১। তউস ইবনে কায়সানের দুনিয়া বিমুখতা
তউস ইবনে কায়সান রহিমাহুল্লাহ। ইয়ামানের এই তাবেয়ী উম্মুল মুমেনিন আয়েশা সিদ্দিকা (রা) ও আবু হুরায়রা (রা) থেকে হাদীস শ্রবণ করেন। তিনি ছিলেন দুনিয়া বিমুখ এক মনিষী। শাসকদের কাছে ঘেঁষা অপছন্দ করতেন। সত্য বলায় ছিলেন নির্ভীক। কারো প্রভাব প্রতিপত্তি দ্বারা প্রভাবিত হতেন না।
#
মুহাম্মদ বিন ইউসুফ। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাই। ইয়ামানের গভর্নর। এক অনুচরের হাতে ৫০০ দিনার দিয়ে বললেন, এটা তউস ইবনে কায়সানের হাতে দিয়ে আসো। যদি তাকে এই দিনারগুলো গ্রহণ করাতে পারো তাহলে তোমাকে পুরস্কৃত করবো।
অনুচর ৫০০ দিনার নিয়ে এলো তউস ইবনে কায়সানের কাছে। তউস ইবনে কায়সান দিনার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। অনেক চাপাচাপি করেও তাকে গ্রহণ করানো গেলো না। শেষে অনুচর দিনারের থলে তউস ইবনে কায়সানের ঘরের কোনে ছুড়ে ফেলে চলে গেল। গভর্নরকে বললো, তিনি দিনার গ্রহণ করেছেন। কিছুদিন পর মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ কোনো কারনে তউস ইবনে কায়সানের উপর ক্ষিপ্ত হন।
‘তাকে যে ৫০০ দিনার দিয়েছি ফেরত নিয়ে আসো’ একজনকে আদেশ দিলেন গভর্নর।
সেই ব্যক্তি এলো তউস ইবনে কায়সানের কাছে।
‘গভর্নর আপনাকে যে ৫০০ দিনার দিয়েছেন তা ফেরত দিন’ বলল সে।
‘আমি কোনো দিনার নেইনি’ তউস ইবনে কায়সান অস্বীকার করলেন।
প্রথম অনুচরকে ডাকা হলো। সে এসে বললো, দিনার আপনার ঘরে রেখে গিয়েছিলাম।
‘তাহলে যেখানে রেখেছো খুঁজে দেখো’ তউস ইবনে কায়সান বললেন। অনুচর খুঁজে দেখে সে যেখানে দিনার রেখে গেছে সেখানেই আছে। কেউ ধরেও দেখেনি। দিনারের থলের উপর মাকড়সা জাল বুনেছে।
# তউস ইবনে কায়সান একবার আতা ইবনু আবি রবা’কে বলেছিলেন, আতা, কখনো তাদের কাছে কিছু চেয়ো না, যারা রাত হলে দরজা লাগিয়ে দেয়, যারা দরজায় পাহারাদার বসায়। তার কাছে চাও যিনি কেয়ামত পর্যন্ত দরজা খোলা রাখেন, তার কাছে কোনো প্রহরীও নেই।
(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৯ম খন্ড, ২৩৫ পৃষ্ঠা- হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির র.। মাকতাবাতুল মাআরিফ, বৈরুত)
২। এক আলেমের সাহসিকতা
বাগদাদ। আব্বাসী খলিফা আবু জাফর মানসুরের (শাসনকাল ৭৫৪-৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ) রাজপ্রাসাদ। খলিফা ডেকে পাঠিয়েছেন বিশিষ্ট আলেম আমর বিন উবাইদকে। আমর পৌছালেন দরবারে। কথাবার্তার পর খলিফা তাকে কিছু উপহার দিলেন। আমর প্রত্যাখ্যান করলেন। আবু জাফর মানসুর বললেন, আল্লাহর কসম আপনাকে এসব গ্রহন করতেই হবে।
আমর বিন উবাইদ বললেন,আল্লাহর কসম , আমি গ্রহন করবো না।
যুবরাজ মাহদি (পরবর্তী খলিফা) বললেন, খলিফা কসম করে ফেলেছেন। আপনি উপহার গ্রহন করুন।
আমর বললেন, খলিফার জন্য কসমের কাফফারা দেয়া সহজ ।
খলিফা বললেন, আপনার কোনো প্রয়োজন থাকলে বলুন’
‘আমার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু বলি, আমি এখানে নিজ থেকে না আসলে আমাকে ডেকে পাঠানোর দরকার নাই’
‘আমি মাহদিকে আমার উত্তরাধিকারী মনোনিত করেছি। আপনি কী বলেন?’
‘আপনার ইন্তেকালের পর আপনি নিজেকে নিয়েই চিন্তিত থাকবেন। কে খলিফা হলো না হলো তা নিয়ে ভাবার সুযোগ পাবেন না’
খলিফা নির্বাক হয়ে সাহসী এই আলেমের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
(তারীখুল খুলাফা, ৪৩২ পৃষ্ঠা– আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতী র.)
৩। কাজী আবু বকর বাকেল্লানীর প্রজ্ঞা
কাজী আবু বকর বাকেল্লানী রহিমাহুল্লাহ। মালেকী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম। আল্লাহ তাকে অসামান্য মেধা দান করেছিলেন। খতীব বাগদাদী লিখেছেন, তিনি প্রতিরাতে বিশ রাকাত নফল নামাজ পড়তেন। তারপর বসে ২৫ পৃষ্ঠা লিখতেন। সকালে লোকজনদের তা পড়াতেন। আবু বকর খাওয়ারেজমী বলেন, বাগদাদের প্রত্যেক লেখকই অন্য লেখকদের গ্রন্থ থেকে সাহায্য নেন। একমাত্র ব্যতিক্রম কাজী আবু বকর বাকেল্লানী। আল্লাহ তার অন্তরকে ইলম দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
রাফেজী, খারেজী, মুতাযিলা ও জাহমিয়াদের বিরুদ্ধে তার কলম ছিল খোলা তরবারীর ন্যায়।
—–
খলীফা ইযদুদদৌলা তাকে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টান সম্রাটের কাছে প্রেরণ করেন। সম্রাট জানতেন একজন মুসলমান হিসেবে কাজী সাহেব কখনোই দরবারের প্রচলিত নিয়ম মেনে সম্রাটকে মাথা নিচু করে সম্মান জানাবেন না। তাই সম্রাট একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি কাজী সাহেবকে এমন একটি দরজা দিয়ে দরবারে ঢুকতে বাধ্য করেন যার উচ্চতা খুবই কম এবং দরজা অতিক্রম করতে হলে অবশ্যই মাথা নিচু করতে হয়। কাজী সাহেব দরজার উচ্চতা দেখে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেন এবং দরবারের দিকে পিঠ দিয়ে উল্টোভাবে হেটে দরবারে প্রবেশ করেন।
দরবারে সম্রাটের সভাসদরা ছাড়াও খ্রিস্টান পাদ্রিরা উপস্থিত ছিলেন। পরিচয়পর্বের সময় কাজী সাহেব এক পাদ্রীকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে?’
পাদ্রী বিব্রত হয়ে চুপ থাকেন।
‘কাজী সাহেব আপনি সম্ভবত জানেন না, আমাদের পাদ্রীরা বিবাহ করেন না। তারা এসকল পার্থিব বিষয় থেকে পবিত্র’ সম্রাট বললেন।
‘বাহ চমৎকার, পাদ্রীরা স্ত্রী, ছেলে সন্তান থেকে পবিত্র। আবার আপনারাই আল্লাহর জন্য সন্তান নির্ধারণ করে দিচ্ছেন’ কাজী সাহেবের উপস্থিত জবাব শুনে সম্রাট হতবাক হয়ে যান।
—
‘আপনাদের নবীর কথা বলুন। তিনি কি জীবদ্দশায় কোনো যুদ্ধ করেছেন?’ সম্রাট বললেন।
‘হা। তিনি অনেক যুদ্ধ করেছেন’ কাজী সাহেব জবাব দিলেন।
‘এসকল যুদ্ধের ফলাফল কী? কে জিতেছে?’
‘কখনো আমাদের নবী জিতেছেন, আর কখনো তার শত্রুরা জিতেছে’
‘এটা কীভাবে সম্ভব যে, আল্লাহর নবীও যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন?’
‘এটাই বা কীভাবে সম্ভব যে, আল্লাহর সন্তানকে (নাউযুবিল্লাহ) শূলিতে চড়ানো হয়েছে?’ কাজী সাহেব হালকা কন্ঠে বললেন।
—
‘আপনাদের সতী নারীর ঘটনা বলুন’ সম্রাট বললেন। মূলত সুক্ষ্মভাবে হজরত আয়েশা (রা) এর প্রতি অপবাদের সেই ঘটনার দিকে ইংগিত করলেন।
‘আমাদের ইতিহাসে দুজন সতী নারীর কথা পাই। দুজনের বিরুদ্ধেই দুর্জনরা অপবাদ দিয়েছে। কোরআন দুজনের পক্ষেই সাক্ষ্য দিয়েছে। তবে তাদের একজন সন্তানসহ (হযরত মরিয়ম আ.) এসেছিলেন, অন্যজন সন্তান ছাড়া। আপনি কোনজনের কথা বলছেন?’
সম্রাট বিব্রত হয়ে চুপ হয়ে যান।
‘এই ব্যক্তি সম্পর্কে আপনাদের অভিমত কী?’ সম্রাট পাদ্রীদের প্রশ্ন করেন।
‘তাকে সসম্মানে বিদায় দিলেই ভালো। নচেত যেকোনো সময় সে আপনার রাজত্বও কেড়ে নিতে পারে’ প্রধান পাদ্রী বললেন।
—
কাজী আবু বকর বাকেল্লানী ৪০৩ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তার জানাযায় প্রচুর লোক সমাগম হয়। শায়খ আবুল ফজল তামিমী তার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এই ব্যক্তি ছিলেন আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী। সারাজীবনে তিনি ৭০ হাজার পৃষ্ঠা লিখেছেন।
(তারীখে বাগদাদ, ৩য় খন্ড, ৩৬৪ পৃষ্ঠা– আবু বকর খতীব বাগদাদী। দারুল গরবিল ইসলামি।
তারিখু কুযাতিল আন্দালুস, ৩৭ পৃষ্ঠা— আবুল হাসান নুবাহি আন্দালুসি। দারুল আফাকিল জাদিদা, বৈরুত।
সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৭শ খন্ড, ১৯০ পৃষ্ঠা– হাফেজ শামসুদ্দীন যাহাবী। মুআসসাতুর রিসালাহ।)
৪। ইমাম আউযায়ীর সাহসিকতা
ইমাম আউযায়ী রহিমাহুল্লাহ। শামের বিখ্যাত আলেম। ১৫৭ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন*। হালকাপাতলা গড়নের এই আলেম ছিলেন তার যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহিমাহুল্লাহ বলতেন, যদি আমাকে বলা হয় এই উম্মাহর জন্য দুজন আলেম বেছে নিতে, তাহলে আমি ইমাম আউযায়ী ও সুফিয়ান সাওরিকে বেছে নিবো।
—
শামে এসেছেন আবদুল্লাহ বিন আলী, আব্বাসী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আব্বাস সাফফাহর ভাই ও খলিফা আবু জাফর মানসুরের চাচা। সময়টা উমাইয়াদের পতনের যুগ। শাসনক্ষমতা হারিয়েছে তারা। খুজে খুজে হত্যা করা হচ্ছে পুরুষদের। যুবরাজ আব্দুর রহমান কোনোমতে ফোরাত নদী পাড়ি দিয়ে কাইরাওয়ানের পথ ধরেছেন। আবদুল্লাহ বিন আলী শামে এসে উমাইয়াদের হত্যা শুরু করেন। জ্বালিয়ে দেয়া হলো তাদের ঘরবাড়ি। আবদুল্লাহ বিন আলীর কানে পৌছেছে ইমাম আউযায়ীর প্রশংসা। ইমাম আউযায়ীকে ডেকে পাঠালেন তিনি। ইমাম আউযায়ী তিনদিন অপেক্ষা করে চতুর্থ দিন রওনা হলেন আবদুল্লাহ বিন আলীর গৃহের দিকে।
আবদুল্লাহ বিন আলীর চেহারা রাগে থমথম করছে। তার পাশে নাংগা তলোয়ার হাতে প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে। ইমাম আউযায়ী সালাম দিলেন। আবদুল্লাহ বিন আলী কোনো জবাব না দিয়ে তার হাতে ধরে রাখা ছড়ি মাটিতে ঠোকরাতে থাকেন।
‘আপনি আউযায়ী?’ আবদুল্লাহ বিন আলী কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন।
‘হ্যা’
‘আউযায়ী, আমি বনু উমাইয়ার সাথে যা করছি এ সম্পর্কে আপনার মত কী? এটা কি জুলুম হচ্ছে ? নাকি জিহাদ ?’
‘আমাকে ইয়াহইয়া বিন সাইদ আল আনসারি একটি হাদিস বর্ননা করেছেন। তিনি শুনেছেন, মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম আত তাইমির কাছ থেকে, তিনি আলকামা বিন ওয়াক্কাস থেকে, তিনি উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক মানুষ যা নিয়ত করবে তাই পাবে।’ (বুখারী, মুসলিম) ইমাম আউযায়ী শান্তকন্ঠে বললেন। আবদুল্লাহ বিন আলীর চেহারা রাগে লাল হয়ে গেল। সে আগের চাইতে দ্রুতগতিতে ছড়ি দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে লাগলো।
‘আমি বনু উমাইয়াকে হত্যা করছি এ সম্পর্কে আপনার মত কী?’ আবদুল্লাহ বিন আলীর দ্বিতীয় প্রশ্ন।
‘আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ননা করেছেন, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিন কারন ব্যতিত কোন মুসলমানের রক্তপাত ঘটানো বৈধ নয়, ১.বিবাহিতব্যক্তি যদি যেনা করে ২.কাউকে বিনা কারনে হত্যা করে, ৩.স্বীয় দ্বীন ত্যাগ করে , মুসলিম জামাতে ফাটল সৃষ্টি করে। (বুখারী, মুসলিম)’
‘বনু উমাইয়ার সম্পদের ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?’
‘তারা যদি এই সম্পদ বৈধভাবে অর্জন করে তাহলে আপনার জন্য তা হারাম। আর যদি তারা অবৈধ পন্থায় অর্জন করে তবুও শরয়ী কোনো কারণ ছাড়া আপনার জন্য তা হালাল হবে না’ ইমাম আউযায়ীর জবাব শুনে আবদুল্লাহ বিন আলীর চেহারা রাগে লাল হয়ে যায়।
কিছুক্ষন পর সে বলে, ‘আমরা কি আপনাকে কাজী নিয়োগ করবো?’
‘আপনার পূর্ববর্তীরা আমার কাধে এই দায়িত্ব চাপাননি। তারা আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন। আমি চাই আপনার সময়েও এই অনুগ্রহ বলবত থাকুক’
‘এই তিনদিন কেনো আসেননি’
‘আমি রোজা রেখেছিলাম’
আবদুল্লাহ বিন আলী, ইমাম আউযায়ীর ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হন। ইমাম সাহেবকে ইফতারীর আমন্ত্রন জানান। ইমাম আউযায়ী এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসেন। ফটকের কাছে পৌঁছলে এক চাকর দৌড়ে আসে।
‘আমীর আপনাকে এই দুইশো দিনার হাদিয়া করেছেন’ বলে সে।
ইমাম আউযায়ী হাদিয়া গ্রহন করেন এবং সেখানেই তা সদকা করে দেন। ———————
*আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ ১৫৭ হিজরী লিখেছেন। তবে সিয়ারু আলামিন নুবালাতে ইমাম যাহাবী লিখেছেন, আলি ইবনুল মাদিনীর মতে তার ইন্তেকাল ১৫১ হিজরীতে।
(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৩শ খন্ড, ৪৪৯-৪৫১ পৃষ্ঠা,– হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসীর। মারকাযুল বুহুস ওয়াদ দিরাসাতিল আরাবিয়্যা।
সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৭ম খন্ড, ১০৭-১১০ পৃষ্ঠা। -হাফেজ শামসুদ্দীন যাহাবী। মুআসসাতুর রিসালাহ)
৫। আকবরের সামনে নির্ভীক আলেম
খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর ভারতবর্ষ।
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকাল। আকবর ছিলেন নিরক্ষর। তবে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জনে তার ছিল সীমাহীন তৃষ্ণা। ঐতিহাসিক আব্দুল কাদের বাদায়ুনির বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রথম জীবনে আকবর বেশ ধার্মিক ছিলেন। পীর বুজুর্গদের অত্যন্ত সম্মান করতেন। প্রতি জুমার রাতে আলেমদের মজলিস বসাতেন। কাজি জালাল ও অন্যান্য আলেমদের তিনি তাফসির করার আদেশ দেন। একবার আজমির যাওয়ার পথে সেকালের বিখ্যাত বুজুর্গ শায়খ নিজাম নারনুলির সাথেও দেখা করেন। দোয়া নেন। শায়খ মোহাম্মদ গাউস গোয়ালিয়ারিকে তিনি এক কোটি মুদ্রা মূল্যের জায়গীর উপহার দেন।
তবে শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী লিখেছেন, আকবরের এই ধর্মবোধ ছিল ভাসাভাসা আবেগের উপর, যার কোনো মজবুত ভিত্তি ছিল না। কোরআন সুন্নাহ ও ইসলামের সঠিক শিক্ষা সম্পর্কেও তার কোনো অধ্যয়ন ছিল না। তার এই ধর্মবোধের প্রধান অনুষঙ্গ ছিল মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে মাজারে হাজিরা দেয়া, সেখানকার মূর্খ খাদেমদের শ্রদ্ধা ভক্তি করা ও খানকাহ ঝাড়ু দেয়া।
আকবরের দূর্ভাগ্য তার পাশে এমনকিছু আলেম জড়ো হয়েছিলেন যারা ছিলেন প্রচন্ড দুনিয়ালোভী। উদাহরণস্বরূপ মোল্লা আবদুল্লাহ সুলতানপুরীর কথা বলা যায়। এই আলেম যাকাত দেয়া থেকে বাচার জন্য নানা ছলচাতুরী করতেন। এমনকি তিনি ফতোয়া দেন হজ্বের ফরজিয়ত আর অবশিষ্ট নেই। আকবরের জুমা রাতের মজলিসে অনেক মাসালা নিয়ে আলোচনা হতো। এই মজলিসগুলোতে আলেমরা প্রায়ই পারস্পরিক বাকবিতণ্ডাতে লিপ্ত হতো এমনকি একে অপরকে কাফের ফতুয়াও দিতেন। একই সময়ে আকবর ধর্মীয় সভা আহবান করেন এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার মজলিস বসান। আলেমরা এসব মজলিসে বসতেন কিন্তু তারা থাকতেন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। তারা কোনো জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে পারতেন না, এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যার সমাধান দিতেও তারা ছিলেন অক্ষম। ফলে আকবরের মনে এক ধরনের বিরাগ জন্ম নেয়। তিনি সকল ধর্মের মিশেলে একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তনের কথা ভাবেন। এই চিন্তায় সহযোগী হিসেবে পেয়ে যান ভারতবর্ষের বিস্ময়কর তিন প্রতিভা মোল্লা মোবারক নাগোরী, ফইজি ও আবুল ফজলকে। তারা ব্যক্তিস্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থে সম্রাটকে নতুন ধর্ম প্রবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে। আকবর দ্বীনে এলাহী নামে নতুন একটি ধর্মমত প্রবর্তন করেন। আকবর অগ্নিপূজা ও সূর্য পূজা শুরু করেন। যাকাত নিষিদ্ধ করা হয়, মদ পানে উদ্বুদ্ধ করা হয় এমনকি মুফতি মীর আদলও মদপান করেন। ধর্মীয় রোকনগুলোকে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করা হয়। নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়। আকবরের এই ধর্ম মতে কয়েকটি ধর্মের অনুসারীরা যোগ দেন এবং ভারতবর্ষে মুসলমানদের ইতিহাস একটি বিপদজনক বাঁকে এসে পৌছায়। সাইয়েদ সোলাইমান নদভীর ভাষায়, এ ছিল পৈতাধারীর হাতে তাসবিহ ও তাসবিহধারীর গলায় পৈতা লটকে দেয়া।
দরবারী আলেমরা আকবরের সাথে একাত্মতা পোষণ করেন। যেসকল আলেমরা আকবরের আনুগত্য প্রকাশে অস্বীকৃতি জানান, তাদেরকে হয় নির্বাসনে পাঠানো হয় কিংবা হত্যা করা হয়।
সেই ক্রান্তিলগ্নেও অনেক আলেম সত্য প্রকাশের দু:সাহস বুকে লালন করতেন।
—
শাহবায খান কাম্বুহ এমনই একজন আলেম। তিনি ছিলেন আকবরের সভাসদ। আকবর তাকে মীর বখশ উপাধী দেন। শাহবায খান কখনো মদ পান করেননি, দাড়িও মুন্ডন করেননি। আকবরের প্রচলিত ধর্মমতের তিনি ছিলেন প্রকাশ্য বিরোধী।
একদিন বিকেলের ঘটনা। সম্রাট আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে একটি পুকুরের পাড়ে পায়চারি করছিলেন। শাহবায খান সেখানে উপস্থিত হলে সম্রাট তার হাত ধরে হাটতে থাকেন। নানা বিষয়ে আলোচনা চলতে থাকে। ইতিমধ্যে মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে যায়। উপস্থিতরা ভাবতে থাকে শাহবায খান আজ কোনোভাবেই সম্রাটের হাত থেকে ছাড়া পাবে না। তার মাগরিবের নামাজ কাযা হবেই। শাহবায খান সম্রাটকে বলেন, আমি নামাজ পড়বো।
‘আমাকে একা রেখে যেও না। পরে কাজা করে নিও’ সম্রাট বলেন।
শাহবায খান জোর করে সম্রাটের হাত থেকে হাত সরিয়ে নেন। চাদর বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যান। নামাজ শেষে নিয়মিত আমল অজিফা শুরু করেন। সম্রাটের প্রতি তার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সম্রাট প্রচন্ড রাগে কাঁপছিলেন। উপস্থিত দুই আমির আবুল ফাতাহ ও হাকিম আলি গিলানী অনেক কষ্টে সম্রাটকে ঠান্ডা করেন।
—
শায়খ আব্দুল কাদের উচাঈ সে যুগের আরেকজন সাহসী আলেম। একবার সম্রাট তাকে আফিম সাধেন। আব্দুল কাদের অস্বীকৃতি জানালে সম্রাট রেগে যান।
একবার তিনি ইবাদতখানায় নফল পড়ছিলেন। আকবর বললেন, আপনার উচিত ঘরে গিয়ে নামাজ পড়া।
‘এই এবাদতখানা আপনার রাজত্ব নয়’ শান্তকন্ঠে বললেন আব্দুল কাদের উচাঈ।
‘আমার রাজত্ব পছন্দ না হলে এখান থেকে চলে যান’ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন আকবর।
এই ঘটনার পর আব্দুল কাদের উচাঈকে নির্বাসিত করা হয়।
(আকবরের জীবনের প্রথমদিকের ঘটনাবলী জানতে দেখুন, মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ– মোল্লা আব্দুল কাদির বাদায়ুনি।
তারীখে দাওয়াত ও আযিমত, ৪র্থ খন্ড, ৮০ পৃষ্ঠা– সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভী।
নুযহাতুল খাওয়াতির, ৫৩৯ ও ৫৬৮ পৃষ্ঠা- শায়খ আব্দুল হাই হাসানি নদভী। দার ইবনে হাযম বৈরুত)
৬। বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তি
তুঘলক বংশের পতনের পর ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন সালতানাত গড়ে উঠে। এ সময় জৌনপুরের শাসনকর্তা খাজা জাহান ‘মালিকুশ শরক’ উপাধি ধারন করে শর্কি বংশের ভিত্তি স্থাপন করেন। এই বংশ প্রায় ৮০ বছর কনৌজ থেকে বাংলার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃর্ন অঞ্চল শাসন করে। শর্কি বংশের শাসনকালে জৌনপুরের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অন্যান্য বিষয়ে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় বড় বড় মাদরাসা, খানকাহ ও আলীশান অট্টালিকা। শর্কি সুলতানদের প্রভাব বুঝা যায় বাংলার বিখ্যাত বুজুর্গ নুর কুতবুল আলমের ঘটনা থেকে। সেকালে রাজশাহী জেলার ভাতুরিয়ার জায়গিরদার রাজা গনেশের অত্যাচারে জনগন ছিল অতিষ্ঠ। নুর কুতবে আলম তখন জৌনপুরের সুলতান ইবরাহীম শর্কির কাছে পত্র লিখে এ ব্যাপারে তার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। (১)
শর্কি সালতানাতের পতনের পরেও জৌনপুর তার ঐতিহ্য হারায়নি। মুঘল আমলেও এখানকার মাদরাসাগুলোর পড়ালেখার মান ছিল খুব উন্নত। শায়খ আব্দুল হাই হাসানি নদভী এমন অন্তত ১৪ টি মাদ্রাসার কথা উল্লেখ করেছেন। (২)
জৌনপুরে বড় বড় আলেম জন্মগ্রহন করেছেন। শাসকবর্গ সবসময়ই এসব আলেমদের সম্মানের চোখে দেখতেন। প্রতিটি মাদরাসা ও খানকাহর জন্য প্রচুর জমি ওয়াকফ ছিল। স্বয়ং শর্কি সুলতানরা আলেমদের দরসে বসতেন। (৩)
মুঘল আমলেও এখানে বড় বড় আলেম জন্মেছেন। এমনই এক আলেমের নাম মুফতি সাইয়েদ আবুল বাকা। তিনি ১০৪০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে তিনি জৌনপুরের প্রধান মুফতি ছিলেন। একবার সম্রাট তার কাছে একটি বই পাঠিয়ে এর ভুলগুলো সংশোধন করে দিতে বলেন। মুফতি সাহেব বইটি একবার পড়ে কুতুবখানায় রেখে দেন। অন্যান্য ব্যস্ততায় এই বইয়ের কথা ভুলে যান। প্রায় ৬ মাস পর সম্রাট আবার তাগাদা দেন। মুফতি সাহেব কুতুবখানায় বইটি খুজেন, কিন্তু বইটি হারিয়ে গেছে। অনেক খুজেও বইটি না পেয়ে তিনি নিজের স্মৃতি থেকে পুরো বইটি লিখে ফেলেন। সম্রাট বইটি পেয়ে খুব খুশি হন এবং মুফতি সাহেবকে জায়গীর প্রদান করেন। (৪)
১। রিয়াজুস সালাতিন- গোলাম হুসেন সলিম ২। আল হিন্দ ফি আহদিল ইসলামি- আব্দুল হাই হাসানি নদভী ৩। হিন্দুস্তান কে মুসলমান হুকুমরানো কে আহদ কে তামাদ্দুনি কারনামে- দারুল মুসান্নেফিন, আযমগড়। ৪। হিন্দুস্তান কে মুসলমান হুকুমরানো কে আহদ কে তামাদ্দুনি কারনামে- দারুল মুসান্নেফিন, আযমগড়।
৭। ইবরাহিম তাইমির আত্মত্যাগ
ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাকাফি পেরেশান। ইবরাহিম বিন ইয়াযিদ নাখয়িকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ ও গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুজছে তাকে, কিন্তু এখনো তার সন্ধান মেলেনি। ইবরা
হিম বিন ইয়াজিদ নাখয়ি একজন তাবেয়ী। যুগের শ্রেষ্ঠ ফকিহদের একজন। তার
অপরাধ, তিনি হাজ্জাজের ঘোর বিরোধী। একবার তার দরসে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেউ যদি হাজ্জাজকে লানত দেয় তাকে আপনি কী বলবেন? তিনি জবাবে আয়াত তেলাওয়াত করেছিলেন,
أَلَا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ শুনে রাখ, যালেমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত রয়েছে। [ সুরা হুদ ১১:১৮ ]
মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান বিন আশআস যখন হাজ্জাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তখন ইবরাহীম নাখয়ি তাকে সমর্থন দেন। হাজ্জাজ প্রচন্ড ক্রোধান্বিত হয়। পুলিশকে নির্দেশ দেয়, ইবরাহিম নাখয়িকে গ্রেফতার করতে। ইবরাহিম গা ঢাকা দেন। #
মধ্যরাত। কুফার বাসিন্দারা ঘুমে বিভোর। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। কুফার বিখ্যাত আবেদ ইবরাহিম বিন ইয়াজিদ তাইমি ঘর থেকে বের হলেন। সরু গলি ধরে হাটছেন। হালকা চাদের আলো। পথ দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। জামে মসজিদে পৌছে অযু করলেন। নামাজে দাড়ালেন। মৃদু কন্ঠে তেলাওয়াত শুরু করলেন। প্রতিরাতের মতো হাজ্জাজের পুলিশ বাহিনী ঘুরছে কুফার অলিগলিতে। জামে মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেল ভেতরে কেউ একজন নামাজ পড়ছে। পুলিশ বাহিনীর লোকেরা মসজিদে প্রবেশ করলো। ইবরাহিম তাইমির নামাজ শেষ হলে তাকে প্রশ্ন করা হলো, ‘আপনার নাম কী?’ ‘ইবরাহীম’ ‘আপনিই কি ইবরাহীম বিন ইয়াযিদ?’
‘জি। আমিই’ শান্তকন্ঠে বললেন ইবরাহিম তাইমি। ‘আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। কী ভেবেছিলেন? আমার হাত ফাকি দিয়ে পালাবেন? আমরা তো পাতাল থেকেও অপরাধীকে ধরে নিয়ে আসি’ পুলিশ অফিসার উল্লসিত কন্ঠে বললো। ইবরাহিম তাইমি বুঝতে পারলেন পুলিশ এসেছে ইবরাহিম নাখয়িকে গ্রেফতার করতে। তবু তিনি নিজের আসল পরিচয় দিলেন না। চুপ থাকলেন। ইবরাহিম তাইমিকে হাজ্জাজের সামনে উপস্থিত করা হলো। হাজ্জাজ কোনো প্রশ্ন না করে আদেশ দিলো ইবরাহিম তাইমিকে দিমাসের কারাগারে বন্দী করতে। #
সেকালে দিমাসের কারাগার ছিল ভয়ংকর কারাগার। শুধুমাত্র ভয়ংকর অপরাধীদেরকেই এখানে বন্দী করা হতো। এক প্রশস্ত ময়দানের চারপাশে প্রাচীর তুলে দেয়া, এর ভেতরে বন্দীরা থাকতো। ভেতরে কোনো ঘর নেই। খোলা মাঠেই থাকতে হতো। রোদ বৃষ্টি ঝড় থেকে বাচার উপায় নেই। কিছুদিন পর ইবরাহিম তাইমির আম্মা এলেন ছেলেকে দেখতে। ছেলেকে দেখে তিনি নিজেই চিনতে পারলেন না। ইবরাহিম তাইমির শরিরে শুধু হাড়টুকু অবশিষ্ট আছে। মা প্রশ্ন করলেন বেটা তুমি তো জানতে পুলিশ তোমাকে খুজছে না। তারা খুজছে ইবরাহিম নাখয়িকে। তবু কেন তুমি তাদেরকে নিজের আসল পরিচয় জানালে না? ইবরাহিম তাইমি জবাব দিলেন, মা, ইবরাহিম নাখয়ি অনেক বড় আলেম। এই উম্মাহর জন্য তিনি রহমতস্বরুপ। আমি চেয়েছি তিনি নিরাপদ থাকুন। তাই আমি নিজেকে ধরিয়ে দিয়েছি। #
ইবরাহিম তাইমি কারাগারেই ইন্তেকাল করলেন। তার ইন্তেকালের রাতে হাজ্জাজ স্বপ্নে দেখলো কেউ একজন বলছে, আজ একজন জান্নাতি মানুষ মারা গেলো। সকালে হাজ্জাজ খবর নিয়ে ইবরাহিম তাইমির মৃত্যুসংবাদ শুনলো। হাজ্জাজ আদেশ দিলো তার লাশের উপর ঘোড়া চালিয়ে দাও। ‘রাতের স্বপ্নটা ওয়াসওয়াসা ছিল’ এই ভেবে হাজ্জাজ নিজেকে সান্ত্বনা দিল। ইবরাহিমের লাশের সাথে বেয়াদবি করা হলো। ইবরাহিমের রুহ হয়তো তখন মুচকি হাসছিল। অপেক্ষায় ছিল রবের পক্ষ থেকে বিশেষ অভ্যর্থনার,
يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةَ * ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً
হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি ফিরে এসো তোমার রবের প্রতি সন্তুষ্টচিত্তে, সন্তোষভাজন হয়ে। (ফাজর ২৭-২8)
(সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৫ম খন্ড, ৬০-৬২ পৃষ্ঠা। –হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাবী। মুআসসাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত)
৮। সাইদ ইবনুল মুসাইয়াবের কন্যা
মদীনা। সাইদ ইবনুল মুসাইয়াবের দরসগাহ। সাইদ ইবনুল মুসাইয়াব, আলি ইবনুল মাদিনী যার সম্পর্কে বলেছেন, তাবেয়ীদের মধ্যে এত প্রশস্ত ইলমের অধিকারী আর কাউকে চিনি না। কাতাদাহ বলেছেন, আমি তার চেয়ে বড় কোনো আলেম দেখিনি। সাইদ ইবনুল মুসাইয়াব, অসামান্য সাহসিকতার অধিকারী এই তাবেয়ী কখনো অন্যায়ের সামনে মাথা নত করেননি। জাবির বিন আসওয়াদ যখন আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের পক্ষে বাধ্যতামূলক বায়াত নেয়া শুরু করেন, তখন সাইদ কঠোরতার নিন্দা জানান। পরিনামে জাবির তাকে বেত্রাঘাত করেন। তখনো তিনি হকের পক্ষে অনড় ছিলেন। জাবিরের ছিল চার স্ত্রী, পরে এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ইদ্দত চলাকালীন পঞ্চম স্ত্রী গ্রহণ করেন, যা ছিল স্পষ্ট হারাম। সাইদ নির্যাতিত অবস্থাতেও এই অনাচারের প্রতিবাদ করেন।
এই সাইদ ইবনুল মুসাইয়াবের ঘটনা শুনিয়েছেন তার ছাত্র আবু ওয়াদাআ। তার মুখেই শোনা যাক :
আমি সাইদ ইবনুল মুসাইয়াবের দরসে বসতাম। একবার আমি কদিন অনুপস্থিত থাকি। পরে উপস্থিত হলে সাইদ প্রশ্ন করেন
‘এ কদিন কোথায় ছিলে?’ ‘আমার স্ত্রী মারা গেছে। কাফন দাফনে ব্যস্ত ছিলাম’ জবাব দিলাম। ‘আমাকে জানাতে। জানাযায় উপস্থিত হতাম’
একটু পর তিনি আবার প্রশ্ন করেন
‘এখন বিয়ে করবে ?’ ‘কে আমাকে মেয়ে দিবে? আমার কাছে তো মোহরের সামর্থ্য নেই’ ‘কত আছে?’ ‘দুই বা তিন দেরহাম”
সাইদ বললেন, ‘আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাই’ এরপর সে মজলিসেই তিনি তার মেয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দেন। আমি আনন্দিত মনে ঘরে ফিরে আসি।
আমি ছিলাম রোজাদার। ইফতারির সময় দরজায় করাঘাত হলো।
‘কে?’ জানতে চাইলাম। ‘সাইদ’ জবাব এল।
ভাবতে লাগলাম কে হতে পারে। সাইদ ইবনুল মুসাইয়াব বাদে আর সবার কথা মাথায় এলো। সাইদ ইবনুল মুসাইয়াব আসবেন না এটা নিশ্চিত, কারন গত ৪০ বছর ধরে তিনি ঘর থেকে মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও যান না। দরজা খুলি। দেখি সামনে সাইদ ইবনুল মুসাইয়াব দাঁড়িয়ে আছেন।
‘আপনি কষ্ট করে এলেন? আমাকে ডেকে পাঠালেই তো হতো’ বিস্ময় সামলে বললাম। ‘না, আমারই আসতে হতো। তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করেছো। আজ রাতে তুমি একা থাকবে, ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে নি। তোমার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি’ এই বলে সাইদ সরে দাড়ালেন। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার স্ত্রী। সাইদ তার মেয়েকে হাত ধরে আমার ঘরের ভেতর নিয়ে এলেন। তারপর তিনি বিদায় নিলেন।
এই হলো আমার বিয়ের ঘটনা।
আমার সৌভাগ্য আমি এমন স্ত্রী পেয়েছি যিনি হাফেজা এবং হাদীস শাস্ত্রেও পারদর্শী। সৌন্দর্যেও অতুলনীয়া। আলহামদুলিল্লাহ।
(সাইদ ইবনুল মুসাইয়াবের এই কন্যার গুনে মুগ্ধ হয়ে মুসলিম বিশ্বের খলিফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান (রাজত্বকাল ৬৮৫–৭০৫) তার ছেলে যুবরাজ ওয়ালিদের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সাইদ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন)
(সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৪র্থ খন্ড,– হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাবী। মুআসসাসাতুর রিসালাহ)
৯। বাঘের সামনেও নির্ভয় ছিলেন যে আলেম
শাইখুল ইসলাম আবুল হাসান বুনান বিন মুহাম্মদ বিন হামদান বিন সাইদ। বিখ্যাত মুহাদ্দিস। জন্মেছেন ইরাকের ওয়াসিত শহরে। পরে মিসরে চলে আসেন, এখানেই বসবাস করেন। ৩১৬ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। যাহাবী তার সম্পর্কে বলেছেন, তিনি শারিরিকভাবে ছিলেন সুঠামদেহী, শাসকদের কাছ থেকে কিছুই গ্রহন করতেন না। জনসাধারণের মাঝে তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব ছিল।
একবার মিসরের শাসক আহমাদ ইবনে তুলুনের সাথে তার দেখা হয়। তিনি আহমাদ ইবনে তুলুনকে কিছু নসিহত করেন। আহমদ ইবনে তুলুন ক্ষিপ্ত হয়ে আদেশ দেন, তাকে বাঘের খাচায় ছেড়ে দাও। আবুল হাসান বুনানকে বাঘের খাচায় রাখা হয়। বাঘ এগিয়ে এসে তাকে একবার শুকে দেখে। তারপর এক কোনে চলে যায়। শান্ত হয়ে বসে আবুল হাসান বুনানকে দেখতে থাকে।
বাধ্য হয়ে আবুল হাসান বুনানকে খাচা থেকে বের করা হয়।
‘যখন বাঘ আপনার কাছে এলো আপনার অনুভূতি কী ছিল?’ জিজ্ঞেস করলো কেউ একজন।
‘আমি তখন ফিকহের কিতাবে পড়া বাঘের উচ্ছিষ্টের মাসআলা নিয়ে ভাবছিলাম’ শান্ত স্বরে জবাব দিলেন তিনি।
এরপর কাজি উবাইদুল্লাহ তাকে সাতটি বেত্রাঘাত করে। বেত্রাঘাত শেষে আবুল হাসান বুনান বলেন, প্রতি আঘাতের জন্য এক বছর।
উপস্থিত জনতা এই কথার অর্থ বুঝতে পারেনি। বুঝেছে কিছুদিন পর।
যখন আহমাদ ইবনে তুলুন কাজি উবাইদুল্লাহকে সাত বছরের জন্য কারাগারে প্রেরণ করেছিল।
(সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৪শ খন্ড, ৪৮৮ পৃষ্ঠা– হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাবী। মুআসসাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত)
১০। আল আযমাতু লিল্লাহ
আজই প্রথম দিল্লী এলাম। আগে কয়েকবার আসতে চেয়েছি। বাবা অনুমতি দেন নি। তার একটাই কথা,
‘আমরা ফকীর মানুষ। দিল্লীতে আমাদের কী কাজ?’
একথার কোনো জবাব দিতে পারি নি। দিল্লীও আসা হয় নি। অবশেষে আজ দিল্লী এলাম পিতার হাত ধরে। এসেছি বাধ্য হয়ে। আমার বাবা, কুতুবুদ্দিন মুনাওয়ারকে ডেকে পাঠিয়েছেন সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক।
মুহাম্মদ বিন তুঘলক। অদ্ভুত মেধা আর বেপরোয়া মনোভাবের এক শাসক, মন চাইলেই যিনি রাজধানী সরিয়ে নেন দিল্লী থেকে দেবগিরি, তিনি আমার পিতাকে ডেকেছেন।
কদিন আগের কথা। সুলতান গেছেন রাজধানীর বাইরে । তার সাথে দেখা করতে এসেছে সবাই। স্থানীয় ওলামারাও বাদ পড়েন নি। বাদ পড়েছেন আমার পিতা।
‘রাজা বাদশাহদের কাছে ফকিরদের কী প্রয়োজন ?’ এ কথা বলে নিজের খানকাতেই রইলেন তিনি।
তার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করলেন মুহাম্মদ বিন তুঘলক। রাজধানীতে পৌছেই তলব করলেন বাবাকে। বাবা আসার সময় আমাকেও নিয়ে এলেন।
প্রাসাদের মূল ফটকে পৌছে থমকে গেলাম। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীরা। ভয় করছে আমার।দরবারকক্ষে প্রবেশ করলাম। ওই তো, বসে আছেন সুলতান। তার চেহারায় প্রতিভার আভা। পাশে বসে আছে সেনাপতিরা। কোমরে ঝুলছে খঞ্জর। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তরবারি হাতে খোজাপ্রহরী।বাবার হাত জোরে চেপে ধরলাম। আমার ভয় লাগছে। শরীর কাঁপছে। জানি না সুলতান আমার বাবাকে কী শাস্তি দেন। পিতা টের পেলেন, আমি ভয় পাচ্ছি। আমার কাধে হাত রাখলেন তিনি। শান্তকন্ঠে মৃদুস্বরে বললেন,
‘আল আযমাতু লিল্লাহ’
শুধু এটুকুই। পিতার এ উচ্চারণ শোনার সাথে সাথে আমার ভিতরে কী এক অলৌকিক পরিবর্তন এলো নিজেও জানি না। একটু আগের ভয় ও শংকা এক নিমিষে কোথায় উড়ে গেলো! একটু আগে যাদেরকে দেখে ভয় পাচ্ছিলাম এখন তাদেরকে ভেড়া আর বকরী মনে হচ্ছে।
(সূত্র: আল মুসলিমুনা ফিল হিন্দ — সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী র.)
১১। ৮০ বছর বয়সী ছাত্র
ওয়াসিত। কুফা এবং বসরার মাঝামাঝি একটি শহর। এখানে থাকেন আলী ইবনুল বাকিল্লানি। নিয়মিত দরস দেন ‘কেরাতে আশারা’।আজ তার দরসে নতুন দুজন ছাত্র এসেছে। একজন মধ্যবয়সী। নাম ইউসুফ। অন্যজন তার পিতা। অশীতিপর বৃদ্ধ। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। বৃদ্ধ মনোযোগী হয়ে বসেছেন। প্রয়োজনীয় কথাগুলো স্মরণ রাখার চেষ্টা করছেন। এই বৃদ্ধের নাম জামাল উদ্দিন আবুল ফারাজ। মুসলিম বিশ্বে যিনি পরিচিত ইমাম ইবনুল জাওযি নামে। হাফেজ যাহাবি যাকে বলেছেন ইলমের ইমাম। যার হাতে লিখিত কিতাবের সংখ্যা গণনাও আজ কষ্টসাধ্য।
এই অসাধারণ মানুষটি, আশি বছর বয়সে বসেছেন তার ছাত্র সমতুল্য একজনের দরসে।
‘…… সালাফদের ইলম অর্জনের ঘটনাবলি থেকে এটাই বোঝা যায়, তারা নিজেদের মান-মর্যাদার চাইতে ইলমকে বেশি মূল্য দিতেন। নিজেরা বড় শায়খ হয়েও ছাত্রের মজলিসে পূর্ণ আদবের সাথে বসতেন…..’ লিখেছেন শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ র.
(তথ্যসূত্র : আল উলামাউল উযযাব — শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ র.)
১২। হাত লম্বা করলেন না
দামেস্ক ।
মসজিদে দরস দিচ্ছেন শায়খ সাঈদ আল হালাবি। কিবলার দিকে পিঠ দিয়ে এবং মসজিদের দরজার দিকে মুখ করে বসেছেন। ওযরবশত পা ছড়িয়ে রেখেছেন।
শহরের গভর্নর বদমেজাজি ইবরাহীম পাশা। কোথাও যাওয়ার পথে ভাবলো, মসজিদে যাই। শায়খের সাথে দেখা করি।
রক্ষীদল নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলো ইবরাহীম পাশা।
শায়খ সাইদ তাকে দেখেও দেখলেন না। তার পা একটুও সরলো না। দরসও বন্ধ হলো না। হতভম্ব ইবরাহীম পাশা দাঁড়িয়ে রইলো শায়খের পায়ের সামনে।
ছাত্ররা আতংকিত। এই বুঝি বদমেজাজি গভর্নর আদেশ দিবে শায়খকে গ্রেফতার করতে। এই বুঝি পেটোয়া বাহিনী হামলে পড়বে শায়খের উপর।
কিছুই হলো না। গভর্নর নীরবে ফিরে গেলো। প্রাসাদে ফিরে খাদেমের হাতে আশরাফী ভর্তি থলে দিয়ে বললো, এটা শায়খকে দিয়ে আসো। বলো আমার এ ক্ষুদ্র উপহার গ্রহণ করতে।
খাদেম এলো মসজিদে। শায়খের সামনে রাখলো আশরাফী ভর্তি থলে।
শায়খ ধীর কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বললেন, যে পা লম্বা করে, সে হাত লম্বা করে না।
(আমি বলবো না, আপনাকে পা লম্বা করতেই হবে। প্রয়োজন ছাড়া এমন করার শিক্ষাও ইসলাম দেয় না। তবে এটা অবশ্যই বলবো, কারো সামনে হাত লম্বা করার দীনতা যেন আমাদের স্পর্শ না করে—- সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী র.)
[সূত্র: পা-জা সুরা-গে জিন্দেগী– সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী ]