মূল: আল্লামা শিবলী নোমানী
অনুবাদ: ইমরান রাইহান
(আল্লামা শিবলী নোমানীর জন্ম ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে, ভারতের আযমগড়ে। তিনি প্রথমে মাওলানা মোহাম্মদ ফারুক সিয়ারাকোটির কাছে বিভিন্ন বিষয় পড়েন। পরে আরবে গমন করে বিভিন্ন শাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। দেশে ফিরে তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মৃত্যুর পর তিনি আলীগড় থেকে চলে আসেন। কিছুকাল হায়দারাবাদে অবস্থান করেন। পরে তিনি আযমগড়ে দারুল মুসান্নেফিন প্রতিষ্ঠা করেন। গত শতাব্দীর শুরুতে ভারতীয় মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান অবিস্মরনীয় অবদান রাখে। ইতিহাস বিষয়ে আল্লামা শিবলী নোমানী তার সময়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ‘সীরাতুন নবী’ ‘সীরাতুন নুমান’ ‘আল ফারুক’ ‘আল মামুন’ ‘আল গাজালী’ ‘মাওলানা রুমী’ ‘আলমগীর পর এক নজর’ ‘শেরুল আজম’ ‘ইলমুল কালাম’ ‘সফরনামা মিসর ও শাম’। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।)
পূর্বাভাস
মুম্বাই সফরে আমার এক বন্ধু আমাকে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ দেখান। প্রবন্ধটি জেবুন্নেসার জীবনি সম্পর্কিত। আমার বন্ধুটি পড়ুয়া মানুষ, বিশেষ করে ইংরেজ লেখকদের লেখার প্রতি তার বেশ টান। আমি প্রবন্ধটি পড়ে অবাক হই। জেবুন্নেসার ন্যায় একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের জীবনি লেখা হয়েছে বাজারে প্রচলিত কিচ্ছা কাহিনীর উপর নির্ভর করে। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে আকিল খান রাজির গল্পটি, যা একাধারে বানোয়াট ও লজ্জাকর। আফসোসের বিষয় মুসলিম লেখকদের অনেকেও জেবুন্নেসার জীবনি লিখেছেন কিন্তু তারাও এইসব বানোয়াট কিচ্ছা কাহিনীর গন্ডি থেকে বের হতে পারেননি। তাই আমার মনে হলো নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থের সাহায্যে জেবুন্নেসার জীবনি লেখা দরকার যেন, তার জীবনির উপর অপবাদ ও মিথ্যাচারের যে কুয়াশা জমেছে তা সরানো যায়।
জন্ম
জেবুন্নেসা মুঘল সম্রাট আলমগীরের বড় মেয়ে। তার মা দিলরাস বানু বেগম ছিলেন শাহ নেওয়াজ খানের কন্যা। শাহ নেওয়াজ খানের মূল নাম বদিউজ্জামান। তিনি সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে প্রশাসনের উচ্চপদে আসীন ছিলেন। পরে তাকে শাহ নেওয়াজ উপাধী দেয়া হয়। বংশীয় ভাবে শাহ নেওয়াজ ছিলেন উচু ঘরানার। শাহজাহানের শাসনামলের দশম বছর, ১০৪৭ হিজরীতে, শাহ নেওয়াজ খানের কন্যার সাথে আলমগীরের বিবাহ হয়। বিয়েতে মোহর নির্ধারণ করা হয় চার লাখ মোহর।
১০৪৮ হিজরীর শাওয়াল মাসে (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ) জেবুন্নেসার জন্ম হয়। জেবুন্নেসার বাল্যকাল কাটে হেসেখেলে। পড়ার বয়সে উপনিত হলে আলমগীর তার শিক্ষার জন্য আমীর এনায়েতুল্লাহ খানের মা হাফেজা মরিয়ম বেগমকে নিযুক্ত করেন। মরিয়ম বেগম কোরআনের হাফেজা ছিলেন। লেখাপড়া জানতেন। জেবুন্নেসা মরিয়ম বেগমের কাছে পড়াশোনা শুরু করে।(১) প্রথমেই তাকে কোরআন হিফজ করানো হয়। জেবুন্নেসার হিফজ সমাপ্ত হলে সম্রাট আলমগির খুশি হয়ে কন্যাকে ত্রিশ হাজার স্বর্নমুদ্রা উপহার দেন।(২) প্রায় সকল ইতিহাসগ্রন্থের বক্তব্য অনুসারে জেবুন্নেসা আরবী ও ফার্সী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। এমনকি সেযুগের বড় বড় জ্ঞানীরাও নানা প্রয়োজনের জেবুন্নেসার দারস্থ হতেন। জেবুন্নেসার উস্তাদদের মধ্যে মোল্লা সাইদ আশরাফ উল্লেখযোগ্য। (৩) মোল্লা সাইদ আশরাফ আলমগীরের শাসনামলের শুরুর দিকে ইরান থেকে ভারতবর্ষে আসেন। আলমগীর তাকে জেবুন্নেসার শিক্ষক নিযুক্ত করেন। সেসময় জেবুন্নেসার বয়স একুশ বা বাইশ। এ থেকে বুঝা যায় আলমগীর তার এই কন্যার শিক্ষার ব্যাপারে কতটা যত্নশীল ছিলেন। মোল্লা সাইদ আশরাফ কবি ছিলেন। মোল্লা সাইদের তত্ত্বাবধানেই জেবুন্নেসা কাব্যচর্চা করেন। প্রায় ১৩/১৪ বছর জেবুন্নেসা মোল্লা সাইদ আশরাফের তত্ত্বাবধানে নানা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১০৮৩ হিজরীতে মোল্লা সাইদ আশরাফ ভারতবর্ষ ত্যাগ করে ইরান গমনের মনস্থ করেন। সেসময় একটি কবিতার মাধ্যমে তিনি জেবুন্নেসার কাছ থেকে বিদায় নেন। কবিতাটি ছিল
একটিবারের জন্যেও মন এদেশ ছাড়তে সায় দেয় না, যদিও এখন আমার চলে যাওয়াটা অতীব জরুরি।
আমাদের জন্য সম্মুখ, নৈকট্য ও দূরত্বে কোনো ফারাক নেই,. সম্পর্ক যখন দুই হৃদয়ের, তবে দিল্লী ও ইস্পাহানের দূরত্বে কী আসে? হৃদয় সদা তোমার সম্মুখে, কাবুলে থাকি বা কান্দাহারে। (অনুবাদ– Hemayet Ullah)
জেবুন্নেসা কাব্যচর্চায় আগ্রহী ছিলেন। সারাদিন পড়াশোনাতেই ব্যস্ত থাকতেন। সমকালীন রাজনীতি থেকে ছিলেন দূরে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, তাকেও রাজনীতির মরণফাদে আটকা পড়তে হয়। ১০৯১ হিজরীতে রাজপুতরা বিদ্রোহ করে। আলমগীর এই বিদ্রোহ দমনের জন্য শাহজাদা আকবরকে সসৈন্যে যোধাপুর প্রেরণ করেন। কিন্তু রাজপুতদের প্ররোচনায় শাহজাদা আকবর নিজেই পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। এইসময় জেবুন্নেসার সাথে শাহজাদার পত্রালাপ চলতো। এই পত্রালাপ রাজনৈতিক ছিল না, শুধুই ভাইবোনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বহিপ্রকাশ। ঘটনাচক্রে দুয়েকটি পত্র ধরা পড়ে এবং আলমগীর জানতে পারেন জেবুন্নেসা ভাইয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। আলমগীর ক্রোধে অগ্নিমর্শা হয়ে যান। জেবুন্নেসার বার্ষিক ভাতা, যা ছিল চার লাখ স্বর্নমুদ্রা, তা বন্ধ করে দেয়া হয়। জেবুন্নেসার সমস্ত সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়। জেবুন্নেসাকে সেলিমগড়ে বন্দী করা হয়। তবে শীঘ্রই জেবুন্নেসা নির্দোষ প্রমানিত হন। তাকে আবার সব ফিরিয়ে দেয়া হয়। সম্রাটের সাথেও তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। ১০৯২ হিজরীতে রুহুল্লাহ খানের আম্মা হামিদা বানু বেগম ইন্তেকাল করলে আলমগীর জেবুন্নেসাকে হামিদা বানুর ঘরে প্রেরণ করেন। একই বছর আলমগীরের চতুর্থ ছেলে শাহজাদা কাম বখশের বিবাহতে জেবুন্নেসার মহলেও কয়েকটি অনুষ্ঠান হয়।
জেবুন্নেসা বিবাহ করেননি। সাধারণত প্রচার করা হয় মুঘল শাহজাদীরা বিবাহ করতেন না। ইউরোপিয়ান লেখকদের কেউ কেউ এমনটা লিখেছেন। এর দ্বারা মোঘল শাহজাদীদের চরিত্রে কালিমা লেপনের মোক্ষম সুযোগ পেয়েছেন তারা। অথচ এই তথ্য নিতান্তই ভিত্তিহীন। স্বয়ং আলমগীরের দুই কন্যা যুবদাতুন্নেসা বেগম ও মেহেরুন্নেসা বেগম বিবাহ করেছেন। মাআসিরে আলমগীরিতে তাদের দুজনের বিবাহের তারিখ ও সংক্ষিপ্ত বর্ননা আছে।
আলমগীর জেবুন্নেসাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। বিভিন্ন সফরে নিজের সাথে রাখতেন। কাশ্মীরের কষ্টকর সফরেও জেবুন্নেসা পিতার সাথে ছিলেন। শাহজাদী কোনো সফর থেকে ফিরলে আলমগীর শাহজাদাদের প্রেরণ করতেন বোনকে অভর্থনা জানানোর জন্য। দক্ষিনাত্যের সফরে জেবুন্নেসা পিতার সাথে ছিলেন না। সম্ভবত দিল্লী ত্যাগ করলে নিজের পড়াশোনার ক্ষতি হবে এমন ভাবনাই তাকে এই সফরে অনাগ্রহী করে তোলে। এই সফরে আলমগীরের সাথে ছিলেন শাহজাদী জিনাতুন্নেসা। এইজন্য বিভিন্ন ঘটনাবলীতে জিনাতুন্নেসার উল্লেখ আছে।
১১১৩ হিজরীতে, আলমগীরের শাসনামলের ৪৮ বছর চলছে তখন, জেবুন্নেসা দিল্লীতে মৃত্যুবরন করেন। আলমগীর সেসময় দক্ষিনাত্যে , একের পর এক যুদ্ধে ব্যস্ত। প্রিয় কন্যার মৃত্যুসংবাদে তিনি ভেংগে পড়েন। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়। শান্ত, ধীর স্বভাবের এই সম্রাট নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। পরে তিনি শায়খ আতাউল্লাহ, সাইয়েদ আমজাদ খান ও হাফেজ খানের কাছে লিখিত পত্রে মরহুমার ইসালে সওয়াবের জন্য দান খয়রাতের নির্দেশ দেন। এছাড়া মরহুমার কবর পাকা করারও নির্দেশ দেন। (৪)
কলকাতা থেকে প্রকাশিত খফি খান রচিত মুন্তাখাবুল লুবাবে ১১২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জেবুন্নেসার ঘটনাবলীর উল্লেখ আছে। এটা লিপিকারদের ভুল। তারা জিনাতুন্নেসার নামের সাথে জেবুন্নেসার নামকে গুলিয়ে ফেলেছে।
শিক্ষাগত যোগ্যতা
সকল ঐতিহাসিক লিখেছেন, জেবুন্নেসা আরবী ও ফার্সী ভাষায় অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন। তার হাতের লেখাও খুব সুন্দর ছিল। বিশেষ করে নসখ, নাস্তালিক ও শিকাস্তা লিপিতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। সাধারনত বলা হয়, তিনি মাখফি নামে লিখতেন এবং দিওয়ানে মাখফি নামক বইটি তার রচিত কবিতা সংকলন। তবে এটি সঠিক নয়। কোনো ইতিহাসগ্রন্থে জেবুন্নেসার কোনো দিওয়ানের তথ্য মেলে না। মাওলানা গোলাম আলী আজাদ বিলগ্রামী ‘ইয়াদে বাইদা’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, জেবুন্নেসা রচিত দুটি পংক্তির সন্ধান মেলে। এরপর তিনি পংক্তি দুটি উল্লেখ করেছেন। যদি জেবুন্নেসার কোনো কাব্যগ্রন্থই থাকতো তাহলে তিনি অবশ্যই এর উল্লেখ করতেন। মাখজানুল গারায়েব একটি জীবনি গ্রন্থ। লেখক আহমদ আলী সান্ধিলভী। তিনি জেবুন্নেসার জীবনিতে লিখেছেন, জেবুন্নেসার নামে প্রচলিত কবিতাগুলোর অধিকাংশই তার উস্তাদ মোল্লা সাইদ আশরাফের রচনা। পরে এগুলো জেবুন্নেসার রচনা বলে প্রসিদ্ধি পায়।
জেবুন্নেসা কবি ছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার কবিতাগুলো কালের আবর্তনে হারিয়ে গেছে। তাজকিরাতুল গারায়েব গ্রন্থে মোল্লা সাইদ আশরাফের জীবনিতে আছে, একবার তিনি পানির হাউজে পড়ে যান। সেখানে থেকেই তিনি চারটি পংক্তি আবৃত্তি করেন। পরে এ পংক্তিগুলো জেবুন্নেসার নামে প্রচলিত হয়। কোনো কোনো জীবনিকার এগুলোকে জেবুন্নেসার রচনা বলে চালিয়ে দেন, যদিও তা মোল্লা সাইদ আশরাফের রচনা। জেবুন্নেসার রচিত গ্রন্থ হিসেবে জেবুন নাশাআত এর নাম নেয়া যায়। বিভিন্ন গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। তাজকিরাতুল গারায়েবের লেখক লিখেছেন, আমি বইটি দেখেছি। এটি জেবুন্নেসার পত্র সংকলন।
জেবুন্নেসা নিজে কোনো গ্রন্থ লিখুন বা না লিখুন তার তত্ত্বাবধানে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। মাওলানা গোলাম আলি আজাদ বিলগ্রামী লিখেছেন, জেবুন্নেসার তত্ত্বাবধানে একদল আলেম, সাহিত্যিক, কবি ও লিপিকার গ্রন্থ রচনায় ব্যস্ত থাকতেন। জেবুন্নেসার দরবারকে একটি একাডেমি বলা যেতে পারে। তার তত্ত্বাবধানে প্রচুর বই রচিত হতো। এসব গ্রন্থ সাধারনত জেবুন্নেসার দিকে সম্পর্কিত করে নাম রাখা হতো। অর্থাৎ বইয়ের নামের প্রথম শব্দটি হতো জেব। এখানেই অধিকাংশ জীবনিকার ধোকা খেয়েছেন। তারা এসব বইয়ের নামের শুরুতে জেব দেখে এসবকে জেবুন্নেসার রচনা মনে করেছেন। জেবুন্নেসার তত্ত্বাবধানে যেসব গ্রন্থ রচনা হয়েছে এর মধ্যে অন্যতম হলো জেবুত তাফাসির। এটি ইমাম রাজি রচিত তাফসিরে কাবিরের ফার্সি অনুবাদ। জেবুন্নেসা কাশ্মীরের বাসিন্দা মোল্লা সফিউদ্দিন আরদবেলিকে তাফসিরে কাবির অনুবাদের দায়িত্ব দেন। অনুবাদের পর জেবুন্নেসার নামে একে জেবুত তাফাসির নামকরণ করা হয়। অনেকে একে জেবুন্নেসার অনুবাদ মনে করলেও বাস্তবে এটি তার অনুবাদ নয়।(৫)
জেবুন্নেসা লেখালেখির যে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেন তাতে তার একটি লাইব্রেরী দরকার ছিল, যা থেকে লেখক ও গবেষকরা উপকৃত হবেন। তিনি একটি লাইব্রেরীও প্রতিষ্ঠা করেন। মাআসিরে আলমগীরির লেখক এই লাইব্রেরী দেখে এর ভুয়সী প্রশংসা করেছেন।(৬)
জেবুন্নেসার সাহিত্যপ্রীতি ছিল। সম্রাট আলমগীর তার শাসনামলের শুরুর দিকেই সভাকবির আসন বিলুপ্ত করেন। কবিদেরকেও সুযোগ সুবিধা দেয়া বন্ধ করে দেন। জেবুন্নেসা ব্যক্তি উদ্যোগে কবিদের সাহায্য করতে থাকেন। কাব্যচর্চার ধুম পড়ে যায়। কবিরা দুয়েক পংক্তি লিখলেই জেবুন্নেসা তাদেরকে পুরস্কৃত করতেন। কবিদের পুরস্কৃত করার অনেক ঘটনা ইতিহাসগ্রন্থে বিদ্যমান।
জেবুন্নেসা যদিও রাজকীয় জীবনযাপন থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করতেন তবু কখনো কখনো তিনি নিজের শাহী রুচির পরিচয় দিয়েছেন। কাশ্মীরে তিনি নিজের জন্য একটি মহল ও বাগান নির্মান করেন। ১০৭৩ হিজরীতে আলমগীর কাশ্মির সফরে গেলে জেবুন্নেসা পিতাকে নিজের বাগানে নিয়ে আসেন এবং অনেক উপহার দেন। (৭) ১০৯০ হিজরীতে তিনি নিজের জন্য একটি রাজকীয় তাবু নির্মান করেন।
জেবুন্নেসা ভাইদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। ১১০৫ হিজরীতে শাহজাদা আজম শাহ অসুস্থ হলে জেবুন্নেসা ভাইয়ের সেবায় মনপ্রান ঢেলে দেন। শাহজাদা আকবর যখন রাজপুতদের সাথে মিলে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন জেবুন্নেসা তখনো ভাইয়ের সাথে পত্র যোগাযোগ রেখেছিলেন। এ কারনে তাকে পিতার রোষানলেও পরতে হয়।
জেবুন্নেসাকে নিয়ে মিথ্যাচার
জেবুন্নেসাকে নিয়ে কিছু মিথ্যা গল্প প্রচলিত আছে। ইউরোপিয়ান লেখকরা এসব গল্পকে আরো রঙ চড়িয়ে উপস্থাপন করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গল্প হলো, আকিল খানের সাথে জেবুন্নেসার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। জেবুন্নেসা প্রায়ই আকিল খানকে নিজের মহলে ডেকে নিতেন। প্রেমালাপ করতেন। একবার আলমগীর জানতে পারেন আকিল খান জেবুন্নেসার মহলে এসেছে। তিনি ছুটে আসেন। আকিল খান গোসল খানায় ঢুকে পানি গরম করার ডেগের ভেতর লুকিয়ে পড়েন। আলমগীর টের পেয়ে প্রহরীদের আদেশ দেন পানি গরম করতে। এভাবে আকিল খানকে গরম পানিতে পুড়িয়ে মারা হয়।
মাআসিরুল উমারাতে আকিল খানের বিস্তারিত জীবনি আছে। তিনি কবি ছিলেন, একারনে সেকালে রচিত বেশিরভাগ জীবনিগ্রন্থে তার জীবনি এসেছে। কোথাও এই ঘটনার উল্লেখ নেই। যেসকল নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থে আকিল খানের জীবনি আছে তা হলো, আলমগীরনামা, মাআসিরুল উমারা, মাআসিরে আলমগীরি, খাজানায়ে আমেরা, তাজকিরায়ে সারখোশ, ইয়াদে বাইদা, সরদে আজাদ ইত্যাদী। কিন্তু এসব গ্রন্থের কোথাও এই ঘটনার সামান্য ইংগিতও নেই।
জেবুন্নিসাকে নিয়ে প্রচলিত আরেকটি গল্প হলো, একবার জেবুন্নেসা একটি পংক্তি রচনা করেন। পংক্তিটি হলো, আয হাম নমী শাওয়াদ যে হালাওয়াত জুদা লবম।
অর্থ- শিরীন হতে আমার অধর পৃথক নাহি হতো।
জেবুন্নেসা এর পরের পংক্তি মিলাতে পারছিলেন না। তখন তিনি নাসির আলীর কাছে পংক্তিটি পাঠান। জবাবে নাসির আলী লিখেন, শায়দ রসীদ বর লবে যেবুন্নিসা লবম। অর্থ- জেবুন্নেসার অধর যদি আমার অধর ছুঁতো। (অনুবাদ– Hemayet Ullah)
এই গল্পেরও কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আর যারা মুঘলদের ব্যক্তিত্ব ও প্রতাপ সম্পর্কে অবগত তারা জানেন, নাসির আলী কখনোই এভাবে জবাব দেয়ার সাহস করবে না।
তথ্যসূত্র
১। মাআসিরুল উমারা, ২য় খন্ড, ৮২৮ পৃষ্ঠা।
২। মাআসিরে আলমগিরী, ৪৩৮ পৃষ্ঠা।
৩। তাজকিরায়ে মোল্লা আশরাফ, ৬১ পৃষ্ঠা।
৪। মাআসিরে আলমগিরি , ৪৬২ পৃষ্ঠা।
৫। একই কথা লিখেছেন শায়খ আবদুল হাই হাসানি নদভীও। জেবুন্নেসার জীবনিতে তিনি লিখেছেন, জেবুত তাফাসিরের অনুবাদক শায়খ সফিউদ্দিন আরদবেলী। জেবুন্নেসার আদেশে তিনি এটি অনুবাদ করেন। (নুজহাতুল খাওয়াতির, ৭২৩ পৃষ্ঠা– শায়খ আবদুল হাই হাসানি নদভী। দার ইবনে হাজম, বৈরুত) — অনুবাদক।
৬। মাআসিরে আলমগিরী, ৫৩৯ পৃষ্ঠা।
৭। মাআসিরুল উমারা, ১ম খন্ড, ৫৯৯ পৃষ্ঠা।