জীবন ধারণের জন্য জীবিকার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ইসলাম কখনো এর গুরুত্ব অস্বীকার করেনি। বরং বিভিন্নভাবে জীবিকার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে (১)।
রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যৌবনে ব্যবসা করেছেন (২)। জারেক নামক স্থানে তিনি কৃষিকাজও করেছেন। সাহাবায়ে কেরামও বিভিন্ন পেশায় জড়িত ছিলেন। পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের জীবনি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারাও নিজেদের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রেখেছেন। হালাল উপার্জনের মাধ্যেম তারা স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছেন। একইসাথে তারা ইলমচর্চাতেও ব্যাঘাত ঘটতে দেননি। জীবিকা ও ইলমচর্চার মধ্যে তারা বিস্ময়কর ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন। হাম্মাদ বিন যায়দ বলেছেন বিখ্যাত মুহাদ্দিস আইয়ুব সখতিয়ানির কথা। হাম্মাদ বলেন, আমরা আইয়ুব সখতিয়ানির কাছে বাজারে যেতাম হাদিস পড়তে। তিনি বলতেন তোমরা আমার সামনে বসে ক্রেতাদের পথ আটকে দিচ্ছ। আমার পেছনে বসো তারপর যা জানতে চাও প্রশ্ন করো (৩)। পেশা বা আয়ের সুসংহত খাত থাকার ফলে তাদের ইলমচর্চার পথ হতো মসৃন। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক তার ছাত্র হাসান বিন রবি কুফিকে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমার পেশা কী? হাসান বললেন, আমি চাটাইর ব্যবসা করি। কয়েকজন কর্মচারী আছে। তারা চাটাই বানায় এবং বিক্রি করে। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেন, তোমার এই ব্যবসা না থাকলে আমার এখানে থাকা তোমার জন্য কঠিন হতো (৪)। আবু উমর মুহাম্মদ বিন খশনাম বিন আহমদ নিশাপুরী। নিশাপুরের বিখ্যাত আলেম। তিনি কাগজের ব্যবসা করতেন (৫)। আবুল ফজল মানসুর বিন নসর বিন আব্দুর রহিম নিশাপুরিও কাগজের ব্যবসা করতেন। আল্লামা সামআনি তার সম্পর্কে লিখেছেন, খোরাসানের প্রসিদ্ধ মানসুরি কাগজ তার দিকেই সম্পৃক্ত করা হয় (৬)। আবুল হাসান মুহাম্মদ বিন আলি বিন আব্দুল্লাহ ওয়াররাক ছিলেন শামের বিখ্যাত মুহাদ্দিস। তিনি কলম ও কালি বিক্রি করতেন। আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বিন মোহাম্মদ বিন আহমদ বাগদাদের বাবে নববীর পাশে কালি বিক্রি করতেন। যারা অর্থের বিনিময়ে বইপত্রের অনুলিপি প্রস্তুত করতেন তাদের ওয়াররাক বলা হতো। ইবনে খালদুন ওয়াররাকদের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে , ‘বইয়ের অনুলিপি প্রস্তুত করা, প্রুফ দেখা, বাধাই করা এবং বই সংক্রান্ত যাবতীয় কিছু ওয়াররাকদের কাজের আওতায় পড়ে’ (৭) । আল্লামা সামআনি অবশ্য সংজ্ঞাটা আরো পরিস্কার করেছেন, ‘ ওয়াররাকরা কুরআনুল কারীম, হাদীস ও অন্যান্য বইপত্র লেখার কাজ করে। এছাড়া যারা কাগজ বিক্রী করে তাদেরকেও ওয়াররাক বলা হয়।’ আলেমদের অনেকেই এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। আবু জাফর আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন আইয়ুব বাগদাদি ছিলেন বাগদাদের প্রখ্যাত আলেম। তিনি ফজল বিন ইয়াহইয়া বিন খালেদ বারমাকির গৃহে অবস্থান করে বইপত্রের অনুলিপি প্রস্তুত করতেন (৮) আবুল আব্বাস আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন সাইদ বিন আব্দুর রহমান বসবাস করতেন কুফায়। পেশায় ছিলেন ওয়াররাক। খতীব বাগদাদি তার সুন্দর হস্তলিপির প্রশংসা করেছেন (৯)। আবু মুসা সুলাইমান বিন মুহাম্মদ বিন আহমদ পরিচিত ছিলেন হামেদ বাগদাদী নামে। তিনি ছিলেন কুফার বিখ্যাত নাহুবীদ। তিনিও পেশায় ওয়াররাক ছিলেন। আবুল কাসেম সোলাইমান বিন আব্দুল মালেকও ছিলেন পেশায় ওয়াররাক (১০)। মাহা নামক স্থানের অধিবাসী আলেমগন কোরআন শরীফের অনুলিপি প্রস্তুত করতেন। বিখ্যাত পর্যটক ও ভূগোলবিদ মাকদিসি তাদের সম্পর্কে লিখেছেন, তারা উন্নত চরিত্রের অধিকারী এবং তাদের হাতের লেখাও খুব সুন্দর (১১)। আবুল কাসেম ইসমাইল বিন আহমদ সমরকন্দী ছিলেন তার সময়ের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের একজন। বাগদাদের জামে মানসুরে হাদিসের দরস দিতেন। ইবনুল জাওযি লিখেছেন, তিনি ওয়াররাকদের বাজারে বই বিক্রি করতেন (১২)। ব্যবসার সাথে জড়িত উলামাদের নামের তালিকা অনেক দীর্ঘ। হযরত সালেম বিন আব্দুল্লাহ বাজারে ব্যবসা করতেন। দাউদ বিন আবি হিন্দ রেশমি চাদর বিক্রি করতেন। ইমাম আবু হানিফার ছিল কাপড়ের ব্যবসা। বিখ্যাত কারী হামযাহ যিয়াত যাইতুন ও আখরোটের ব্যবসা করতেন। কুফা ছিল তার ব্যবসাস্থল। মুহাম্মদ ইবনে সুলাইমানের ছিল ঘোড়ার ব্যবসা। আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারকও ব্যবসা করতেন। তাজকিরাতুল হুফফাজে তার জীবনি আলোচনায় যাহাভী তাকে ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিয়েছেন (১৩)। উলামায়ে কেরাম কখনো কখনো রাজদরবারে চাকরি করেছেন। ইবনে হাযম আন্দালুসি ছিলেন খলিফা মুস্তানতাহির বিল্লাহর উযির। শাফেয়ী মাজহাবের ফকিহ কামালুদ্দিন ছিলেন সুলতান নুরুদ্দিন যিংকির সরবারের সভাসদ। ইবনে খাল্লিকান তার প্রশংসা করেছেন। মাওলানা তাজুদ্দিন ইবরাহিম পাশা ছিলেন উসমানি সুলতান বায়যিদ ইয়ালদারমের মন্ত্রী (১৪)। আবু বকর আহমদ বিন সালমান বিন হাসান ছিলেন হাম্বলী মাজহাবের আলেম। বসবাস করতেন বাগদাদে। প্রতি শুক্রবার জামে মনসুরে তার দুটি মজলিস হতো। জুমার আগে তিনি হাম্বলি ফিকহের আলোকে প্রশ্নের উত্তর দিতেন। জুমার পরে হাদিসের দরস দিতেন। তিনি লেপ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন (১৫)।
হাজার বছর আগের মুসলিম বিশ্ব। সেকালে নানা ধরনের কাপড় তৈরী করা হতো। কুফার রেশম কাপড় তৈরীর অনেক কারখানা ছিল। এখানকার পাগড়ির কাপড় ছিল বিখ্যাত। উলামায়ে কেরামের অনেকে কাপড় ব্যবসার সাথেও জড়িয়ে পড়েন। এমনই একজন ফুরাত কাজাজ তামিমি। তার জন্মস্থান বসরায় হলেও তিনি কুফায় বসবাস করতেন। করতেন কাপড়ের ব্যবসা। আবু মানসুর আব্দুর রহমান বিন আবু গালেব একজন বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। অনেকের থেকে তিনি হাদিস বর্ননা করেছেন। তিনিও কাপড়ের ব্যবসা করতেন। আবুল হাসান মোহাম্মদ বিন সান্নান বিন ইয়াযিদ হাদিসের দরস দিতেন। পাশাপাশি তার ছিল কাপড়ের ব্যবসা। আবু ইয়াহইয়া বিন ঈসা ছিলেন ইমাম মালেকের ছাত্র। অনেক মুহাদ্দিস থেকে তিনি হাদিস বর্ননা করেছেন। তিনিও ছিলেন কাপড় ব্যবসায়ী। আবু সুলাইমান আইয়ুব বিন সালমান বসরায় বসবাস করতেন। তার পেশা ছিল সুতি কাপড়ের ব্যবসা। রবি বিন সালেম বসরায় পুরাতন কাপড়ের ব্যবসা করতেন। আবু ইসহাক ইবরাহিম বিন হুসাইন হাল্লাজ ছিলেন বাগদাদের বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক। তিনি তুলার ব্যবসা করতেন (১৬)।
