চেঙ্গিস খান – স্তেপের যোদ্ধা

১৫০০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ গোবি মরুভূমিতে (১) যতদূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। মাঝে কোথাও কোথাও উঁচু পাথুরে টিলা কিংবা শুকিয়ে যাওয়া লতাগুল্ম চোখে পড়ে। জীবন এখানে কঠিন। মরুচারী গোত্রগুলোকে তাই প্রায়ই খাবারের সন্ধানে জায়গা বদল করতে হয়। গ্রীষ্মকালে এখানে আগুন ঝরায় সূর্য। পায়ের নিচে বালি তেতে ওঠে। বইতে থাকে লু হাওয়া। আবার শীতে উত্তর থেকে শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। বসন্তকাল এখানে বয়ে আনে সুসময়। মাদী ঘোড়া আর গাভীগুলো তখন হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে। নিয়মিত দুধ দেয়। এ সময় পর্যাপ্ত শিকারের দেখাও মেলে। শিয়াল, মারটেন, স্যাবল ও হরিণ শিকার করে ঘরে ফেরে পুরুষেরা। তবে শীতকালে দেখা দেয় খাদ্যসংকট। তীব্র শীতে বের হয়ে শিকার করা কঠিন। পশুদের দুধ শুকিয়ে যায়। তাই খাবার বলতে গুদামজাত করে রাখা শুকনো মাংসই একমাত্র ভরসা।

এখানে খাবারের ক্ষেত্রে রয়েছে অদ্ভুত নিয়ম। প্রথমে খেতে বসবে শক্তসামর্থ্য লোকেরা। তারপর আসবে মহিলা ও বৃদ্ধরা। সবার শেষে শিশুরা। তারা পরস্পর মারামারি করে হাড় ও বেঁচে যাওয়া মাংস খুঁজে নেবে। মরুঝড় থেকে বাঁচার জন্য রয়েছে গোলাকার গম্বুজাকৃতির তাঁবু। এর নাম ইয়র্ট। গরুর গাড়িতে বেধে এই তাঁবু সহজেই সরানো যায়। গোত্রগুলো যখন খাবারের সন্ধানে স্থান পরিবর্তন করে, তখনই তারা ইয়র্টসহ নিজেদের আবাসস্থল সরিয়ে নেয়।

এখানে পানির সন্ধান সহজে মেলে না। কোথাও পানি পেলেও তা দখল করতে হয় অন্য গোত্রের সঙ্গে লড়াই করে। প্রতিটি গোত্রের জন্য তাই একজন সাহসী, বুদ্ধিমান গোত্রপতি আবশ্যক।
মরুর কঠিন জীবন এখানকার বাসিন্দাদের দিয়েছে কাঠিন্যতা। কখনো কখনো খাবারের অভাবে টানা কয়েকদিন উপোস কাটাতে হয়। ঘোড়ায় চড়তে হয় একটানা। থামার ফুরসত পাওয়া যায় না কয়েক দিনেও। এখানকার বাসিন্দাদের চেহারা লাল বর্ণের, খর্বাকৃতির নাক ও ছোট দাড়ি তাদের দিয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। সবার চেহারাই এক ধরনের ফলে বাহিরের কেউ এখানে মিশে যাবার সুযোগ নেই।
বৈকাল হৃদ থেকে মাঞ্চুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সবুজ ভূমি। এখানে বাস করে সবচেয়ে বড় গোত্র মোঙ্গল। এখানে গাছপালার পরিমাণ অন্য এলাকার চেয়ে বেশি। গোবির উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত এই এলাকা যেন ধূসর মরুর মাঝে একটুকরো জান্নাত। এখানের পাহাড়গুলো বার্চ আর ফার গাছে ঢাকা। শিকারের সন্ধান মেলে সহজেই।

৫৪৯ হিজরি তথা ১১৫৪ খ্রিষ্টাব্দ। মোঙ্গল সরদার ইয়েসুকির ঘরে জন্ম নিল পুত্র তেমুজিন। ইয়েসুকি প্রভাবশালী মোঙ্গল গোত্রপতি। তার নিয়ন্ত্রণে আছে ৪০ হাজার তাঁবু। তেমুজিনের জন্মে আনন্দে মেতে উঠে ইয়েসুকির গোত্র। সর্দারের পুত্রের খাতির-যত্নে কমতি করেনি কেউই। তেমুজিন বড় হয়। এখন সে পিতার সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ায়। তার উচ্চতা ও চওড়া কাঁধ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সে যখন ঘোড়া ছুটায় তখন তার পিঠে আছড়ে পড়ে লম্বা বাদামি চুল।

তেমুজিনের ১৩ বছর বয়সে শত্রুদের হামলায় পিতা ইয়েসুকি মারা গেলেন। বালক তেমুজিনের ওপর ভরসা করতে না পেরে গোত্রের লোকেরা সরে গেল নানা দিকে। তেমুজিনের মা হৌলুন আর ভাই কিসার ছাড়া আর কেউ পাশে রইল না। এ সময় বিপক্ষ গোত্রের লোকেরা তেমুজিনকে বন্দি করে। তেমুজিন দ্রুত নিজেকে মুক্ত করে গ্রামে ফিরে আসে। এখানে সে ক্ষুধার্ত ও আতংকিত পরিবারের সদস্যদেরকে খুঁজে পায়। তেমুজিন চাইলে নিজের পিতৃভূমি ত্যাগ করে পালাতে পারত; কিন্তু সে এখানে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। শীঘ্রই তার সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে চলে যাওয়া গোত্রগুলো আবার তার পাশে সমবেত হলো। ১৭ বছর বয়সে তেমুজিন বিয়ে করল কিশোরী বৌরতাইকে। ১৪ বছর বয়সি বৌরতাই বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিল শান্ত, নীরব। তখন কে-ই-বা জানত একদিন এই বালিকা ইতিহাসে পরিচিত হবে সম্রাজ্ঞী বৌরতাই নামে। রোম সাম্রাজ্যের চেয়েও আয়তনে বড় এক সাম্রাজ্য শাসন করবে তারই তিন ছেলে।

তেমুজিনের দিনগুলো সহজ ছিল না। বিয়ের কিছুদিন পরেই পুরানো শত্রুদের আক্রমণে তেমুজিন বৌরতাইকে হারালেন, তাকে অপহরণ করে নিয়ে গেল শত্রুরা। তবে তেমুজিনের পালটা আক্রমণে বৌরতাইকে উদ্ধার করা হয়। ইতিমধ্যে তার গর্ভে এসেছে প্রথম সন্তান জোচি খান। যদিও বৌরতাইয়ের প্রতি তেমুজিনের ভালোবাসায় কমতি হয়নি কখনো, তবু জোচি খানের পিতৃপরিচয় নিয়ে তার মনে খানিকটা দ্বিধা ছিলই।

ক্রোধ, কৌশল, ধূর্ততা এসব ছিল তেমুজিনের স্বভাবজাত। বয়সপ্রাপ্তির সঙ্গে তা কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছিল। তরুণ তেমুজিন ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছেন খান নামে। তার অধীনে এখন রয়েছে ১৩ হাজার যোদ্ধা। বিশাল উপত্যকা জুড়ে বিস্তৃত তাদের তাঁবু। পাশেই রয়েছে গবাদিপশুর থাকার জায়গা। মোটামুটি নিরুপদ্রব জীবন কাটছিল, অন্তত তাইজুতদের আক্রমণের আগ পর্যন্ত।

তাইজুতদের ৩০ হাজার সেনা আচমকা হামলা করে বসে তেমুজিনের এলাকায়। তাদের মোকাবিলা করা সহজ ছিল না। প্রথমত, তেমুজিনের সেনাসংখ্যা ছিল অনেক কম। দ্বিতীয়ত, সবাইকে দ্রুত একত্র করার মতো সময়ও তার হাতে ছিল না। তেমুজিন দ্রুত তার যোদ্ধাদের সারিবদ্ধ করে ফেলেন। একাংশকে লুকিয়ে রাখেন বনের আড়ালে। তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। দিনশেষে তাইজুতরা পরাজিত হয়। তাদের ৬ হাজার সেনা ও ৭০ জন দলপতি বন্দি হয়। সিদ্ধান্ত নিতে তেমুজিন বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। ৭০ জন গোত্রপতিকে যুদ্ধক্ষেত্রেই জীবন্ত সিদ্ধ করে মারার আদেশ দেন তিনি।

মোঙ্গল খান জীবনের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। এখন তিনি চাইলে নিজের সঙ্গে হাতির দাতের তৈরি রাজদণ্ড রাখতে পারবেন। তেমুজিনের মতে অর্থের চেয়েও বড় শক্তি হচ্ছে জনশক্তি। সংখ্যাধিক্যের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। এটি জোগাড় করার দিকে তার বেশ মনোযোগ ছিল। ধীরে ধীরে তার পতাকা ‘নাইন ইয়াক টেলে’র নিচে সমবেত যোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে। তেমুজিনের মনে একটাই স্বপ্ন—বিভক্ত উপজাতি গোত্রগুলোকে তার মানচিত্রের নিচে একত্র করা। তেমুজিন একের পর এক নিজের শক্তির জানান দিতে থাকে। তার হাতে পরাস্ত হয় শক্তিশালী কারাইতরা।

১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয় তেমুজিনের প্রথম রাজসভা। এই সভাতেই তেমুজিন চেঙ্গিস খান নাম ধারণ করেন। এখন তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মঙ্গোলিয়া ও তিয়েনশানে বসবাসকারী গোত্রগুলো। তার সেনাসংখ্যা আড়াই লাখ। আর তারা ছড়িয়ে রয়েছে ১ লাখ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে। তার সঙ্গে রয়েছে রহস্যময় উইঘুর, বিশ্বস্ত কারাইত, রুক্ষ মোঙ্গল, ভয়ংকর তাতার, মেরকিট ও অন্য গোত্রগুলো।

গোবির বিস্তীর্ণ প্রান্তরে নিজের শক্তি প্রদর্শন করা শেষ। মাথা নত করেছে বড় বড় গোত্রগুলো। এবার চেঙ্গিস খানের নজর পড়ল মহাপ্রাচীরের অপর পার্শ্বে। যেখানে টিকে ছিল ৫ হাজার বছরের পুরানো ক্যাথি সাম্রাজ্য। মহাপ্রাচীরের অপর পার্শ্বে অবস্থিত সেই সাম্রাজ্যের জীবন গোবির মতো রুক্ষ ছিল না। শহরগুলোতে বাস করত বিদ্বান ও কৃষক, সাহিত্যিক ও সেনাপতিরা। রেশম কাপড়ের পোষাক পরত তারা। তাদের শাসকের নাম ছিল তিয়েস সি বা স্বর্গের পুত্র। রাজদরবারকে তারা বলত স্বর্ণের মেঘ। ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাথিদের রাজদরবার ছিল আধুনিক পিকিংয়ের কাছে ইয়েন-কিংয়েন।

দুর্ভেদ্য মহাপ্রাচীর, যার উপর দিয়ে একসঙ্গে ছয়জন ঘোড়সওয়ার ছুটতে পারে, তার আড়ালে ক্যাথিরা ছিল অনেকটাই নিরাপদ। গোবির আড়াই লাখ যাযাবরকে নিয়ে তাদের বিশেষ চিন্তা ছিল না। চেঙ্গিস খান ছিল তাদের চোখে ‘বুদ্ধিমান এক গোত্রপতি’ মাত্র। তার কাছ থেকে বিশেষ কোনো হুমকির ভয় করছিল না তারা। এক যুদ্ধে ক্যাথির রাজা চেঙ্গিস খানের কাছে সেনাসহায়তা চেয়েছিলেন। ইতিহাস বলে, চেঙ্গিস খান তাকে সেনা দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। এই সেনারা ফিরে এসেছিল আশ্চর্য সব গল্প নিয়ে। তারা দেখে এসেছিল ক্যাথির হৃদে ভাসমান কিবিকাস বা তাঁবুগাড়ি, একই সঙ্গে দেখেছে সুন্দর সব কবিতার আসর। সেখানকার জীবনযাত্রার মান দেখে তারা লোভী হয়ে ওঠে। ফিরে এসে খানকে শোনায় সেসব নগরীর গল্প। ধূর্ত চেঙ্গিস খান লোভাতুর হয়ে উঠলেন। ক্যাথিতে আক্রমণ করা তার জন্য জরুরি ছিল। কারণ তিনি জানতেন, মরুচারী যাযাবর গোত্রগুলোকে দীর্ঘসময় ঐক্যবদ্ধ রাখার একটাই উপায়, তাদের বাইরের শত্রুর মুখোমুখি করে দেওয়া। ইতিমধ্যে ক্যাথির রাজা মারা গেলেন। ক্ষমতায় এলেন ওয়াই ওয়াং। তার সবটুকু আগ্রহ ছিল চিত্রকলা ও শিকারে।

https://www.high-endrolex.com/3চেঙ্গিস খান প্রস্তুত হচ্ছিলেন। প্রথমেই তিনি হিয়া ও অন্যান্য গোত্রের সঙ্গে সন্ধি করে নিলেন। এতে করে তিনি নিজের পেছন দিক নিরাপদ করলেন। এখন আর অতর্কিত হামলার ভয় নেই।
ক্যাথির নতুন রাজা সিংহাসনে আরোহণের পর তার দূত গেল চেঙ্গিস খানের সঙ্গে দেখা করতে। প্রথা অনুযায়ী ক্যাথির রাজাকে সম্মানী দেওয়ার কথা চেঙ্গিস খানের।

‘এই বেকুব তো রাজা হওয়ার উপযুক্ত নয়। আমি কেন তাকে সম্মান জানাব? শীঘ্রই আমি এক বাহিনী নিয়ে আসছি। এরপর রাজা চাইলে তাকে আমার অধীনে থেকে রাজ্যশাসন করতে দেবো। আর চাইলে যুদ্ধও করব’—তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন চেঙ্গিস খান। ব্যর্থ দূত ফিরে গেল রাজধানীতে।
যুদ্ধ দামামা বেজে উঠল মোঙ্গল শিবিরে। এবারই প্রথম নিজেদের সীমানার বাইরে শক্তিশালী এক সাম্রাজ্যে আক্রমণ করতে যাচ্ছে তারা।

১২১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমে রওনা হলো ২০০ সৈন্যের ছোট দলটি। তাদের কাজ মহাপ্রাচীরের আশপাশের গ্রামের লোকদের হাত করা, যেন সহজেই প্রাচীরের ফটক খুলে ফেলা যায়। তাদের পিছু নিল তিন বাহিনীতে বিভক্ত ৩ লাখ সেনা। খানের নিরাপত্তায় রয়েছে ১ হাজার সেনা। তারা চড়েছে কালো ঘোড়ায়, পরনে চামড়ার বর্ম। স্রোতের মতো মোঙ্গল সেনারা প্রবেশ করল চীন সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে। প্রথম ধাক্কাতেই তাদের দখলে এলো অনেকগুলো শহর। তারা পৌঁছে গেল রাজধানীর নিকটে। কিন্তু এখানে এসে চেঙ্গিস খান সত্যিকারের প্রতিরোধের মুখোমুখি হলেন। সাম্রাজ্যের সব এলাকা থেকে এখানে ছুটে এলো রাজার সেনাবাহিনী। চেঙ্গিস খান বুঝলেন এই শহর আপাতত জয় করা সম্ভব নয়। বাহিনী নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন গোবিতে। তবে ফিরে এলেন পরের বসন্তেই। এবারও মোঙ্গলদের ভয়াবহ বাধার মুখোমুখি হতে হয়। এবার চেঙ্গিস খান চাললেন মোক্ষম এক চাল। নিজের বাহিনীর জিনিসপত্র ফেলে বাহিনী নিয়ে দ্রুত পিছু হটলেন। টানা দুদিন পিছু হটলেন। ক্যাথিবাসী ভাবল চেঙ্গিস খান পালাচ্ছেন। তারপর আচমকা এক রাতের মধ্যে চেঙ্গিস খানের বাহিনী ফিরে এলো। শহরের ফটক তখনো খোলা। শহরবাসী স্বস্তিতে। আচমকা তারা দেখল উন্মুক্ত তরবারি হাতে মোঙ্গলরা প্রবেশ করছে শহরে; কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। শহরে চলল নির্মম গণহত্যা। কিন্তু তবু মিলল না কাঙ্ক্ষিত ফল। ক্যাথির রাজা অবস্থান করছিলেন সুদৃঢ় দুর্গে। চেঙ্গিস খান সে পর্যন্ত যেতেই পারছিলেন না। ১২১৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রতি বছরই চেঙ্গিস খান ক্যাথিদের উপর হামলা করছিলেন। কিন্তু শতভাগ সাফল্য পাচ্ছিলেন না। এর কারণ ছিল ক্যাথিদের শহরগুলো ছিল খুবই মজবুত।
এভাবে কত দিন চলত বলা মুশকিল; কিন্তু পথ করে দিলেন চীন সম্রাট। বড় ছেলে ইয়েন কিংকে দায়িত্ব দিয়ে তিনি পালিয়ে যান দক্ষিণে। সাম্রাজ্যে শুরু হয় বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা।

