হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগ। ঘটনাস্থল ইস্ফাহান।
বেড়াতে এসে এমন একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বেন ভাবতেই পারেননি মাকদিসি । লোকজনের মুখে এক বৃদ্ধের সুনাম শুনে এসেছিলেন তার সাথে দেখা করতে। নানা বিষয়ে কথা হচ্ছিল। এক ব্যক্তির প্রসঙ্গে আলাপ উঠলে বৃদ্ধ বিরক্ত স্বরে বললেন, তার উপর আল্লাহর লানত পড়ুক। সে এক নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছে। সে বলে বেড়ায় হজরত মুয়াবিয়া নাকি আল্লাহর রাসুল না।
চমকে গেলেন মাকদিসি । নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। ভালো করে তাকালেন বৃদ্ধের চেহারার দিকে। একবার ভাবলেন বৃদ্ধ হয়তো রসিকতা করছেন কিন্তু চেহারা দেখে তেমনটা মনে হলো না তার।
‘কী বলছেন আপনি? আপনি কি মুয়াবিয়া রাদি.-কে রাসুল মানেন?’ প্রশ্ন করেন মাকদিসি ।
‘অবশ্যই আমি তাকে রাসুল মনে করি। আমরা কোনো রাসুলকে বাদ দেই না’ বৃদ্ধ দৃঢ় কন্ঠে বললেন।
‘এভাবে বলবেন না। তিনি রাসুল নন’ শেষ চেষ্টা চালালেন মাকদিসি ।
‘তুমি অবশ্যই রাফেজি। লানত পড়ুক আলির উপর’ বৃদ্ধ উত্তেজিত কন্ঠে চিৎকার করতে থাকেন। বৃদ্ধের চিৎকার শুনে ছুটে আসে তার ভক্তরা।
‘এই লোক রাফেজি। একে শায়েস্তা কর’ চিৎকার করতে থাকে বৃদ্ধ। ফুটন্ত তেলের মত ছুটে এলো তার লোকেরা। ভাগ্য ভালো মাকদিসির। তার সাথেও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছিল। অনেক কষ্টে তারা উত্তেজিত লোকজনের হাত থেকে উদ্ধার করলেন মাকদিসিকে।
‘এই লোকেরা প্রায়ই এমন অনেক ঘটনা ঘটাতো’ বিরক্ত মাকদিসি পরে নিজের সফরনামায় লিখেছিলেন।
পরের ঘটনাটা ৭৫ বছর আগের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত পাঞ্জাবের কিছু মুসলমান সেনা ছুটি কাটাতে গেল গ্রামে। কদিন পর তাদের নিয়ে পত্রিকায় ছাপা হল চাঞ্চল্যকর সংবাদ। গ্রামে গিয়ে শয়তান উপাসনায় জড়িয়েছে তারা। শয়তানের মূর্তি বানিয়ে নানাভাবে তার উপাসনা করছে প্রতিনিয়ত।
বাহ্যত মাকদিসির ঘটনার সাথে প্রায় এক হাজার বছর পরের পাঞ্জাবের এই ঘটনার কোনো মিল নেই। কিন্তু একটু ভেতরে প্রবেশ করতেই জানা যায় অদ্ভুত এক ধর্মবিশ্বাস লালনকারী জনগোষ্ঠীর কথা। হাজার বছর ধরে যারা সযত্নে লালন করে আসছে নিজেদের অদ্ভুত সব কুসংস্কার ও ধর্ম-বিশ্বাস।
সাধারণত এরা গোপনিয়তার সাথে নিজেদের ধর্ম-বিশ্বাস পালন করলেও সিরিয়ায় আইএসের অভ্যুত্থানের পর সারা বিশ্বে এরা পরিচিতি লাভ করে। অদ্ভুত বিশ্বাস লালনকারী এই জনগোষ্ঠির নাম ইয়াজিদি।
ইয়াজিদি নামে দুটি গোষ্ঠি আছে। প্রথমত, আর্মেনিয়ায় বসবাসকারি ইয়াযিদি গোষ্ঠী, যারা মনু ধর্মের অনুসারী। তাদের মতে ভালো কাজের জন্য রয়েছেন ভিন্ন স্রষ্টা। তার নাম ইয়াযদা। ইয়াযদার অনুসারি বলে তারা নিজেদেরকে ইয়াযিদি বলে পরিচয় দেয়।
দ্বিতীয়ত, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কে বসবাসরত ইয়াজিদি সম্প্রদায় যারা নিজেদেরকে ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার দিকে সম্পৃক্ত করে ইয়াযিদি বলে। আমাদের আজকের আলোচনা পরের দলটিকে নিয়ে।
উত্থান
ইয়াজিদিদের উত্থান শুরু হয় ১৩২ হিজরিতে আব্বাসিদের হাতে উমাইয়াদের পতনের পর। ক্ষমতা হারানোর পর উমাইয়া পরিবারের প্রভাবশালী সদস্যরা মুসলিম বিশ্বের নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। সে সময় উমাইয়াদের একজন আমির ইবরাহিম বিন হারব বিন খালিদ পালিয়ে উত্তর ইরাক চলে যান। সেখানে বসবাসরত কুর্দি জনগোষ্ঠি তাকে আশ্রয় দিলে তিনি সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। কুর্দিদের সাথে সে সময় উমাইয়াদের একটা ভালো সম্পর্ক চলছিল। কারণ সর্বশেষ উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানের মা ছিলেন কুর্দি।
এই সময়টা ছিল উমাইয়া পরিবার ও তাদের সমর্থকদের জন্য খুবই প্রতিকূল সময়। একদিকে রাজনৈতিক শক্তি হারানোর কারণে তাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে আব্বাসিরা, অন্যদিকে আগ থেকেই তাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে আছে খারেজি ও শিয়ারা। নিজেদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে উমাইয়ারা হারিয়েছে জনসমর্থন। তাদের বিরুদ্ধে চলছে সত্য-মিথ্যা নানা প্রচারণা।
ইবরাহিম বিন হারব সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তার মনে হলো আবারও জনসমর্থন যোগাড় করতে হবে। এই চিন্তা থেকে তিনি কুর্দিদের মাঝে বসবাস করে উমাইয়াদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করতে থাকেন। যেহেতু সে সময় আহলে বাইতের উপর জুলুম নির্যাতনের কারণে ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়া ছিলেন অজনপ্রিয় ও অপছন্দনীয় একজন শাসক, ফলে ইবরাহিম সিদ্ধান্ত নেন প্রথমে ইয়াযিদের ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে হবে। ফলে ইবরাহিম ইয়াযিদের পক্ষে নানা কথা বর্ননা করতে থাকে । সে তার অনুসারিদের বলতে থাকে ইয়াযিদ ছিলেন একজন নেককার শাসক। তার জুলুমের ব্যাপারে যত কথা ছড়ানো হয় সব বানোয়াট। ধীরে ধীরে অনেকেই তার এই মত গ্রহণ করে। তারা বলতে থাকে ইয়াযিদকে লানত করা যাবে না।
এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কারণ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আলেমরাও সতর্কতাস্বরূপ ইয়াযিদকে লানত না করার কথাই বলেন, কিন্তু ইবরাহিমের অনুসারীরা এই বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে বসে। তারা বলে দেয় যে ইয়াযিদকে লানত করবে সে কাফের। ইবরাহিমের মৃত্যুর পর তার বংশধররাও এই বিশ্বাস জোরেশোরে প্রচার করতে থাকে। ধীরে ধীরে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে একের পর এক বিকৃতি প্রবেশ করতে থাকে। যেহেতু ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার প্রতি চরম মাত্রায় ভক্তি বিশ্বাস প্রচার করাই ছিল এদের মূল কাজ, ফলে সমাজে এরা পরিচিত হয় ইয়াযিদি নামে।
ইয়াজিদিদের মতে, ইয়াযিদকে লানত করা যাবে না। লানত অত্যন্ত নিকৃষ্ট শব্দ। নিজেদের এই দাবিকে মজবুত ভিত্তি দেয়ার জন্য দাবি করে শুধু ইয়াযিদ কেন, কোনো মানুষকেই লানত করা যাবে না। জবাবে তাদেরকে বলা হলো , কোরআনে তো আল্লাহ শয়তানকে লানত করেছেন। বাধ্য হয়ে তারা এবার বিকৃতির গভীরে চলে গেল। তারা বললো, আল্লাহ শয়তানকে লানত করেননি। আল্লাহ কখনোই এসব বাজে শব্দ ব্যবহার করতে পারেন না। এটা তার শানে যায় না। তাছাড়া শয়তানকেই বা লানত করা হবে কেন? শয়তানতো পৃথিবীর প্রথম একত্ববাদী মুওয়াহহিদ। কারন সে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো গাইরুল্লাহকে (আদম আ) কে সিজদা করতে রাজি হয়নি। ফেরেশতারা গাইরুল্লাহকে সিজদা করেছে কিন্তু শয়তান করেনি। ফলে তাকে খারাপ ভাবা বা লানত করার প্রশ্নই আসেনা।
বিকৃতির এই পর্যায়ে এসে ইয়াজিদিরা দাবি করে বসলো, কোরআনের যেসব আয়াতে শয়তানকে লানত করা হয়েছে এগুলো মূল কোরআনে ছিল না। এগুলো পরে কেউ বিকৃত করে প্রবেশ করিয়েছে। একইসাথে ইয়াজিদিরা দাবি করে বসে ইয়াযিদ ছিল নবী। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলে বসে, ইয়াযিদ মূলত খোদা। এই উদ্ভট দাবিও মেনে নেয় অনেকে। এমনকি দামেশক, হালাব ও সানজার শহরে এদের অল্পস্বল্প অনুসারী জুটে যায়। হিজরি সপ্তম শতাব্দিতে ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা যখন দামেশকে বসবাস করছিলেন, সে সময় তিনি এদের অনেকের দেখা পেয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে তিনি এদের আকিদা বিশ্বাসের খণ্ডন করে রচনা করেন আর রিসালাতুস সান্নিয়্যাহ ফিত তইফাতিল আদাবিয়্যা নামে একটি গ্রন্থ।
ইবনু তাইমিয়্যার এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় ইয়াজিদিদের মধ্যে বিকৃত-বিশ্বাসের বড় একটি অংশ সংযোজন হয়েছে ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে তাদের একজন ধর্মগুরু আদি বিন মুসাফিরের ইন্তেকালের পর। তিনি বসবাস করতেন বর্তমান তুরস্কের হাক্কারি অঞ্চলে। আদি বিন মুসাফির একজন নেককার মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। এমনকি তিনি ছিলেন শায়খ আবদুল কাদির জিলানির শিষ্য। কিন্তু তার ইন্তেকালের পর তার ভাতিজা সখর বিন সখর যখন চাচার পদে বসেন তখন তিনি একের পর এক বিকৃত আকিদা সংযোজন করেন।
শয়তানের প্রতি ইয়াযিদিদের যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তা সংযোজিত হয়েছে তাদের একজন গুরু শামসুদ্দিন আবু মুহাম্মদের সময়। এই ব্যক্তি ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দে মারা যায়। এই ব্যক্তি বেশকিছু বই লিখেছিল যার মধ্যে আল জালওয়াহ লি আসহাবিল খলওয়াহ ও হিদায়াতুল আসহাব উল্লেখযোগ্য। শামসুদ্দিন আবু মুহাম্মদ কৌশলে ইয়াজিদিদের কালিমায় নিজের নাম ঢুকিয়ে দেয়। আধুনিক ইয়াযিদিদের অনেকেও এখনো তার নাম নিয়ে কালিমা পাঠ করে।
হিজরি সপ্তম শতাব্দিটি ছিল ইয়াজিদিদের জন্য নাজুক সময়। তাতার-সেলজুক দ্বন্দ্বের মাঝে তারা কোনো রকমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। তবে ইয়াজিদিরা একটা কাজ করেছিল। তারা নিজেদের জন্য আমির নির্ধারণ করেছিল। একজন আমিরের মৃত্যুর পর আরেক আমির মনোনীত হত। এভাবে তারা উত্তর ইরাক ও সিরিয়ায় যেখানে তাদের বসতি ছিল, সেখানে নিজেদের ধর্মবিশ্বাস-সহই টিকে ছিল।
১৯৬৯ সালে ইয়াজিদিদের আমির বাইয়াযিদ আল উমাবি বাগদাদের রশিদ সড়কের পাশে একটি প্রকাশনা খুলে বসে। তার উদ্দেশ্য ছিল এই প্রকাশনার মাধ্যমে ইয়াযিদ ও উমাইয়াদের প্রতি মহত্ত্ব প্রচার করে এই ধারাকে আরো বেগবান করা। ইয়াযিদিদের সর্বশেষ আমির ছিল তাহসিন বিন সাদ আমিরুশ শাইখান।
ইয়াজিদিদের আকিদা-বিশ্বাস
ইয়াজিদিদের বিকৃত আকিদার সূচনা হয়েছিল উমাইয়াদের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা থেকে। শুরুর দিকে তারা ইয়াযিদকে একজন নেককার ও আদিল শাসক হিসেবে প্রচার করেই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে এই বিশ্বাস ততই ডালপালা মেলেছে, বিস্তৃত হয়েছে। সর্বশেষ পর্যায়ে তারা শয়তানকেই উপাস্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। এক নজরে তাদের কিছু আকিদা-বিশ্বাস দেখা যাক।
১. ইয়াজিদিরা মনে করে শয়তান এক পবিত্র সত্তা। সে পৃথিবীর প্রথম মুওয়াহহিদ। তার নামে কোরআনের যেসব আয়াতে লানত বা নিন্দা করা হয়েছে, এগুলো কেউ বিকৃত করেছে। মূল কোরআনে এসব ছিল না। যেহেতু শয়তান পবিত্র সত্তা, তাই সে উপাসনা পাওয়ার যোগ্য। এজন্য তারা শয়তানের তামার মূর্তি বানিয়ে তার উপাসনা করে। শয়তানকে তারা নাম দিয়েছে তাউসুল মালাইকা বা ফেরেশতাদের ময়ূর।
২.ইয়াজিদিদের বিশ্বাস, ওক ও আখরোট গাছে পরিপূর্ণ ইরাকের লালিশ উপত্যকা একটি পবিত্র এলাকা। সম্ভবত এই স্থানকে বেছে নেয়ার কারণ হলো আদি বিন মুসাফিরের কবর এখানে।
৩. তাদের ধর্মগ্রন্থ মোট দুটি। এক – আল জালওয়াহ। এই গ্রন্থে আছে স্রষ্টার পরিচয় ও তার বিভিন্ন সিফাত। অপরটি কিতাবুল আসওয়াদ নামে একটি গ্রন্থ যেখানে পৃথিবীর সৃষ্টি, ফেরেশতা ও ইয়াযিদি ধারার ইতিহাস আছে।
৪. ইয়াজিদিদের কালিমা হলো, আশহাদু ওয়াহিদুল্লাহ, সুলতান ইয়াযিদ হাবিবুল্লাহ।
৫. ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার জন্মতারিখ অনুসারে ইয়াযিদিরা বছরে তিনদিন রোজা রাখে। তাদের ধর্মে এটিই রোজার বিধান।
৬. জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিকে লালিশ উপত্যকায় ইয়াযিদিরা তাদের হজ্ব পালন করে।
৭.ইয়াজিদিদের মতে বছরে একবার নামাজ পড়লেই সারা বছরের জন্য তা যথেষ্ট হয়ে যায়। ১৫ শাবান রাতে তারা এই নামাজ আদায় করে।
৮. পরকাল সম্পর্কে ইয়াযিদিদের বিশ্বাস হলো, ইরাকের সিনজার পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বাতিত গ্রামে সবাইকে পুনরুত্থিত করা হবে। সে সময় মিজানের পাল্লা থাকবে আদি বিন মুসাফিরের হাতে। তিনি সবার আমল মেপে ইয়াযিদিদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
৯. তাদের মতে একজন পুরুষ ৬টি বিবাহ করতে পারবে।
১০. তাদের ধর্মে নীল রঙ হারাম। কারণ এই পবিত্র রঙ শুধু তাউসুল মালাইকার জন্য নির্ধারিত।
১১. তাদের মতে লেখাপড়া করা হারাম। তাদের মধ্যে যারা ধর্মকর্ম মেনে চলে তারা এই বিষয়টি খুব মেনে চলে। এই বিশ্বাসে তারা এতটাই শক্ত ছিল যে নিজেদের ধর্মগ্রন্থেরও খুব বেশি কপি তারা তৈরী করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ ইরাক এলে তিনি ইয়াজিদিদের একটি ধর্মগ্রন্থের হস্তলিখিত কপি পেয়ে তা নিয়ে যান এবং জার্মানির মিউজিয়ামে দান করে দেন। আল জালওয়াহ নামক গ্রন্থটিরও মাত্র দুটি কপি কোনো মতে টিকেছিল। একটি সিনজার পাহাড়ে অন্যটি শাইখান নামক এলাকায় ইয়াযিদিদের উপাসনালয়ে। ইয়াজিদিদের মধ্যে কোনো কিছু লিখে রাখার প্রচলন ছিল না। ফলে তাদের সম্পর্কে জানার মাধ্যমও খুব সীমিত। তবে বর্তমানে আধুনিক ইয়াজিদিদের বড় অংশ এই বিশ্বাস ত্যাগ করে পড়াশোনা করে শিক্ষিত হচ্ছে।
১২. সূর্য উদয় ও অস্তের সময় তারা সূর্যের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করে এবং মাটি চুম্বন করে।
১৩. ইয়াজিদিদের ধর্মবিশ্বাসে অন্য ধর্মবিশ্বাসগুলোরও অনেক প্রভাব আছে। যেমন খ্রিস্টানদের তারা খুব সম্মান করে। তাদের মতে মদ হলো হজরত ঈসা আ.-এর প্রকৃত রক্ত। এজন্য তারা মদকেও খুব সম্মান করে এবং মদপানের সময় এর এক ফোঁটাও যেন মাটিতে না পড়ে সেদিকে সতর্ক থাকে। খ্রিস্টান পাদরিদেরকে তারা খুব সম্মান করে এবং তাদের হাত চুম্বন করা নিজেদের জন্য গৌরবের মনে করে। ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টানদের মতো ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের শিশুদের সর্বাঙ্গ পবিত্র পানিতে ডুবিয়ে দীক্ষা দেয়া হয়। প্রাচীন ইরানের যরথ্রুষ্ট ধর্মের অনেক আচরণ ইয়াজিদিদের মধ্যে দেখা যায়। অগ্নিপূজকদের কিছু রীতিও ইয়াজিদিরা গ্রহণ করেছে। ইয়াজিদিরা শিয়াদের কিছু বিশ্বাসও গ্রহণ করেছে। জাফরি শিয়ারা যেমন কারবালার মাটি সাথে বহন করে, ইয়াযিদিরাও তেমন আদি বিন মুসাফিরের কবরের মাটি সাথে বহন করে। মৃত্যুর পর এই মাটি ইয়াজিদিদের মুখে ভরে দেয়া হয়। যদি কারো মুখে এই মাটি দেয়া না হয় তাহলে ইয়াজিদিদের মতে সে কুফরির উপর মৃত্যুবরণ করেছে।
শেষকথা
২০১৮ সালের জরিপ থেকে অনুমান করা হচ্ছে সারা বিশ্বে বর্তমানে অন্তত ১৫ লক্ষ ইয়াজিদি বসবাস করছে। ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, ছাড়াও রাশিয়া, জার্মানি, আর্মেনিয়া, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায় তাদের অনেকে বসবাস করছে। ইয়াজিদিদের বেশিরভাগই কুর্দি এবং এই ভাষাতেই তারা কথা বলে অভ্যস্ত। তাদের বড় অংশ এখনো তাদের ধর্মবিশ্বাস নিয়েই টিকে আছে। ইউটিউবে অনেক ইয়াজিদি ধর্মগুরুর এই বিষয়ে আলোচনাও দেখা যায়।
ইয়াজিদিদের বিভ্রান্তির সূচনা হয়েছিল ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার প্রতি অতিভক্তিকে কেন্দ্র করে। শিয়ারা যেমন হজরত আলী রা-এর প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে জন্ম দিয়েছে নানা বিভ্রান্তি ও ফেতনা, ইয়াজিদিরাও শিয়া বিরোধিতার নামে হেটেছে সে পথেই। শুরুতে যা ছিল সামান্য আবেগ, দিনশেষে তা ইয়াযিদিদেরকে নিয়ে গেছে কুফরির পথে, বের করেছে ইসলামের গণ্ডি থেকে। ইয়াজিদিদের ইতিহাস আমাদেরকে একটা শিক্ষাই দেয়, যে কোনো বিকৃতি থামাতে কঠোর হস্তক্ষেপ করতে হবে এর শুরুতেই।
সূত্র:
১. আহসানুত তাকাসিম ফি মারিফাতিল আকালিম- মাকদিসি।
২. আল ইয়াযিদিয়্যাহ – সাইদ দিওয়াহজি
৩. আল ইয়াযিদিয়্যাহ ওয়া আসলু আকিদাতুহুম – আব্বাস আযযাবি।
৩. আল ইয়াযিদিয়্যুন – হাশিম বান্না।
৪. আল ইয়াযিদিয়্যুন ফি হাযিরিহিম ওয়া মাযিহিম – আবদুর রাজ্জাক হাসানি।
৫. তারিখে উম্মতে মুসলিমা – মাওলানা ইসমাইল রেহান।
৬. মাআরিফ, সেপ্টেম্বর ১৯৬১ সংখ্যা – দারুল মুসান্নেফিন আযমগড়।