সংবাদটা ছড়িয়ে পড়লো রায় থেকে সমরকন্দ। হায় হায় করে উঠলো সবাই। রেশম পথের ধারে সরাইখানাগুলোতে পরিব্রাজক দলের মুখরোচক আড্ডায় বারবার ঘুরে ফিরে আসলো কথাটা । প্রথমে কেউ কেউ অবিশ্বাস করলেও জানা গেলো সংবাদটা আসলেই সত্যি । আগুন লেগেছে বাগদাদের জামিয়ানিজামিয়ার কুতুবখানায় । অবশ্য খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির আগেই বেশিরভাগ বই সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়। সময়কাল ৫১০ হিজরী । ইবনে আসীর ৫১০ হিজরীর ঘটনাবলীতে এই অগ্নিকান্ডের কথা উল্লেখ করেছেন।
সব কুতুবখানার ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন হয় নি । বসরার দারুল কুতুবের কথাই ধরা যাক। ৪৮৩ হিজরীতে আগুন লেগে পুড়ে গেলো এই কুতুবখানা । ৫৫৬ হিজরীতে নিশাপুরে আভ্যন্তরীন গোলযোগে পুড়ে গেলো ১২ টি কুতুবখানা । ৫৬৭ হিজরীতে আইয়ুবীরা মিসরে প্রবেশ করার পর ফাতেমীদের কুতুবখানার এক বিরাট অংশ আগুনে পোড়ানো হয়, নীলনদে ডুবানো হয়। ৫৪৮ হিজরীতে সুলতান মাহমুদ বিন সুবক্তগীন যখন রায় শহর অধিকার করেন তখন পোড়ানো হয় রাফেজীদের বইপত্র।
কায়রোর বিখ্যাত বাইতুল ইলমের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হাকেম বি আমরিল্লাহ । মাত্র ৬৪ বছর পরে ১০৬৮ খ্রিস্টাব্দে কায়রোর উযির আবুল ফারাজ সেই কুতুবখানায় এলেন ২৫ টি উট নিয়ে । ২৫ উট ভর্তি বইপত্র নিয়ে এক লাখ দিনারে বিক্রি করে দেন। সেই টাকায় সেনাবাহিনীর বেতনভাতা পরিশোধ করেন। কয়েক মাস পর তুর্কীরা বিজয় লাভ করে কায়রো প্রবেশ করে। পুড়িয়ে ফেলে বাইতুল ইলমের বইপত্র। কেউ কেউ আবার ব্যস্ত ছিল বইয়ের বাধাই খুলে সুতা তৈরীতে ।
মধ্য এশিয়ার কুতুবখানাগুলো ধংস করে তাতারীরা। কী পরিমান কুতুবখানা ছিল মধ্য এশিয়ায় তা ইয়াকুত হামাভীর বিবরণ থেকে ধারণা করা যায় । হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীতে তিনি মার্ভ শহরে ভ্রমন করেন। সেখানে তখন ১২ টি কুতুবখানা ছিল। এগুলো ছিল সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত। একটি কুতুবখানায় তিনি ১২০০০ বই দেখেছেন। গোবী থেকে ধেয়ে আসা তাতারী ঝড়ে বিপর্যস্ত হয় সোনালী গম্বুজের শহর সমরকন্দ । হারিয়ে যায় নিশাপুর , হেরাত ও বলখের কুতুবখানাগুলো। রায় এবং হামাদানের মধ্যবর্তী সাওয়াহ একটি ছোট শহর। এখানের কুতুবখানা ছিল খুবই প্রসিদ্ধ। ইয়াকুত হামাভী লিখেছেন তাতারীরা শহরে হামলা করে পাইকারী গনহত্যা চালায় এবং এই কুতুবখানা পুড়িয়ে ফেলে। ৬৫৬ হিজরীতে তাতারীদের হাতে বাগদাদের পতন হয় । ধংস হয় বাইতুল হিকমাহ । দজলার পানিতে ডুবানো হয় বই , কালো হয়ে যায় দজলার পানি । বাগদাদেও সেদিন পুড়ছে বই। তাতারীরা মাসউদ বেগের কুতুবখানা পুড়িয়েছে ৬১৭ হিজরীতে (১২২০ খ্রিস্টাব্দ), বোখারায়। পারস্যে খারেজম শাহের পাঠাগার ছিল সুপ্রসিদ্ধ। চেংগিজ খানের তাতারী বাহিনী যখন পারস্যে প্রবেশ করলো তারা জনপদে নির্বিচারে হত্যাকান্ড চালায় । পুরো কুতুবখানা ধবংস করে দেয় । এটা ৬১৮ হিজরীর (১২২১ খ্রিস্টাব্দ) ঘটনা।তাতারীরা দামেশকের কুতুবখানায় আগুন ধরিয়ে দেয় ৭০০ হিজরীতে (১৩০০ খ্রিস্টাব্দ) ।
মাহমুদুদ্দৌলা ইবনে ফাতিক। একাদশ শতকের ফাতেমী যুবরাজ। বইয়ের প্রচন্ড নেশা ছিল। যুদ্ধের ময়দানেও বই নিয়ে যেতেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে আবার বইয়ে ডুবে যেতেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী একদিন স্বামীর পাঠাগার দেখতে এলেন । বইগুলো দেখেই তার রাগ উঠে যায়। দাসীদের আদেশ দিলেন সব বই হাউজে ফেলতে। তাই করা হলো। পরে একজন সামান্য কিছু বই উদ্ধার করেছিলেন।
কিতাব পোড়ানোর এই যজ্ঞে শামিল আছে ইউরোপিয়ান ক্রুসেডাররাও। ৫০৩ হিজরীতে তারা তরাবলিসের কুতুবখানা পুড়িয়ে ফেলে। ১১০৯ খ্রিস্টাব্দে ধংস করা হয় ত্রিপোলির কুতুবখানা । ক্রুসেডাররা যখন ধেয়ে আসে মুসলিম বিশ্বের দিকে তখন তারা ধবংস করে শহরের পর শহর। তাদের তান্ডবলীলায় পুড়েছে সাজানো জনপদ, পুড়েছে বই। তরাবলিস, কুদস, আসকালান ও অন্যান্য অঞ্চলে তারা যে পরিমান বই পুড়িয়েছে তার পরিমান ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। ড মোস্তফা আস সিবাইয়ের মতে সেদিনের পৃথিবীতে ক্রুসেডারদের হাতে পুড়েছে ত্রিশ লক্ষ বই। স্পেন যখন আমাদের হাতছাড়া হলো, আমরা হারালাম আমাদের আন্দালুসকে, তখন গ্রানাডার ময়দানে একদিনেই পোড়ানো হয়েছে দশ লক্ষ বই। হালাবের বিখ্যাত খাজানাতুস সুফিয়াহ ধবংস হয় শিয়া সুন্নী দাংগায়। আশুরার দিনে সংঘটিত এই দাংগায় এই পাঠাগারের বেশিরভাগ বইই পুড়ে যায়। বার্বাররা যখন কর্ডোভা প্রবেশ করে তারা লুটপাট চালায় হাকেম মুস্তানসিরের পাঠাগারে। প্রচুর বইপত্র তারা বিক্রি করে দেয়। বাকিগুলো ধবংস করে।
কখনো আবার নিজেই পুড়িয়েছেন নিজের বই। উরওয়াহ ইবনে যুবাইর এমনই একজন। ৯১ হিজরী তথা ৭০৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল কারী এই তাবেয়ী নিজের সব বইপত্র পুড়িয়ে ফেলেন। কিতাব পোড়ানোর এই যজ্ঞে শরিক হয়েছেন আবু ওমর বিন আলা (মৃত্যু ১৫৪ হিজরী/৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) । তার সম্পর্কে আবু উবাইদা জানাচ্ছেন, আবু ওমর অন্যদের চেয়ে আইয়ামে আরব ও কবিতায় অধিক জ্ঞান রাখতেন। তার বইয়ের সংগ্রহ ঘরের ছাদ ছুয়েছিল। এরপর তিনি যুহদের পথ অবলম্বন করেন এবং নিজের বইপত্র পুড়ে ফেলেন।
কখনো কখনো কিতাব পুড়েছে দুর্ঘটনায়। মিসরের কাজী আব্দুল্লাহ বিন লাহিমার গৃহে আগুন লেগে তার সব বইপত্র পুড়ে যায়। ৫১০ হিজরীতে আগুন ধরে জামিয়া নিজামিয়ার কুতুবখানায়। অবশ্য খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির আগেই আগুন নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হয়।
অনেকসময় বই নষ্ট করার পেছনে ছিল রমনীর হাত। একটু আগে বলা হয়েছে ফাতেমী যুবরাজ ইবনে ফাতিকের কথা। তার মতোই এমন ঘটনা ঘটে খলীল বিন আহমাদের জীবনে। তিনি একটি সুন্দরী দাসী ক্রয় করেছিলেন। দাসী তার উপর মনক্ষুন্ন ছিলো কারন খলিল সারাদিন কিতাবুল আইন পড়তেন। শীঘ্রই বইটি দাসীর চক্ষশূল হয়ে উঠে। একদিন সে বইটি পুড়িয়েই ফেলে। খলীল এ ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হন কারন তার কাছে বইটির আর কোনো কপি ছিল না।
বই পুড়েছে নানা কারনে । সময়টা তখন অস্থির। দফায় দফায় হচ্ছে ক্ষমতার পালাবদল। ক্ষমতার পালাবদল মানেই ইতিহাসেরও পালাবদল। নতুন ভাবে রচিত হচ্ছে ইতিহাস। কখনো কখনো শাসকরা পুরনো বইয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে নিজেদের মনমত তথ্য। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে উস্কে দেয়া হচ্ছে বংশীয় কিংবা আকিদাগত বিরোধ। সচেতন লেখকরা তাই চিন্তাশীল। মৃত্যুর পর লেখাগুলো অবিকৃত থাকবে তো ?? কারো কারো কাছে মনে হলো নিজের লেখা পুড়িয়ে ফেলা বেশ ভালো সমাধান। বিকৃতির পথ চিরতরে রুদ্ধ। এ পথেই হেটেছেন ইবনুল জাআবি (মৃত্যু ৩৫৫ হিজরী/৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ)। নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেলেছেন নিজের সব বইপত্র। ইমাম দারে কুতনি এ ঘটনার সময় তার পাশেই ছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী। সিরাফী (মৃত্যু ৩৮৫ হিজরী/৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ) তার ছেলেকে অসিয়ত করেছেন তার বইগুলো পুড়িয়ে ফেলতে। আবু হাইয়ান তাওহিদি (মৃত্যু ৪০০ হিজরী) ধারনা করেছিলেন তার মৃত্যুর পর তার বইপত্রের মর্ম মানুষ বুঝবে না। তাই সমাধান খুজলেন বই পোড়ানোর পথেই।
৪৪৮ হিজরী তথা ১০৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে শিয়া সুন্নী দাংগায় পুড়ে যায় মুহাম্মদ আবু জাফর তুসির ব্যক্তিগত কুতুবখানা । শাসকের রোষানলেও পুড়েছে বই। ইবনে হাজম আন্দালুসির (মৃত্যু ৪৫৬ হিজরী /১০৬৩ খ্রিস্টাব্দ) বইপত্র পুড়িয়ে ফেলেছিলেন ইশবালিয়ার শাসনকর্তা মুতাজিদ বিন আব্বাদ। সুলতান মাহমুদ বিন সুবক্তগীন যখন রায় শহর দখল করলেন ৫৪৮ হিজরীতে তখন শহরের দারুল কুতুব পোড়ানো হলো। বেশিরভাগ ছিল ইলমে কালাম সম্পর্কে লিখিত বিদাতী ও রাফেজিদের বই। ৭৪৪ হিজরীতে (১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদের মাদরাসা আসরুনিয়াতে ইবনুল আরাবির বইপত্র ছিড়ে ফেলা হয়, যার মধ্যে ছিল ফুসুসুল হিকাম বইটিও। ৭৭৩ হিজরীতে (১৩৭১ খ্রিস্টাব্দ) মোহাম্মদ বিন খতীবের বইপত্র পোড়ানো হয় আন্দালুসে।
দামেশকের জামে উমাভী। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার এক ঐতিহাসিক স্থান। দুবার আগুনে পুড়ে যায় জামে উমাভি। ধবংস হয় মূল্যবান অনেক বই। প্রথমবার আগুন লাগে ৪৬১ হিজরী/১০৬৮ খ্রিস্টাব্দে । পরেরবার ৭৪০ হিজরী/১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে। বাগদাদে সাবুর বিন আরদশীরের কুতুবখানা পুড়ে গেল ৪৫১ হিজরীতে (১০৫৯ খ্রিস্টাব্দ)। তার এই কুতুবখানায় ছিল অনেক দুষ্প্রাপ্য বই। ৪৮৩ হিজরীতে (১০৯০ খ্রিস্টাব্দ) পুড়ে গেল বসরার দারুল কুতুব। ইবনুল আসীর ও ইবনুল জাওযি দুজনেই বর্ননা দিয়েছেন এই অগ্নিকান্ডের। ৪৯৯ হিজরীতে (১১০৫ খ্রিস্টাব্দ) পুড়ে যায় কাজী আবুল ফারাজ বিন আবুল বাকার কুতুবখানা।
কাজী সাদিদুদ্দিন ইয়াহইয়া বিন সাঈদ। আব্বাসী সালতানাতের কাজী। তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় ৫৫৫ হিজরীতে (১১৬০ খ্রিস্টাব্দ) ,মুস্তানজিদের আমলে। পুড়িয়ে ফেলা হয় তার বইপত্র। তার সংগ্রহে ছিল ইবনে সীনার কিতাবুশ শিফা, এবং ইখওয়ানুস সফার বইপত্র। একই বছর বিশাপুরে আভ্যন্তরীন গোলযোগের কারনে পোড়ানো হয় আকিল মসজিদের পাঠাগারে থাকা বইপত্র। ৫৬৭ হিজরীএত (১১৭১ খ্রিস্টাব্দ) আইয়ুবীরা মিসরে প্রবেশ করে পোড়ালো ফাতেমীদের বইপত্র। খলীফা আজিজ বিল্লাহ প্রতিষ্ঠিত কায়রোর বিখ্যাত খাজানাতুল কুতুবের বইপত্র পোড়ানো হলো, নীলনদে ডোবানো হলো। কিছু বইপত্র মরুভূমিতে ফেলে রাখা হলো। মুরাবিতিনরা আন্দালুস দখলের পর দর্শনের বইপত্র পোড়ানো হয়। এর মধ্যে ইমাম গাজালির বইপত্রও ছিল। পরে আবার ক্ষমতার পালাবদলে মুয়াহহিদিনরা যখন ক্ষমতায় এলো, তারা পোড়ালো মুরাবিতিনদের বই। পরে আবার মুয়াহহিদিনরা হারলে মুরাবিতীনরা তাদের বই পোড়ালো। মালেকি মাজহাবের বইপত্র নিয়ে যাওয়া হলো ফাস শহরে, পোড়ানো হলো জনসম্মুখে।৫৯৫ হিজরী (১১২১ খ্রিস্টাব্দে) আগুন লাগে ইস্ফাহানের জামে মসজিদে। পুড়ে যায় অনেক বইপত্র। ৫৯৯ হিজরীতে (১১২১ খ্রিস্টাব্দ) ক্রুসেডাররা ইস্তাম্বুল দখল করে। শুরু হয় গনহত্যা। পুড়িয়ে ফেলা হয় দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিশাল সংগ্রহ।
হিংসার কারনেও পোড়ানো হয়েছে বই। আবদুস সালাম জিলী এমনই এক প্রতিহিংসার শিকার। খলীফা মুস্তানসির পুড়িয়েছেন ইবনুল আবারের বইপত্র। সময়কাল ৬৫৮ হিজরী (১২৫৯ খ্রিস্টাব্দ) । ৩২২ হিজরীতে (৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদে পৌছান আবু বকর বিন মুকসিম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উথে তিনি বিদআতি। পুড়িয়ে ফেলে হয় তার বইগুলো। ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে মিসরের কেল্লা জাবালের খাজানাতুল কুতুবে আগুন ধরে। পুড়ে যায় হাদীস, তাফসীর, ইতিহাস , সাহিত্য বিষয়ক প্রচুর বই।
নাজাফের কুতুবখানায় আগুন লাগে ৮২৮ হিজরীতে (১৪২৪খ্রিস্টাব্দ)। পুড়ে যায় হজরত আলী র এর লেখা দুষ্প্রাপ্য একটি পান্ডুলিপি। দামেশকের মাদরাসা আদেলিয়্যাহ ও মাদরাসা কাজাইয়্যাহর কুতুবখানায় আগুন লাগে তৈমুর লঙ্গয়ের আক্রমনে । সময়কাল ৮০২ হিজরী (১৪০০ খ্রিস্টাব্দ)। ইসমাইল শাহ প্রথম পুড়িয়েছিল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বইপত্র। সময়কাল ৮৯০-৯৩০ হিজরী (১৪৮৫-১৫২৩ খ্রিস্টাব্দ)। স্থান পারস্য।
মুসলমানরা স্পেন শাসন করেছে প্রায় আটশো বছর। তারা স্পেনকে গড়ে তুলেছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে । সেখান থেকে আলো নিয়েই ইউরোপ হয়েছে সভ্য। এগিয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে। ৯০৫ হিজরীতে (১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দ) গ্রানাডার পতনের মধ্য দিয়ে স্পেন মুসলমানদের হাতছাড়া হয়। তারপর শুরু হয় মুসলমানদের বই পোড়ানোর মহতসব। আন্দালুসের কুতুবখানাগুলোর করুন পরিনতির কথা ভেবে ইতিহাস আজো কেদে উঠে। গ্রানাডার ময়দানে বার্বাররা একদিনেই পুড়িয়েছিল দশ লক্ষ বই।
কিতাব যেভাবে পুড়েছে , সেভাবে ডুবেছেও। আইয়ুবীরা মিসরে পৌছে ফাতেমীদের কিতাব পুড়িয়েছে, নীলনদেও ডুবিয়েছে। তাতারীরা বাগদাদের কুতুবখানার বইপত্র দজলার পানিতে নিক্ষেপ করেছে ।
বই পানিতে নিক্ষেপ করার প্রথম যে সংবাদ পাওয়া যায় , তা তাজুল উম্মাহ খ্যাত দাউদ তাঈ বিন নাসির আল কুফির (মৃত্যু ১৬৫ হিজরী/৭৮১ খ্রিস্টাব্দ)। ইয়াকুত হামাভী লিখেছেন তার সম্পর্কে , দাউদ তাঈ নিজের বইগুলো ফুরাত নদীতে ডুবিয়ে দেন। আবু উমর হারুরী (মৃত্যু ২৫৫ হিজরী/৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) সফর করছিলেন পারস্যে, নৌপথে। নিহরাওয়ানে পৌছলে নদীতে প্লাবন আসে। ওজন কমানোর জন্য নদীতে অনেক মালপত্র ফেলে দেন। এর মধ্যে ছিল আবু উমর শায়বানীর (মৃত্যু ২০৮ হিজরী/৮২৩ খ্রিস্টাব্দ) ‘কিতাবুল জীম’। দুর্ঘটনায় পানিতে ডুবে যায় আহমাদ বিন মোহাম্মদ আল বাজ্জাজের (মৃত্যু ৪০৭ হিজরী/১০১৬ খ্রিস্টাব্দ) বইপত্র। আবুল আলা ছয়িদ বিন হাসান বিন ঈসা রিবয়ী মোসুলি (মৃত্যু ৪১৭ হিজরী/১০২৬ খ্রিস্টাব্দ) । মানসুর বিন আবু আমেরের সময় তিনি আন্দালুসে পৌছেন। মানসুর তাকে সম্মান করেন, অভ্ররথনা জানান। আবুল আলা একটি বইও লেখেন মানসুরের জন্য। একজন গোলামের হাতে বইটি দিয়ে তাকে বলেন বইটি মানসুরের কাছে পৌছাতে। গোলাম হাটছিল কর্ডোভার বিখ্যাত নহরের পাড় ধরে। হঠাত পা পিছলে সে বইসহ নহরে পড়ে যায়। গোলাম অক্ষত উঠতে পারলেও বইটি নষ্ট হয়ে যায়। আবুল হাসান আলী বিন আবদুল্লাহ (মৃত্যু ৪১৫ হিজরী/১০২৪ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন বিখ্যাত ভাষাবিদ। তিনি প্রচুর বই লিখেছেন। তার মৃত্যুর পর তার বইপত্র ইবনে দীনার ওয়াসেতির হাতে আসে। পরে বন্যার সময় বেশিরভাগ বই পানিতে নষ্ট হয়ে যায় । বাগদাদের বন্যায় নষ্ট হয় ইবনে দুহানের (মৃত্যু ৫৬৯ হিজরী/১১৭৩ খ্রিস্টাব্দ) লিখিত বই । বই পানিতে ডুবানোর সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে তাতারীদের হাতে বাগদাদ পতনের পর। সময়কাল ৬৫৬ হিজরী তথা ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ। তাতারীরা নির্মমভাবে বাগদাদের পাঠাগারগুলো লুন্ঠন করে। বইপত্র নিক্ষেপ করে দজলা নদীতে। দজলা নদীর পানি কালো হয়ে যায় বইয়ের কালি উঠে। ১০৫৫ হিজরী তথা ১৬৪৫ সালে মক্কায় দেখা দেয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর বন্যা। বন্যার পানি প্রবেশ করে মসজিদে হারামে। নষ্ট হয় অনেক বইপত্র ।শায়খ আব্দুল আজিজ নাজফী ভারত, ইরাক ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার ওয়ারিসদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। কেউ তার বইপত্র বিক্রি করে দেয় । আবার কেউ তার বইপত্র ফেলে নজফের নদীতে। তিন নৌকা বোঝাই বই যাচ্ছিল ফাতিকান শহরে । প্রতিটি নৌকায় ছিল ইতিহাস, দর্শন ও অন্যান্য বিষয়ের বই। নদীতে ঝড় উঠেলে দুটি নৌকা ডুবে যায়। হারিয়ে যায় অনেক বই।
৭৫০ হিজরীতে (১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দ) ডুবে যায় হজরত উসমান সংকলিত কোরআনের একটি কপি। এটি প্রথমে কর্ডোভার জামে মসজিদে ছিল। সুলতান আব্দুল মুমিন বিন আলীর শাসনামলে সেখান থেকে মারাকেশে আনা হয়। সুলতান আবুল হাসান মারিনী যখন আফ্রিকা জয় করেন তখন তিনি এই কপিটি নিজের অধিকারে নেন। বরকত হিসেবে যুদ্ধযাত্রা ও সফরে এটি নিজের সাথে রাখতেন। ৭৫০ হিজরীতে তিনি নৌপথে তিউনেসিয়া থেকে মরক্কোর দিকে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়। নৌকা ডুবে যায়। সাথে ডুবে যায় হজরত উসমানের স্মৃতিবিজড়িত এই কপিটিও।
তথ্যসূত্র :
১। আল কিতাব ফিল হাদারাতিল ইসলামিয়্যা — ড. ইয়াহইয়া ওহিব জুবুরী
২। মিন রাওয়াউই হাদারাতিনা– ড. মোস্তফা আস সিবাঈ
৩। নাফহুত তীব মিন গুসনীল উন্দুলুসির রাতিব — আল্লামা মাক্কারি
৪। আল বায়ানুল মাগরিব ফি ইখতিসারি আখবারী মুলুকিল উন্দলুস ওয়াল মাগরিব — আহমাদ বিন মুহাম্মদ মারাকেশী
৫। হারকুল কুতুব ফিত তুরাসিল আরাবি– নাসের হাজিমী।