ফকির মির্জা আলি খান

মে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ।

চল্লিশ হাজার ব্রিটিশ সেনা ছাউনি ফেললো ওয়াজিরিস্তানের গির‍য়াওম এলাকায়। শাম নালার পাশে খোলা ময়দানে অবস্থান নিল ব্রিটিশ সেনারা। সাধারণত, ওয়াজিরিস্তানে বর্ষা শুরু হয় জুলাইয়ের শেষ কিংবা আগস্টের শুরুতে। আবহওয়া নিয়ে তাই ব্রিটিশ সেনারা নিশ্চিন্ত ছিল।
নদীর ভাটিতে অবস্থান করছিলেন ব্রিটিশদের শত্রু একজন উপজাতী নেতা। তার সাথে সেনাসংখ্যা ছিল চারশোরও কম। জনপ্রতি একটি রাইফেলের বেশি কোনো অস্ত্র ছিল না। এপাশে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত চল্লিশ হাজার ব্রিটিশ সেনা।

ব্রিটিশ কমান্ডার প্রতিনিধি পাঠালেন উপজাতি নেতার কাছে। ‘এখনোও সুযোগ আছে আত্মসমর্পন করো। নইলে তোমার পাহাড়ি গুহা ও ক্যাম্প ধবংস করে দেয়া হবে’।

চল্লিশ বছর বয়সী উপজাতী নেতা এই বার্তা পেয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বললেন, আমাদের সাহায্যকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা। যতক্ষণ বেচে আছি আমি মোকাবিলা করবো’।


যেকোনো বিবেচনায় এটি ছিল একটি হাস্যকর ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। একদিকে চারশোরও কম উপজাতী আর অন্যদিকে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত চল্লিশ হাজার ব্রিটিশ সেনা। এ লড়াই তো শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। ব্রিটিশ বাহিনীর প্রতিনিধি বোঝানোর চেষ্টা করলেন উপজাতী নেতাকে। কিন্তু উপজাতী নেতা তার কথাতেই অনড় রইলেন।


এই উপজাতী নেতার নাম ফকির মির্জা আলি খান। ফকির ইপি নামে যিনি বিখ্যাত। ওয়াজিরিস্তানের টোচি উপত্যকায় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম। বাল্যকাল থেকেই নিতান্ত সাদাসিধে , অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। বানুর একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত তাকে প্রকাশ্য কোনো কর্মকান্ডে আসতে দেখা যায়নি। এসময় তিনি নীরব জীবনযাপন করছিলেন।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে রামকোড়ি নামে এক হিন্দু যুবতী ইসলাম গ্রহন করে। তার নাম রাখা হয় ইসলাম বিবি। সাইয়েদ আমির নুর আলি নামে এক মুসলমানের সাথে তার বিয়ে হয়। মেয়ের পরিবার আদালতে মামলা করে। তাদের দাবী ছিল মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। এখন তাদের হাতে তুলে দেয়া হোক। পশতুনদের কথা ছিল, প্রকাশ্য মজলিসে মেয়েকেই জিজ্ঞাসা করা হোক তাকে কেউ জোর করেছে কিনা।

ব্রিটিশরা পশতুনদের কথায় কান দেয়ার প্রয়োজন দেখেনি। মেয়েকে তুলে আনা হয়। সাইয়েদ আমির আলীকে পাঠানো হয় কারাগারে।
পুরো ওয়াজিরিস্তানে জ্বলে উঠে ক্রোধের আগুন। এবার সামনে আসেন ফকির মির্জা আলি খান।তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা করেন। তার পাশে খুব অল্প মানুষই পেয়েছিলেন, কিন্তু এদের নিয়েই তিনি ইংরেজদের উপর গেরিলা হামলা চালাতে থাকেন। একের পর এক হামলায় ইংরেজরা হয়ে উঠে বিপর্যস্ত। ফকির মির্জা আলিকে দমন করার জন্যই ইংরেজরা মে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করে। (১)


ব্রিটিশ বাহিনীর প্রতিনিধি ক্যাম্পে ফিরে এলো। জানালো ফকির ইপি বলেছেন লড়াই চালিয়ে যাবেন। উপস্থিত সেনা অফিসাররা এই কথা শুনে অট্টহাসি দিল। দ্রুত আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেনা অফিসারদের দেয়া হয় যুদ্ধের নির্দেশনা।

পরের বিবরণ ব্রিটিশ বাহিনীর একজন সদস্য মেজর জেনারেল আকবর খানের কাছেই শোনা যাক। তিনি লিখেছেন, বৈঠক শেষ করে সবাই নিজ নিজ তাবুতে ফিরছিলেন এসময় আকাশের কোনে মেঘ দেখা যায়। সবাই খুশি হয়ে উঠে। যাক, গরমের প্রচন্ডতা কমে যাবে। দ্রুত শিলাবৃষ্টি শুরু হলো। লোকজন সবাই শিল কুড়াতে চলে গেল। কিন্তু একটু পরেই শুরু হলো প্রচন্ড শিলাবৃষ্টি। দেখতে দেখতে পাশের পাহাড় সাদা চাদরে ঢেকে গেল। একটু পরে শিলার স্তুপ টিলার আকার নিয়ে আমাদের ক্যাম্পের দিকে ধেয়ে এল এবং নিম্মাঞ্চলে অবস্থিত বেশিরভাগ তাবু ছিড়ে গেল। এই ঝড়ে ব্রিটিশ বাহিনীর অস্ত্র ও রসদ নষ্ট হয়ে যায়। আবার রসদ ও অস্ত্রের এক বিশাল অংশ বাতাসের তোড়ে ফকির ইপির ক্যাম্পের দিকে চলে যায়। এসব অস্ত্র ও রসদের মালিক হয়ে যায় ফকির ইপির লোকজন।

হতাশ ব্রিটিশ বাহিনী ছাউনি তুলে ফিরে যায়। (২)


১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ফকির ইপির লড়াই চলতেই থাকে। এ সময় যুদ্ধে তার দুই ছেলেও নিহত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও ফকির ইপি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমরা তো সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়েছি। এই স্বাধীনতার মূল্য কী? এখনো এখানে আমরা ইসলামি নেজাম প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।

দীর্ঘদিন অ্যাজমায় ভুগে ১৬ এপ্রিল ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।

সূত্র
————
১। পশতুনো কি তারিখ, পৃষ্ঠা ৩৭৩ (উর্দু সংস্করণ)– প্রফেসর আনোয়ার রুম্মান।
২। মহানবী (সা) এর প্রতিরক্ষা কৌশল, পৃষ্ঠা ১৭০– মেজর জেনারেল আকবর খান।

অন্যান্য লেখা

বইয়ের ক্যাটালগ ডাউনলোড করুন