উলামায়ে কেরাম সমকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথেও নানাভাবে জড়িয়েছেন। এমনকি শাসকদের প্রেরিত দূত হয়ে তারা বিভিন্ন অঞ্চলে সফরও করেছেন। এমনই একজন ইমাম শাবী। খলিফা আল মালিক তাকে রোমের কায়সারের নিকট প্রেরণ করেন। কায়সার ইমাম সাহেবের জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রখরতায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, আমি অবাক হচ্ছি, মুসলমানদের মধ্যে এমন জ্ঞানী ব্যক্তি থাকতে তারা কী করে আরেকজনকে খলিফা নির্বাচিত করে।ইমাম আবু ইয়াকুব সিরাজিকে বাগদাদের খলিফার পক্ষ থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। শাইখ শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দি খলিফার দূত হয়ে সমরকন্দে গমন করেন। মুহাম্মদ ইবনে সালামাহ মিসরের শাসকের প্রতিনিধি হয়ে রোমে যান। খলিফা মুত্তাকি বিল্লাহ কামালুদ্দিন শাফেয়িকে দূত মনোনিত করে রোমে পাঠান। আল্লামা কোশজি শারেহকে সমরকন্দের শাসক মির্জা উলুগ বেগ প্রতিনিধি হিসেবে সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহের নিকট প্রেরণ করেন। হাফেজ ইবনে মাকুলাও বাগদাদের খলিফার প্রতিনিধি হয়ে সমরকন্দে সফর করেন (১৭)।
আবু বকর আব্দুল্লাহ বিন গাজাল ছিলেন হজরত হাসান বসরির ছাত্র। তিনি সুতার ব্যবসা করতেন। আবু মানসুর মুহাম্মদ বিন আব্দুল আজিজ বাগদাদের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন। তিনি সুতার ব্যবসা করতেন। তিনি হাদিস পড়ার জন্য মিসর যান। খতিব বাগদাদী তার কথা উল্লেখ করেছেন (১৮)। মাওলানা উসমান খয়রাবাদী। তার সম্পর্কে ‘ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদে’ সুলতানুল মাশায়েখ নিজামুদ্দীন আউলিয়া লিখেছেন, ‘তিনি সবজী বিক্রি করতেন এবং শালগম ও অন্যান্য তরকারী রান্না করে বিক্রি করতেন’। এমন নয় যে তিনি নামের মাওলানা ছিলেন। স্বয়ং নিজামুদ্দীন আউলিয়া লিখেছেন, ‘তিনি কুরআনের মুফাসসির ছিলেন।’ মাওলানা মানাজির আহসান গিলানী লিখেছেন আহমদ হাসান কানপুরির ছেলের কথা। তিনি নিজেও পিতার মতো বড় আলেম ছিলেন। তিনি দোকানে বসে মিঠাই বিক্রি করতেন। কানপুরে তার মিঠাইয়ের খুব সুনাম ছিল (১৯)।
বর্তমানের মতো সেকালেও সাবানের ব্যাপক চাহিদা ছিল। নিশাপুরে একটি পেশাজীবি সম্প্রদায় ছিল যারা সাবানের ব্যবসা করতো। তাদের অভিহিত করা হতো সাবুনিয়া নামে। আলেমদের অনেকে সাবান ব্যবসাও করতেন। শাইখুল ইসলাম আবু উসমান ইসমাইল বিন আব্দুর রহমান বিন আহমদ সাবুনি নিশাপুরি ছিলেন নিশাপুরের বিখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিস। প্রায় ষাটবছর তিনি ইলমচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। নিয়মিত ওয়াজ নসিহত করতেন। নিশাপুরের বাইরে খোরাসান, গজনি, হিন্দুস্তান, জুরজান, তবারিস্তান, শাম, আজারবাইজান প্রভৃতি অঞ্চল সফর করে হাদিসের দরস দেন। তিনি সাবানের ব্যবসা করতেন। আবু মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিন আহমদ ছিলেন এমন আরেকজন সাবান ব্যবসায়ী আলেম (২০)। উলামাদের কেউ কেউ মাটির পাত্র তৈরিতে দক্ষতা অর্জন করেন। সাইদ বিন যুরআ ছিলেন একজন মুহাদ্দিস। তিনি আবু আব্দুল্লাহ সাওবান থেকে হাদিস বর্ননা করেছেন। তার পেশা ছিল মাটির পাত্র বিক্রি। আবু বকর মোহাম্মদ বিন আলি রাশেদি ছিলেন ব্যাকরনবিদ। তিনিও মাটির পাত্র বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন (২১)।
উলামায়ে কেরাম নিজেরা বিভিন্ন পেশায় জড়িয়েছেন। আবার তাদের পেশাজীবি ছাত্রদের সুবিধা অসুবিধার দিকেও তারা খেয়াল রাখতেন। ওলিদ বিন উতবার ঘটনা থেকে এর প্রমান মেলে। তিনি দামেশকের জামে মসজিদে হাদিস পড়াতেন। একজন ছাত্র প্রায়ই দরসে দেরী করে পৌছাতো। একদিন তিনি প্রশ্ন করলে ছাত্র জানালো সে ব্যবসা করে। সকালে উঠে দোকানের মাল খরিদ করে দরসে আসে ফলে দেরী হয়ে যায়। একথা শুনে ওলিদ বিন উতবা বলেন, আজ থেকে তুমি এখানে আসতে হবে না। মসজিদের দরস শেষে আমি তোমার দোকানে গিয়ে তোমাকে হাদিস পড়াবো (২২)।
ঈসা বিন আবু ঈসা। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস। তিনি ইমাম শাবী ও ইমাম নাফে থেকে হাদিস বর্ননা করেছেন। তার থেকে হাদিস বর্ননা করেছেন ওয়াকি বিন মাইসারাহ। জীবিকার তাগিদে তিনি নানা পেশা অবলম্বন করেছেন। কাপড় সেলাই করতেন তাই খইয়াত নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এছাড়া গম বিক্রি করতেন তাই কেউ কেউ তাকে হান্নাত (গম বিক্রেতা) বলতো। এছাড়া তিনি গাছের পাতা বিক্রি করেও জীবিকা নির্বাহ করতেন । সবাই সহজ পেশা গ্রহন করেননি। কেউ কেউ জীবিকার জন্য কঠিন পরিশ্রমের দিকেও ঝুকেছেন। এমনই একজন আবু জাফর মুহাম্মদ বিন ইসহাক বিন মেহরান। তিনি ছিলেন মুহাদ্দিস। তিনি ইসহাক বিন ইউসুফ থেকে হাদিস বর্ননা করেন। তিনি জংগলে গিয়ে কাঠ কেটে আনতেন। সেই লাকড়ি বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
সেকালে খেজুর পাতা, বাশ, গাছের ছাল ইত্যাদি দিয়ে টুকরি বানানো হতো। উলামায়ে কেরামের অনেকে টুকরি তৈরীতে পারদর্শিতা অর্জন করেন। মুসলিম বিন মাইমুন খাওয়াস ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার একজন মুহাদ্দিস। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি ইবাদত বন্দেগীতে কাটাতেন। তার জীবিকা ছিল টুকরি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করা। আবু সালামা ঈসা বিন মাইমুন ছিলেন একজন বিখ্যাত মুফাসসির। তিনিও টুকরি বিক্রি করতেন। শীতকালে শীত থেকে বাচার জন্য মোজার প্রয়োজন পড়ে। আলেমদের অনেকে মোজা বিক্রি করতেন। আতা বিন মুসলিম খফফাফ কুফি হালবে বসবাস করতেন। তিনি মোজা বিক্রি করতেন। সেকালে বসরা থেকে মোসুলে বড় বড় নৌকা চলাচল করতো। পুরনো হয়ে গেলে এই নৌকাগুলো ভেংগে এর তক্তা ও অন্যান্য জিনিস বিক্রি করা হতো। আবার কখনো নৌকা মেরামত করে বিক্রি করা হতো। এভাবে নতুন একটি পেশাজীবী শ্রেণি গড়ে উঠে। উলামায়ে কেরামের কেউ কেউ এই পেশাতেও যোগ দেন। আবু রবি সোলাইমান বিন মুহাম্মদ বসরি। বসরার অধিবাসী এই মুহাদ্দিস আতা ইবনু আবি রবা ও মুহাম্মদ ইবনে সিরিন থেকে হাদিস বর্ননা করেছেন। তার সম্পর্কে আল্লামা সামআনি লিখেছেন, তিনি বসরায় নৌকা বিক্রি করতেন। আবুল ফজল জাফর বিন মুহাম্মদ বিন আহমদ বাগদাদিও এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। বাজারে যারা নিলাম তুলতো তাদেরকে মুনাদি বলা হয়। আবু বকর আহমদ বিন মুসা বিন মুহাম্মদ নিশাপুরের বাজারে নিলাম ডাকতেন। এটিই ছিল তার পেশা। আবু জাফর মুহাম্মদ বিন আবু দাউদ উবাইদুল্লাহ বিন ইয়াযিদও এই পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন (২৩)।
মুসলিম শাসনামলে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র গোসলখানার ব্যবস্থা ছিল । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কর্ডোভা নগরীতেই নয়শো স্নানাগার ছিল (২৪)। এসব স্নানাগারে গরম পানি, সাবান ও তেলের ব্যবস্থা থাকতো। স্নানাগারও ছিল আয়ের মাধ্যম। যারা স্নানাগার নির্মানের মাধ্যমে আয় করতেন তাদের হাম্মামি বলা হতো। সর্বপ্রথম আব্দুল্লাহ বিন উসমান বিন আবুল আস সাকাফি বসরায় একটি হাম্মাম নির্মান করেন। এর অবস্থান ছিল ঈসা বিন জাফরের প্রাসাদের সন্নিকটে। মুসলিম বিন আবু বকর বসরায় আরেকটি হাম্মাম নির্মান করেন। এর দ্বারা তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। আবুল হাসান আলি বিন আহমদ বিন উমর ছিলেন বাগদাদের শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিসদের একজন। তিনিও হাম্মাম নির্মান করে এর দ্বারা উপার্জন করতেন (২৫)। আবু তালেব মুহাম্মদ বিন উবাইদুল্লাহ বিন আহমদ করতেন চালের ব্যবসা। আবুল কাসেম আলি বিন আহমদ বিন মুহাম্মদও চালের ব্যবসা করতেন। আবু মুহাম্মদ হাসান বিন আলি বিন মুসা করতেন ডালের ব্যবসা। আবুল আব্বাস আহমাদ বিন মুহাম্মদ বিন আহমদ তহহান এমনই আরেকজন ডাল ব্যবসায়ী আলেম। আবু ইসহাক ইবরাহিম বিন মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ ছিলেন একজন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ। তিনি বেশকিছু জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। তিনি রুটি বিক্রি করে উপার্জন করতেন। আবুল হাসান আলি বিন সুলাইমান বিন ইযও রুটি বিক্রি করতেন। আবু মোহাম্মদ সাহল বিন নসর বিন ইবরাহিম। বাগদাদের অন্যতম মুহাদ্দিস। তার একটি হোটেল ছিল। এটিই ছিল তার আয়ের মাধ্যম। আবু সাইদ মুহাম্মদ বিন আহমদ ইস্ফাহানিও হোটেল চালাতেন। আবু ইসহাক ইবরাহিম বিন ইউসুফ বিন মাইমুন। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক ও সুফইয়ান ইবনে উয়াইনাহ প্রমুখ থেকে হাদিস বর্ননা করেন। তিনি মুরগি পালতেন। মুহাম্মদ বিন আলি বিন জাফর বিন মাকিয়ানিও মুরগি পালতেন এবং বাজারে বিক্রি করতেন। আবু আব্দুর রহমান হোসাইন বিন আহমদ ছিলেন ইমাম মুসলিমের শাগরিদ। তিনি দুধ বিক্রি করতেন। আবু সাদ নসর বিন আলি পাথরের ব্যবসা করতেন। (২৬)।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। পেশাগত ব্যস্ততা উলামায়ে কেরামকে ইলমচর্চা থেকে দূরে সরায়নি। সকল ব্যস্ততার পরেও তারা নিজেদের ইলমচর্চায় ব্যস্ত রেখেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে কারন তারা সময়কে সঠিক খাতে ব্যয় করতেন। সময় নষ্ট করতেন না। তারা কখনো সস্তা বিনোদনের ফাদে পা দেননি। ইলমই ছিল তাদের বিনোদন। আবু ইমরান মুসা ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সাইদ আন্দালুসি তার ছেলেকে বলেছিলেন, তুমি কি মুতালাআর বাইরে অন্য কিছুতে আনন্দ পাচ্ছো? আল্লাহর শপথ আমি তো এর মতো তৃপ্তি আর কিছুতেই পাই না (২৭)। ইলমের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষনের ফলে তারা সর্বোচ্চ সময় এর পেছনেই ব্যয় করতেন। ফাতাহ ইবনে খাকান ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক। আব্বাসি খলিফা মুতাওয়াক্কিল তাকে মন্ত্রীর দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। দায়িত্বের ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি প্রচুর পড়ালেখা করতেন। খলিফার দরবার থেকে বের হলেই তিনি হাটতে হাটতে কিতাব পড়তেন। খলিফা দরবার থেকে অল্প সময়ের জন্য উঠলেও তিনি পড়া শুরু করতেন। তার ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঠাগার (২৮)। আবু ফজল মুহাম্মদ বিন আহমদ মারওয়াযি বলখী ছিলেন একাধারে মন্ত্রী ও বিচারক। তিনি নিজের দায়িত্বের ফাকেফাকেই লেখালেখি করতেন (২৯)।
উলামায়ে কেরাম নানা পেশা অবলম্বন করে স্বাবলম্বিতা অর্জন করতেন কিন্তু তারা বিলাসে ডুবে যেতেন না। সাধারনত উপার্জিত অর্থের বেশিরভাগই তারা জনকল্যানে ব্যয় করতেন। ইমাম লাইস ইবনে সাদ তার জমিদারী থেকে বার্ষিক আশি হাজার দিনার পেতেন। এর পুরোটাই তিনি অভাবগ্রস্ত ছাত্র ও আলেমদের জন্য ব্যয় করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থ দরিদ্র ফকিহ ও মুহাদ্দিসদের জন্য ব্যয় করতেন। ইমাম আবু উবাইদ মুহাম্মদ বিন ইমরান সবসময় তার গৃহে ৫০ টি বিছানা তৈরী রাখতেন, যেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সফর করে আসা ছাত্র ও আলেমরা সেখানে অবস্থান করতে পারে। ইমাম হাফস বিন গিয়াস কুফী। কুফায় বসবাসকারী এই মুহাদ্দিস ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। তিনি বলতেন যে ছাত্র আমার ঘরে খাবার খাবে না, আমি তাকে হাদিস বর্ননা করবো না (৩০)।
টীকা
১। ক. আল্লাহ ব্যবসা বা কেনাবেচাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন” (সূরা বাক্বারা: আয়াত ২৭৫)।
খ. সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে, এবং আল্লাহকে অধিক স্মরন করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও ( সূরা জুমআহ: ১০)। এই আয়াতের তাফসিরে ইমাম কুরতুবি রহিমাহুল্লাহ লিখেছেন, যখন নামায শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমরা ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেড়িয়ে পড়ো। ( আলজামে লি আহকামিল কুরআন, খ.১৮,পৃ.৯৬)
গ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যার জমি রয়েছে সে নিজেই চাষাবাদ করবে ( সহীহ বুখারী, হাদীস নং – ২৩৪০)
ঘ. হযরত রাফে ইবনে খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন: ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্দ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়। (মুসনাদে আহমদ)
২। নবীয়ে রহমত, ১১৮,১১৯ পৃষ্ঠা- সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী। বাংলা সংস্করণ, মুহাম্মদ ব্রাদার্স।
৩। তারীখে জুরজান, ২৭০ পৃষ্ঠা,– আবুল কাসেম হামযাহ বিন ইউসুফ বিন ইবরাহিম জুরজানি। আলামুল কুতুব, বৈরুত।
৪। মুসলমানো কে হার তবকা ও হার পেশাহ মে ইলম ও উলামা, ১৫ পৃষ্ঠা- কাজি আতহার মোবারকপুরী। শাইখুল হিন্দ একাডেমী দেওবন্দ, ভারত।
৫। প্রাগুক্ত, ৩১ পৃষ্ঠা।
৬। প্রাগুক্ত, ৩৬ পৃষ্ঠা।
৭। আল মুকাদ্দিমা, (২য় খন্ড, ৮৩ পৃষ্ঠা)– ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব, দামেশক।
৮। ওয়াররাকু বাগদাদ ফিল আসরিল আব্বাসি, ৪৫৬ পৃষ্ঠা – ড খাইরুলাহ সাইদ। মারকাযু মালিক ফয়সল লিল বুহুস ওয়াদ দিরাসাতিল ইসলামিয়া, রিয়াদ, সৌদী আরব।
৯। মাওসুআতুল ওয়াররাকাহ ওয়াল ওয়াররাকিন, ৩য় খন্ড, ৭৪ পৃষ্ঠা, – ড খাইরুল্লাহ সাইদ। আল ইনতিশারুল আরবী, বৈরুত, লেবানন।
১০। প্রাগুক্ত, ৭৬ পৃষ্ঠা।
১১। আহসানুত তাকাসিম ফি মারিফাতিল আকালিম, পৃষ্ঠা ৩৩৫– আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বিন আহমদ মাকদিসী। দার সাদের, বৈরুত।
১২। আল মুন্তাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম ,১০ম খন্ড, ১২৮ পৃষ্ঠা– ইবনুল জাওযি। দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত।
১৩। উলামায়ে সালাফ, ১০৮, ১০৯ পৃষ্ঠা– হাবিবুর রহমান খান শেরওয়ানি। মুসলিম ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট, আলীগড়, ভারত।
১৪। প্রাগুক্ত, ১১০,১১১ পৃষ্ঠা।
১৫।মুসলমানো কে হার তবকা ও হার পেশাহ মে ইলম ও উলামা, ৮৮ পৃষ্ঠা- কাজি আতহার মোবারকপুরী। শাইখুল হিন্দ একাডেমী দেওবন্দ, ভারত।
১৬। প্রাগুক্ত, ৬০-৬৫ পৃষ্ঠা।
১৭।উলামায়ে সালাফ, ১১২,১১৩ পৃষ্ঠা– হাবিবুর রহমান খান শেরওয়ানি। মুসলিম ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট, আলীগড়, ভারত।
১৮।মুসলমানো কে হার তবকা ও হার পেশাহ মে ইলম ও উলামা, ৬৮ পৃষ্ঠা- কাজি আতহার মোবারকপুরী। শাইখুল হিন্দ একাডেমী দেওবন্দ, ভারত।
১৯। হিন্দুস্তান মে মুসলমানো কা নেজামে তালিম ও তরবিয়ত , ১ম খন্ড, ১৩১ পৃষ্ঠা– সাইয়েদ মানাজির আহসান গিলানী। মাকতাবাতুল হক, মুম্বাই, ভারত।
২০।মুসলমানো কে হার তবকা ও হার পেশাহ মে ইলম ও উলামা, ৮২ পৃষ্ঠা- কাজি আতহার মোবারকপুরী। শাইখুল হিন্দ একাডেমী দেওবন্দ, ভারত।
২১।প্রাগুক্ত, ১০২ পৃষ্ঠা।
২২।প্রাগুক্ত, ১৬ পৃষ্ঠা।
২৩।প্রাগুক্ত, ১৪৫-১৬০ পৃষ্ঠা।
২৪। আন্দালুসের ইতিহাস, ১ম খন্ড, ৪১৫ পৃষ্ঠা, – ড. রাগিব সারজানি। বাংলা অনুবাদ, মাকতাবাতুল হাসান, ঢাকা।
২৫।মুসলমানো কে হার তবকা ও হার পেশাহ মে ইলম ও উলামা, ১৬৮ পৃষ্ঠা- কাজি আতহার মোবারকপুরী। শাইখুল হিন্দ একাডেমী দেওবন্দ, ভারত।
২৬।প্রাগুক্ত, ১৮০ পৃষ্ঠা।
২৭।মনীষীদের কাছে সময়ের মূল্য, ১৫৯ পৃষ্ঠা — শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ। বাংলা অনুবাদ: কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, দারুল আরকাম, ঢাকা।
২৮। প্রাগুক্ত, ৮৩ পৃষ্ঠা।
২৯।প্রাগুক্ত, ১০৭ পৃষ্ঠা।
৩০।মুসলমানো কে হার তবকা ও হার পেশাহ মে ইলম ও উলামা, ১৭-১৯ পৃষ্ঠা- কাজি আতহার মোবারকপুরী। শাইখুল হিন্দ একাডেমী দেওবন্দ, ভারত।