদূর পর্যন্ত মাইক লাগিয়ে জনগনের ভোগান্তি বাড়ানো হয়, আয়োজকরা চাইলেই এটি পরিহার করতে পারেন।
সূত্র
——————-
১। লামাহাত মিন তারিখিস সুন্নাতি ওয়া উলুমিল হাদিস, পৃষ্ঠা ১০৮– শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ।
২। রিহলাহ, ১৯৬ পৃষ্ঠা– ইবনে যুবাইর আন্দালুসী।
৩। আল হায়াতুল ইলমিয়্যা ফি নিসাবুর, ২৩৪ পৃষ্ঠা– মুহাম্মদ ফাজালু।
৪। তারিখে দাওয়াত ও আযিমত, ১ম খন্ড, — আবুল হাসান আলী নদভী।
৫। বিস্তারিত জানতে দেখুন, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮ম খন্ড, ২৪১ পৃষ্ঠা– হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাবী
৬। জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদ ইলমি ওয়া ফিকরি কিরদার, ২৩৪ পৃষ্ঠা –ড সুহাইল শফিক
৭। আল মুন্তাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম, ৯ম খন্ড, ১৩১ পৃষ্ঠা– ইবনুল জাওযি।
৮। হিন্দুস্তান মে মুসলমানো কা নেজামে তালিম ও তরবিয়ত, ১ম খন্ড, ২৬৬-২৭০ পৃষ্ঠা– মানাজির আহসান গিলানী। সাইয়েদ আবদুল হাই হাসানি নদভী তার রচিত নুজহাতুল খাওয়াতির নামক গ্রন্থে ভারতবর্ষের অনেক ওয়ায়েজের জীবনি আলোচনা করেছেন।
৯। তালবিসু ইবলিস, ১২১ পৃষ্ঠা– ইবনুল জাওযি।
১০। তার জীবনি জানতে দেখুন, রিজালুন সানাউত তারিখ — মিজান হারুন। প্রকাশক দারুল বায়ান, ঢাকা।