সময়টা ছিল শীতকাল। ৫৫ বছর বয়স্ক চেঙ্গিস খান অবস্থান করছিলেন নিজের প্রাসাদে। তার দৌহিত্র কুবলাই খান কদিন আগেই জন্মগ্রহণ করেছিল। গুপ্তচর মারফত তিনি জানলেন সম্রাটের পলায়নের সংবাদ। দ্রুত বড় এক বাহিনী নিয়ে রওনা হলেন ক্যাথির দিকে। শহরবাসীর বিশৃঙ্খলার সুযোগে এই বাহিনী শহর দখল করে নিলো। শুরু হলো লুটতরাজ ও হত্যাযজ্ঞ। অল্প সময়ে শহরের পতন হলো। চেঙ্গিস খান মুহুলিকে শাসক নিযুক্ত করলেন। তারপর মহাপ্রাচীর অতিক্রম করে ফিরে গেলেন নিজের এলাকায়। আর কখনো ক্যাথি নিয়ে আগ্রহ দেখাননি তিনি। এটা ছিল তার স্বভাবের অংশ। কোনো এলাকা জয় করার পর তার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেন।

চেঙ্গিস খান নিজের রাজধানী বানালেন মরু শহর কারাকোরামকে। দ্রুত এই শহর জমে উঠল। এখানে রাস্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না, তার প্রয়োজনও ছিল না। শুকনো কাদা নির্মিত ঘর আর খড়ের তৈরি ছাদ। তৈরি হলো বাড়িঘর। এখন আর আগের মতো দুর্ভিক্ষের শঙ্কা নেই। মোঙ্গলদের তাঁবুতে আছে প্রচুর গবাদি পশু। দক্ষিণ থেকে এসেছে আরব ও তুর্কি ব্যবসায়ীরা। খানের লেনদেনের নিয়ম ছিল অদ্ভুত। কেউ দরদাম করলে তাকে কোনো দাম না দিয়েই সব রেখে দিতেন। আর কেউ মূল্য ছাড়া কিছু দিলে তাকে এর কয়েকগুন অর্থ দিতেন। এই শহরে খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও মুসলিম সবাই ছিল। সবার নিজস্ব উপাসনা গড়ে ওঠে। সাধারণত কারও ধর্মচর্চায় তেমন বাধা ছিল না—অন্তত যতক্ষণ তারা ইয়াসার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত।

খানের দরবার বসত রাজকীয় পশমি তাঁবুতে। তাঁবুর দরজায় থাকত রুপোলি টেবিল। তার উপর থাকত ঘোড়ার দুধ, ফল আর মাংস। দরবারে আগতরা ইচ্ছামতো খেতে পারত এখান থেকে। খান বসতেন একটি মঞ্চে। তার স্ত্রী বৌরতাই বা অন্য কেউ বসত বাম দিকে, আরেকটু নিচু আসনে।
ধীরে ধীরে কারাকোরামে ভীড় বাড়তে লাগল। এর বাজারে দেখা গেল বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। এভাবে চেঙ্গিস খান নিষ্প্রাণ মরুর বুকে গড়ে তুললেন প্রাণবন্ত শহর, যে শহরে খানের আদেশের অপেক্ষায় থাকত সবাই। যেকোনো আদেশ এলে নিঃশব্দে তা পালিত হতো। (২)

ক্যাথি থেকে ফিরে এসে চেঙ্গিস খান চুপচাপ বসে থাকেননি। তিনি আরও কয়েকটি যুদ্ধে জড়ালেন। প্রতিটি যুদ্ধে নৃশংসতার পরিচয় দিলেন তিনি। পরাজিতদের দয়া করার পক্ষে ছিলেন না তিনি। যারা কোনো যুদ্ধ ছাড়া আত্মসমর্পণ করত, তাদেরও তিনি রেহাই দিতেন না। তাদের যাবতীয় ধনসম্পদ লুট করতেন, নারীদের ধর্ষণ করত মোঙ্গলরা। তারপর তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে ফিরত তারা। তবে যুদ্ধ ছাড়া আত্মসমর্পণ করলে একটাই লাভ ছিল—গণহত্যা থেকে বেঁচে যেত তারা। বন্দি করার প্রতি মোঙ্গলদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তবে রাস্তা ও পুল নির্মাণের দরকার হলে বন্দিদের কাজে লাগাত। এরপর হত্যা করত। তবে সুন্দরী মেয়েদের জীবিত রাখা হতো। তাদের পাঠানো হতো খান ও তার সভাসদদের কাছে।

নৃশংস খুনি হিসেবে চেঙ্গিস খান নানা বিকৃত কাজ করে মজা পেতেন। এমন একটা বিকৃত অভ্যাসের বর্ণনা দেখা যায় তারিখে নিগারিস্তান নামক গ্রন্থে। মুসলমান ব্যবসায়ীদের একটা একবার দল মোঙ্গলদের সীমানায় প্রবেশ করে একটা সাদা পাহাড় দেখতে পায়। তারা ভেবেছিল তুষারপাতে এই পাহাড় সাদা হয়ে গেছে। কাছাকাছি গিয়ে দেখা গেল এগুলো চেঙ্গিস খানের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিহত ব্যক্তিদের হাড়গোড়। চেঙ্গিস খান তা সাজিয়ে স্তূপ করে রেখেছেন। (৩)

তাতারদের ধর্মের বিষয়টি ছিল অদ্ভুত। প্রথমত তারা এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। তবে একই সঙ্গে তারা শিরক ও কুফরে লিপ্ত ছিল। তাতাররা সূর্যের উপাসনা করত। সূর্যোদয়ের সময় তারা সূর্যকে সিজদাহ করত। তারা ভয় পেত বজ্রপাতকে। (৪)

কারাকোরাম গড়ে উঠার পর নানা এলাকার বণিকদলের যাতায়াত বাড়ে। চেঙ্গিস খানের রাজত্বে বসবাসকারী মুসলমানরাও অন্যান্য অঞ্চলে বাণিজ্যিক সফরে যায়। তারা ফিরে আসার পর তাদের কাছে চেঙ্গিস খান খুটিয়ে খুটিয়ে সেসব এলাকার গল্প শুনেন। ধীরে ধীরে তিনি জানতে পারেন তার সীমানার বাইরে এক সমৃদ্ধ জনপদের কথা, যেখানে জীবন অনেক সতেজ আর সজীব। সেই জনপদের শহরগুলো সুশোভিত ফুলের বাগানে। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ছোট নহর। শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী পাহারা দিচ্ছে সেই সাম্রাজ্যের সীমানা। সেই সাম্রাজ্যের নাম খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য।

টীকা
১। গোবির অবস্থান আধুনিক মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণে এবং চীনের উত্তরে।
২। এই আলোচনাটি হ্যারল্ড ল্যাম্ব লিখিত চেংগিস খান থেকে সংক্ষেপিত।
৩। তারিখে নিগারিস্তান, ৭৮।
৪। তাতারদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ইবনুল আসির লিখেছেন, তারা সূর্যোদয়ের সময় সূর্যকে সিজদা করে। তাদের কাছে হারাম বলতে কিছুই নেই। সবকিছুকেই তারা বৈধ মনে করে। কুকুর, শূকর ও অন্যান্য সকল প্রানী তারা খায়। তাদের মধ্যে বিবাহের কোনো রীতি নেই। একজন মহিলার সাথে একইসময় একাধিক পুরুষের সম্পর্ক গড়ে উঠে। ফলে সন্তানের জন্মের পর তার পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত থাকে।(আল কামিল ফিত তারিখ, ৭/৪৪২)। ইমাম ইবনু তাইমিয়া তাতারদের সম্পর্কে লিখেছেন, তাদের মধ্যে খ্রিস্টান, মুশরিক ও মুসলমানও ছিল, তবে মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের খুব কম নিদর্শনই বিদ্যমান ছিল। (মাজমুউল ফাতওয়া, ২৮/৫০৩)

———
বই – সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারেজম শাহ
মূল- ইসমাইল রেহান
পরিমার্জিত সংক্ষিপ্ত অনুবাদ – ইমরান রাইহান
প্রকাশক – কালান্তর প্রকাশনী

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন