তারিখে উম্মতে মুসলিমা : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

পূর্বকথন

ইতিহাস-পাঠের ক্ষেত্রে একজন সচেতন পাঠকের প্রথম আগ্রহ থাকে এমন কোনো বইয়ের প্রতি যেখানে এক মলাটে ইসলামের পুরো ইতিহাস পাওয়া যাবে। এর মূল কারণ হলো, মাসাদির বা মূল উৎসগুলোর বিস্তৃত কলেবরের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের মূল কাঠামোটা আবিষ্কার করা বেশ কষ্টসাধ্য। অপরদিকে এসব গ্রন্থে ইসলামের পুরো ইতিহাসও নেই। কারণ ঐতিহাসিকরা তাদের সময় পর্যন্ত ঘটনাবলীর ইতিহাস লিখেছেন। পরের সময়কালে কী ঘটেছে তা লিখেননি। ইবনু জারির তাবারির ইন্তেকাল ৩১০ হিজরীতে, ইবনুল আসির জাযারির ইন্তেকাল ৬৩০ হিজরীতে, ইবনু কাসিরের ইন্তেকাল ৭৭৪ হিজরীতে, ইমাম যাহাবীর ইন্তেকাল ৭৪৮ হিজরীতে, ইবনু তাগরি বারদির ইন্তেকাল ৮৭৪ হিজরীতে, ইবনু খালদুনের ইন্তেকাল ৮০৮ হিজরীতে। মুসলিম ঐতিহাসিকদের ধারায় ইবনুল ইমাদ হাম্বলিকেই ধরা হয় শেষ ঐতিহাসিক, যিনি সামগ্রিক ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃত কাজ করেছেন। তার ইন্তেকাল ১০৮৯ হিজরীতে। তাহলে দেখা যাচ্ছে ঐতিহাসিকদের যার গ্রন্থ থেকেই ইতিহাস পড়া হোক, এরপরেও অনেক কিছু বাদ থেকে যাবে। ফলে সামগ্রিক ইতিহাস জানতে হলে আমাদের আধুনিক লেখকদের দ্বারস্থ হতেই হবে।

উপমহাদেশে যারা ইসলামের পুরো ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে আকবর শাহ নজিবাবাদী ও মঈনুদ্দিন নদভী উল্লেখযোগ্য। আকবর শাহ নজিবাবাদী রচিত ‘তারিখে ইসলাম’ বইয়ের বড় ত্রুটি হলো ইতিহাসের বর্ননা নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বর্ননার বিশুদ্ধতা যাচাই করেননি। সব ধরনের বর্ননা এনেছেন। বিশেষ করে মুশাজারাতে সাহাবা ও বনু উমাইয়ার ইতিহাস অংশে তিনি এমন কিছু বর্ননা এনেছেন যা নির্জলা মিথ্যা ও বানোয়াট। একইসাথে বইটিতে তিনি কোনো তথ্যের রেফারেন্স দেননি। ফলে তিনি কোন অংশ কোথা থেকে এনেছেন তা যাচাই করাও কষ্ট। মঈনুদ্দিন নদভী রচিত ‘তারিখে ইসলাম’ গ্রন্থটি অবশ্য প্রচুর রেফারেন্স সমৃদ্ধ। তবে এই বইয়ের দূর্বলতা হলো, এখানে আব্বাসি সাম্রাজ্যের ইতিহাস পর্যন্ত আলোচনা এসেছে। পরের অংশের আলোচনা আসেনি। এই বইয়ের মুশাজারাতে সাহাবা (জংগে জামাল, জংগে সিফফিন এর ঘটনাবলী) ও উমাইয়াদের ইতিহাস অংশে তিনিও এমন অনেক বর্ননা এনেছেন যা ভিত্তিহীন। কাজি যাইনুল আবেদিন মিরাঠি রচিত তারিখে মিল্লাত গ্রন্থটিও এসব দূর্বলতা থেকে মুক্ত নয়।

আরবে যারা ইসলামের ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃত কাজ করেছেন তাদের মধ্যে মাহমুদ শাকেরের নাম উল্লেখযোগ্য। তার লিখিত ২২ খন্ডে সমাপ্ত ‘আত তারিখুল ইসলামি’ গ্রন্থে ইসলামের ইতিহাসের প্রায় সবগুলো অংশই চলে এসেছে। এই গ্রন্থে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সময়কালের ঘটনাবলী এসেছে। বইয়ের আলোচনার মান বেশ সমৃদ্ধ হলেও এতে অল্পকিছু জায়গাতেই রেফারেন্স দেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গাতেই রেফারেন্স দেয়া নেই। ফলে পাঠে পরিপূর্ন তৃপ্তি পেতে কষ্ট হয়।
সমকালীন অন্য লেখকদের মধ্যে ডক্টর সুহাইল তাক্কুশ ও ডক্টর আলী সাল্লাবির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দুজনেই ইতিহাসের বিভিন্ন অংশ নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। সুহাইল তাক্কুশের লেখাগুলো সমৃদ্ধ হলেও বেশিরভাগ সময় তিনি ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যখ্যা করেন ফলে ইসলামের ইতিহাসের মৌলিক আবেদন হারিয়ে যায়। আলি সাল্লাবির লেখা সমৃদ্ধ। তথ্যের বিশুদ্ধতার প্রতিও তিনি যত্নশীল। তবে তার লেখাগুলো অনেক সময় পাঠকের নীরস মনে হয়। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি মাসাদিরের পরিবর্তে সমকালীন লেখকদের বই থেকে উদ্ধৃতি দিতে অভ্যস্ত। এটিও সচেতন পাঠকের জন্য কিছুটা অস্বস্তিকর। ইতিহাস নিয়ে বিস্তৃত লেখালেখির পরিবর্তে এক দুই খন্ডেও অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে ডক্টর রাগেব সিরজানির ভূমিকা সমৃদ্ধ দুটি বই ‘আল মাওসুয়াতুল মুইয়াসসারাহ ফিত তারিখিলি ইসলামি’ ও ‘আত তারিখুল ইসলামি’ বই দুটির কথা বলা যায়। দুটি বইই ২ খন্ড করে। যে বইগুলোর কথা বললাম বিভিন্ন সময় প্রয়োজনের ফলে এগুলো দেখতে হয়, কিন্তু অনেক সময়ই বইগুলো থেকে অনেক প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব পাইনি। কোথাও খটমটে আলোচনা, কোথাও গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাশ কাটিয়ে যাওয়া, এই বিষয়গুলোর মুখোমুখি হয়েছি নানা সময়।

সম্প্রতি উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে মাওলানা ইসমাইল রেহান রচিত ‘তারিখে উম্মতে মুসলিমা’। লেখকের পরিকল্পনা অনুসারে বইটি ৬ খন্ডে সমাপ্ত হবে। ইতিমধ্যে বইটির ৩ খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। লেখক এই বইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসের সবগুলো অংশ নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা পোষন করেছেন। বইয়ের প্রথম তিন খন্ডে ১২৫৮ সাল পর্যন্ত আলোচনা এসেছে।
এই বইটি প্রকাশের সংবাদ শোনার পর থেকেই বইটি সংগ্রহের আগ্রহ কাজ করছিল। কোনোভাবেই সংগ্রহ করতে পারছিলাম না। অবশেষে মাকতাবাতুল আযহারের সাহায্যে বইটি সংগ্রহ করার সুযোগ হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।

লেখক সম্পর্কে

মাওলানা ইসমাইল রেহানের লেখার সাথে আমার পরিচয় ২০১৫ সালে। সে সময় তার লিখিত শেরে খাওয়ারেজম সুলতান জালালুদ্দিন বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। বলতে গেলে এই বইটি পড়ে প্রচন্ড মুগ্ধ হই। ইতিহাসের একেকটি তথ্য যে কত গভীর থেকে তুলে আনা যায় তা এই বই পড়েই বুঝতে পারি। (প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই বইটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করার সুযোগ হয়েছে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহ)।

মাওলানা ইসলাম রেহান জামিয়াতুর রশিদ করাচির ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। ইতিহাসের বিভিন্ন অংশ নিয়ে ইতিপূর্বে তার বেশকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো বেশ জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়েছে বোদ্ধামহলে। ২০১১ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ইসলামের পুরো ইতিহাস নিয়ে কাজ করবেন। সে বছর থেকে অন্য সকল কাজ ছেড়ে তিনি পড়াশোনা ও লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে যান। আট বছর কাজ শেষে ২০১৯ সালে এর প্রথম তিন খন্ড প্রকাশিত হয়। তিন খন্ডে মোট ২৯৯৬ পৃষ্ঠার বিশাল এই গ্রন্থ মাওলানা ইসমাইল রেহান রচনা করেছেন কোনো সরকারি ফান্ড ও বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ছাড়াই। একক উদ্যোগে। এটি তার সুউচ্চ মনোবল ও দৃঢ়তার পরিচয় দেয়। এই বইয়ের বাকি তিন খন্ডের কাজও শেষ। শীঘ্রই সেগুলো প্রকাশিত হবে।

তারিখে উম্মতে মুসলিমা

ইতিহাসের এত বইপত্র থাকতে লেখক কেন এই বইটি লিখতে গেলেন সে প্রশ্নের জবাব তিনি ভূমিকাতেই দিয়েছেন। তিনি চেয়েছেন সাধারণ পাঠকদের জন্য এমন একটি বই রচনা করতে যেখানে এক মলাটে ইসলামের পুরো ইতিহাস তুলে আনা হবে। যেটি তথ্যের বিচারে হবে সমৃদ্ধ, আবার বিশুদ্ধতাও বজায় থাকবে। এছাড়া ইতিহাসের যে অংশ নিয়ে সংশয় ও প্রশ্ন ছড়ানো হয় সেগুলোরও জবাব থাকবে। পুরো বইতে লেখক কাজ করেছেন প্রাচীন উৎসগ্রন্থে থাকা তথ্য নিয়ে। তারপর সেগুলো নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষন করেছেন। পাঠকের সামনে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করেছেন। বইটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বইয়ের শুরুতেই কিছু তথ্য দেয়া আছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো,

১। হজরত আদম (আ) থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঘটনাবলীর ইতিহাস।
২। মাগাজি ও মুশাজারাত সংক্রান্ত আলোচনায় হাদিসের ছাত্রদের জন্য অত্যন্ত উপকারি আলোচনা।
৩। সন্দেহজনক বর্ননাগুলো সনদ ও মতনের দিক থেকে যাচাই।
৪। দাওয়াত ও ইলাল্লাহ ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ।
৫। সেক্যুলার ও ওরিয়েন্টালিস্ট কর্তৃক মুসলিম শাসক ও সেনাপতিদের উপর যেসব আপত্তি ও প্রশ্ন তোলা হয় তার খন্ডন।
৬। প্রাচীন উৎস থেকে তথ্য নেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে।
৭। প্রতিটি তথ্যের সাথে রেফারেন্স দেয়া হয়েছে।
৮। বিভিন্ন স্থানে ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা বলে দেয়া হয়েছে।
৯। লেখার ধরণ সহজবোধ্য। পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য আকর্ষনীয় ভংগিতে লেখা হয়েছে।
১০। ইতিহাস-শাস্ত্রের সংজ্ঞা, উসুল ও পাঠ-পদ্ধতী নিয়ে সমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ দেয়া হয়েছে।
এবার বইটি নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটু আলোচনা করা যাক। কোন খন্ডে কী আছে তা জানা যাক। এই আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, সাধারণ পাঠকের মনে যেন বইটি পাঠের আগ্রহ জেগে উঠে।

প্রথম খন্ড

প্রথম খন্ডের শুরুতে আছে ৪৮ পৃষ্ঠা দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধের নাম ‘তারিখ কেয়া হ্যায়’। এই প্রবন্ধে লেখক ইতিহাস শাস্ত্রের সংজ্ঞা, প্রয়োজনীয়তা, মুসলমানদের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস ও বেশ কয়েকজন মুসলিম ঐতিহাসিকের রচনাবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইতিহাসের যে কোনো পাঠকের জন্য এই আলোচনাটি জরুরি ছিল। বর্তমানে আমাদের দেশে বিক্ষিপ্তভাবে ইতিহাসের অনেক কাজ হলেও সাধারণ পাঠকের জন্য এর উসুল ও প্রয়োগ সম্পর্কে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। অথচ এই বিষয়টি জরুরি।
এই প্রবন্ধের পর লেখক শুরু করেছেন পৃথিবীর সূচনা ও নবী রাসুলদের জীবনি অংশ। অবশ্য নবী রাসুলদের জীবনি নিয়ে লেখক খুব দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এমন বলা যাবে না। তিনি মোটামুটি সংক্ষিপ্ত আকারে নবিদের আলোচনা করে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাতের আলোচনা করেছেন।

সীরাত অংশটি ৩১৯ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। এই অংশের আলোচনা এতটাই সমৃদ্ধ চাইলে শুধু এই অংশকেই একটি পৃথক সীরাত গ্রন্থ হিসেবে ছাপানো যেতে পারে। লেখক সীরাতের গুরুত্বপূর্ন কোনো অংশকেই বাদ যেতে দেননি। সংক্ষেপে হলেও তুলে আনার চেষ্টা করেছেন।
বইয়ের বাকি অংশে আলোচনা করেছেন খেলাফতে রাশেদার শাসনের শুরু থেকে হজরত উসমান (রা) এর শাসন পর্যন্ত। শেষদিকে উম্মুল মুমিনিনদের জীবনি আলাদা করে আলোচনা এসেছে। এছাড়া এসেছে বেশ কয়েকজন সাহাবির জীবনি। জীবনিগুলো এক দুই পাতা করে হলেও এটি পাঠকের জন্য অনেক উপকারি হবে। এমনকি তালিবুল ইলমদের জন্যও। কেউ যদি উনাদের জীবনি বিস্তারিত জানতে চায় তাহলে রেফারেন্সে দেয়া বইগুলি পড়লেই হবে। প্রথম খন্ডটি মোট ৭৬৬ পৃষ্ঠা।

দ্বিতীয় খন্ড

এই খন্ডে ৩৫ হিজরী থেকে ৭৪ হিজরী পর্যন্ত সময়কালের ঘটনাবলী আলোচনা করা হয়েছে। মুশাজারাতে সাহাবা, হজরত মুয়াবিয়া (রা) এর শাসন, মারওয়ানের ব্যক্তিত্ব, উমাইয়া শাসন সম্পর্কে মূল্যায়ন সবগুলো জরুরি বিষয় উঠে এসেছে এই খন্ডে। বইয়ের শুরুতে লেখক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ সংযুক্ত করেছেন, যেখানে তিনি আলোচনা করেছেন মুশাজারাতে সাহাবা নিয়ে আলোচনার মানদন্ড কী হবে তা নিয়ে। ঐতিহাসিকদের বর্ননাগুলো কোন স্তরের গ্রহনযোগ্যতা রাখে এটি নিয়েও সুন্দর আলোচনা করেছেন।
মুশাজারাতে সাহাবা ইস্যুতে তারিখে তাবারিতে নানা ধরনের বর্ননা এসেছে। এমনকি অনেক সময় একই বিষয়ে দুই রকম ভিন্ন বর্ননাও এনেছেন তাবারি। এই বর্ননাগুলোকে ঢাল করে অনেকে সাহাবায়ে কেরামের সম্মানে আঘাত হানার চেষ্টা করে। ইসমাইল রেহান তাই তাবারির বর্ননার স্তর নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাবারি কোনো তথ্য উদ্ধৃত করা মানেই যে সমর্থন করা নয়, এই ব্যপারটিও তিনি শাস্ত্রীয় আঙ্গিকে স্পষ্ট করেছেন।
মুশাজারাতে সাহাবা সংক্রান্ত বানোয়াট বর্ননাগুলো যাদের মাধ্যমে এসেছে যেমন আবু মিখনাফ, মুহাম্মদ বিন সায়িব কালবি ও অন্যান্যদের সম্পর্কেও ইমামদের মূল্যায়ন উদ্ধৃত করে দিয়েছেন। এই অংশের আলোচনাটি এতটাই মুগ্ধকর, যে কোনো পাঠক তরতর করে সামনে এগিয়ে যাবেন। বিষয়টি শাস্ত্রীয় হলেও এটি পাঠে পাঠকের কোনো কষ্ট হবে না, বরং তার আগ্রহই বাড়বে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই অংশের আলোচনা কয়েকবার পড়েছি। এতটা তৃপ্ত হয়েছি যা বলার মত নয়।

মুশাজারাতে সাহাবা সংক্রান্ত বুনিয়াদি উসুল বলে লেখক প্রথমে পাঠককে তৈরী করেছেন এর পর তিনি প্রবেশ করেছেন মুশাজারাতে সাহাবার আলোচনায়। এটি তার অসাধারণ বিচক্ষণতা প্রমান করে। তিনি প্রথমে পাঠককে উসুল বুঝিয়েছেন। এরপর প্রবেশ করেছেন এমন আলোচনায় যেখানে পাঠক উসুল প্রয়োগ করে সঠিক অবস্থানে যেতে পারে। ইতিহাসের অন্য যেসকল বই পড়েছি তাতে সাধারণত এই আঙ্গিক ফলো করা হয়নি। ফলে নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থেকেই গেছে।
মুশাজারাতে সাহাবা ইসলামের ইতিহাসের এক বিপদজনক চোরাবালি। এই চোরাবালিতে আটকে গেছেন নিকট অতীতের অনেক খ্যাতনামা স্কলারও। কিন্তু মাওলানা ইসমাইল রেহান অত্যন্ত নিরাপদে এই অংশ পার হয়েছেন। কাউকে আঘাত না করে, সবার প্রতি সম্মান বজায় রেখে তিনি পথ করে নিয়েছেন। বইয়ের শুরুতে মুফতি তাকি উসমানি সাহেব যে ভূমিকা দিয়েছেন সেখানে তিনিও এই বিষয়টির প্রশংসা করেছেন।
মুশাজারাতে সাহাবা সংক্রান্ত আলোচনাটিও এতটাই সমৃদ্ধ, আমার মনে হয়েছে শুধু এই অংশটিও আলাদা অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হতে পারে। বাংলায় এই বিষয়ে এখনো এমন প্রামান্য ও নির্ভরযোগ্য বইপত্র রচনা হয়নি।
মুশাজারাতে সাহাবার প্রারম্ভে সাবাঈদের চক্রান্তের স্বরুপ কী ছিল তা নিয়েও রয়েছে দীর্ঘ আলোচনা। এই অংশে লেখক বেশ কিছু দীর্ঘ টীকা দিয়েছেন, যা তালিবুল ইলমদের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে, ইনশাআল্লাহ। মুশাজারাতে সাহাবা সংক্রান্ত আলোচনার পর এই অংশের ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। এই আলোচনাটিও জরুরি একটি প্রয়োজন পূর্ন করেছে।

হজরত মুয়াবিয়া (রা) ও ইয়াযিদের শাসনকাল নিয়েও আলোচনা করেছেন দীর্ঘ পরিসরে। নানা সংশয় ও প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তাত্ত্বিকভাবে। হাররার ঘটনা নিয়েও রয়েছে আলোচনা। এই অংশে তিনিও ডক্টর আকরাম জিয়া উমারির মত গনধর্ষনের ঘটনাকে ভিত্তিহীন বলেছেন এবং মাদায়িনির বর্ননাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বইয়ের শেষে প্রায় তিনশো পৃষ্ঠা ধরে তিনি আলোচনা করেছেন এই সময়কালের ঘটনাবলি নিয়ে উপস্থাপিত নানা সংশয় ও সন্দেহের। হজরত উসমান (রা) এর শাসনামল নিয়ে যেসকল প্রশ্ন ও আপত্তি তোলা হয় এগুলো নিয়ে সুন্দর আলোচনা এসেছে। আম্মার (রা) শাহাদাত সম্পর্কে যে বর্ননা এসেছে তা নিয়েও আলোচনা করেছেন। এ সম্পর্কে ইবনু হাজার আসকালানি, ইমাম কুরতুবি, ইবনু তাইমিয়্যা, ইবনু কাসির প্রমুখের মতামত উল্লেখ করেছেন। এ অংশের আলোচনা এতটাই চমৎকার যা মন প্রশান্ত করে দেয়। সাধারণত ইতিহাসের বইতে গৎবাঁধা বর্ননা দিয়ে চলে যাওয়া হয়। এ সম্পর্কে আলেমদের মতামত উল্লেখ করা হয় না। কিন্তু মাওলানা ইসমাইল রেহান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় আলেমদের মতামত এনেছেন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের সঠিক অবস্থানটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের দুয়েকটি বর্ননা এনে অনেকে প্রমান করতে চান হজরত মুয়াবিয়া (রা) এর আদেশে মসজিদের মিম্বরে হজরত আলী (রা) কে গালি দেয়ার নিয়ম চালু হয়েছিল। বর্তমানে পাকিস্তানের ইঞ্জিনিয়ার আলি মির্জা এই বিষয়ে শক্ত অবস্থান রাখেন। লেখক এই বর্ননাগুলো নিয়েও আলোচনা করেছেন। নিখুত বিশ্লেষণে প্রমান করেছেন, হজরত মুয়াবিয়া (রা) এর চরিত্র এই অপবাদ থেকে মুক্ত ছিল।

তবে ইয়াযিদের অন্যায় ও পাপাচারের বিষয় তিনি নির্দ্বিধায় আলোচনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইরের খিলাফত কেন যৌক্তিক ছিল তাও বেশ শক্ত ভাষায় বলেছেন। এই অংশে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছেন। সাধারণত দেখা যায় গবেষকদের অনেকেই প্রান্তিকতার স্বীকার হন। তারা কেউ শিয়াদের বানোয়াট বর্ননার উপর ভিত্তি করে বনু উমাইয়ার উপর তীব্র আক্রমন করেন। আবার কেউ বনু উমাইয়াকে বাঁচাতে গিয়ে অন্য সাহাবিদের উপর আক্রমন করে বসেন। শেষের প্রান্তিকতার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হলেন মুহিব্বুদ্দিন ইবনুল খতিব। আল আওয়াসিম মিনাল কাওয়াসিমে’র টীকায় তিনি বনু উমাইয়াকে বাঁচাতে গিয়ে আক্রমন করে বসেছেন আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইরের উপর। একদিকে তিনি মাদায়িনির বর্ননা নেয়া যাবে না বলে বনু উমাইয়াকে বাঁচিয়েছেন। অপরদিকে তিনি মাদায়িনির বর্ননা এনেই আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইরের ব্যাপারে মন্তব্য করে বসেছেন। মাওলানা ইসমাইল রেহানের লেখায় এমন কোনো প্রান্তিকতা চোখে পড়েনি। তিনি বনু উমাইয়ার উপর আরোপিত অন্যায় অপবাদ সম্পর্কে যেমন আলোচনা করেছেন, তেমনি বনু উমাইয়া যেখানে অপরাধি সেখানেও তাদের ছাড়া দেননি। আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে তিনি যে আঙ্গিকে আলোচনা করেছেন তা সামনে আনলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, পিতার মসনদ সামলানোর আগে তিনি দিনরাত কোরআন, হাদিস ও ফিকহ পাঠে ব্যস্ত ছিলেন। অধিক নফল ও তিলাওয়াত ছিল তার নিয়মিত রুটিন। কবিরা গুনাহ দূরে থাক, সন্দেহজনক বিষয় থেকেও দূরে থাকতেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরের (রা) বিরুদ্ধে যখন মারজে রাহেত যুদ্ধ সংঘঠিত হয়, যেখানে বনু উমাইয়ার প্রায় সকল আমির ও সেনাপতিরা অংশ নিয়েছিলেন, সে যুদ্ধে তিনি অংশ নেননি। কারন, তার মনে হতো, আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইরের বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপ সন্দেহজনক। সতর্কতা হলো এসবে না জড়ানো। কিন্তু তার হাতে যখন শাম ও সিরিয়ার শাসনভার এলো তখন তিনি কোনোভাবেই আর আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইরকে শরয়ী খলিফা মানতে রাজি ছিলেন না। যে কোনো মূল্যে তার শাসনের অবসান করতে প্রস্তুত ছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক স্বার্থ মানুষের চিন্তাধারা ও কর্মকান্ডকে কীভাবে বদলে দেয়। (তারিখে উম্মতে মুসলিমা, ২/৫৭৮)
মারওয়ান সম্পর্কেও তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার অনৈতিক কর্মকান্ড তুলে ধরেছেন। তার সম্পর্কে ইলমুর রিজালের ইমামদের মত তুলে ধরে বলেছেন, সে সাহাবি ছিল না। ইবনু কাসিরের একটি ইবারত এনে তার বিশ্লেষণও করেছেন। সহিহ বুখারিতে কেন মারওয়ানের হাদিস বর্নিত হয়েছে তা নিয়েও আলোচনা করেছেন। এই আলোচনাগুলোও গতানুগতিক ইতিহাসগ্রন্থে সাধারণত অনুপস্থিত থাকে। দ্বিতীয় খন্ডটি পুরোটিই জটিল ও স্পর্শকাতর আলোচনায় সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু লেখক অত্যন্ত সাবলীলভাবে এই অংশ পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। আলোচনার পরতে পরতে তার সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত অধ্যয়নের প্রমান মেলে।

তৃতীয় খন্ড

এই খন্ডটি মোট ১১০০ পৃষ্ঠা। শুরুর সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠায় এসেছে উমাইয়া শাসনের ইতিহাস। বাকি সাড়ে সাতশো পৃষ্ঠায় এসেছে আব্বাসি ও অন্যান্য সমকালীন শাসনের ইতিহাস। শুরুতে আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান ও অন্যান্য শাসকদের আলোচনা করেছেন তিনি। আন্দালুস জয়ের আলোচনাও এনেছেন সংক্ষিপ্ত পরিসরে। আন্দালুস নিয়ে তিনি ৫ম খন্ডে বিস্তারিত আলোচনা করবেন তাই এখানে সংক্ষিপ্ত ইশারা দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনা করেই ক্ষান্ত হননি। বনু উমাইয়া শাসনামলে চিন্তার ইতিহাসও আলোচনা করেছেন। শিয়া, নাসেবি, খাওয়ারিজ, মুরজিয়াজা, জাবরিয়া, কাদরিয়া ও অন্যান ফিরকাগুলোর ইতিহাস আলোচনা করেছেন। কখনো কখনো চিন্তা কীভাবে রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রভাব ফেলেছে তাও তুলে ধরেছেন নির্ভরযোগ্য সূত্রের সাহায্যে। বনু উমাইয়া শাসনের শেষদিকে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইমাম আবু হানিফার জীবনি এনেছেন।
আব্বাসিদের উত্থানের শুরু নিয়েও রয়েছে নানা বানোয়াট ও মিথ্যা বর্ননার জাল। আকবর শাহ নজিবাবাদির বইতো এক্ষেত্রে আকরগ্রন্থ। মাসউদি, ইয়াকুবি বা কিতাবুল আগানি থেকে যারাই আব্বাসিদের ইতিহাস গ্রহন করেছেন তারা এই সমস্যায় পড়েছেন। আবুল আব্বাস সাফফাহ ও অন্যদের নিয়ে যেসকল বানোয়াট বর্ননা ছড়িয়েছে ইসমাইল রেহান এর স্বরুপ উন্মোচন করেছেন। আব্বাসিদের সাথে আলাবিদের দ্বন্দের কথাও প্রয়োজন অনুসারে আলোচনা করেছেন। হারুনুর রশিদের শাসনকালের আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই বিস্তৃত পরিসরে এসেছে। বারামেকাদের সাথে খলিফার দ্বন্দ্ব, রোমানদের বিরুদ্ধে জিহাদ এগুলোও বাদ পড়েনি। এ সময়ের প্রভাবশালী আলেম ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহর জীবনি ও তার মুয়াত্তা মালিক গ্রন্থ সম্পর্কেও আলোচনা এসেছে। আব্বাসিদের সমান্তরাল অন্য শাসনগুলো যেমন বুয়াইহি শাসন, সেলজুক শাসন, উবাইদি সাম্রাজ্য, বাতেনিদের শাসন, তুলুনি সাম্রাজ্য, তাহেরি সাম্রাজ্য এসব নিয়েও রয়েছে আলোচনা। তবে বাদ পড়েছে গজনী সাম্রাজ্য ও ঘুরী সাম্রাজ্যের আলোচনা। সম্ভবত এই আলোচনা অন্য খন্ডে আসবে।
সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে এই সময়ের প্রখ্যাত আলেমদের জীবনি। চার ইমাম ও হাদিস শাস্ত্রের সংকলকদের জীবনি ছাড়াও ফকিহ, সুফি ও মুফাসসিরদের জীবনিও এসেছে। বিশেষ করে মুতাসিমের সাথে শেষের দিকে ইবনু জারির তাবারির জীবনি ও লেখালেখি নিয়েও একটু দীর্ঘ পরিসরে আলোচনা করেছেন। ইবনু জারির তাবারি হজরত মুয়াবিয়া (রা) কে লানত করতেন বলে যে কথা প্রচার করা হয়, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।

বইটি নিয়ে আমার মূল্যায়ন বলি। এই বইটি পড়ে যে তৃপ্তি পেয়েছি খুব কম বইতেই তা পেয়েছি। প্রতিটি কথা দালিলিকভাবে এনেছেন, বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, তারপর সামনে এগিয়েছেন। বইটিকে নীরস বা কাঠখোট্টাও মনে হয়নি। আগাগোড়াই লেখাতে একটা আদব ও রুহানিয়তের ছোঁয়া ছিল বলে মনে হয়েছে। বারবার মনে হয়েছে লেখক ইনসাফ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কোনো পক্ষকে জুলুম করেননি। যা সত্য তা-ই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। আর প্রতিটি তথ্যের শেষে মাসাদির থেকে দেয়া উদ্ধৃতি মন প্রশান্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি একই তথ্যের উদ্বৃতি একাধিক গ্রন্থ থেকেও দিয়েছেন, যা পাঠকের জানার পরিধি বাড়াবে। প্রতিটি খন্ডের সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয় হলো ওই খন্ডে আলোচিত বিষয়ের উপর যে প্রশ্ন ও সংশয় আসে, সেগুলোর জবাব দিয়েছেন তিনি। অবশ্য কোনো খন্ডেই সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা আসেনি। সম্ভবত ষষ্ঠ খন্ডে এই বিষয়ে আলোচনা করবেন।
এক কথায় পুরো বইটিকে অত্যন্ত উপকারী মনে হয়েছে। সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি তালিবুল ইলমদের জন্যও বইটি উপকারী হবে বলেই মনে হচ্ছে। বইয়ের শুরুতে মুফতি তাকি উসমানি সাহেবের ভূমিকা বইটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে সন্দেহ নেই। এছাড়া মাওলানা মনজুর মেংগল সাহেবও একটি বানী দিয়েছেন। সুখের কথা হলো, বইটি অনুবাদের কাজ শুরু করেছে মাকতাবাতুল আযহার। শীঘ্রই বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ।

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন