লেখক- শাইখ আবদুল্লাহ নাসিহ উলওয়ান
অনুবাদক- আশিক আরমান নিলয়
সম্পাদনা- সাজিদ ইসলাম
প্রকাশক- সমর্পন প্রকাশন
পৃষ্ঠা- ১৬৮
মুদ্রিত মূল্য- ২৪২ টাকা।
সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী। ইতিহাসের মহানায়ক। মুসলিম উম্মাহর ঘোর অমানিশার কালে সালাহুদ্দিনের আবির্ভাব। মাওদুদ বিন তুনিতকিন, ইমাদুদ্দিন যিংকি ও নুরুদ্দিন যিংকিরা ক্রুসেডারদের মোকাবেলায় যে প্রতিরোধের সূচনা করেছিলেন, সালাহুদ্দিন তা আরো বেগবান করেন। তার হাতেই বাইতুল মুকাদ্দাস পুরনরুদ্ধার হয়।
দুঃখের বিষয়, অনেকদিন পর্যন্ত বাংলা ভাষায় সালাহুদ্দিন আইয়ুবীর নির্ভরযোগ্য জীবনি পাওয়া যেত না। একমাত্র পাঠ্য ছিল আলতামাশের ঐতিহাসিক উপন্যাস ঈমানদীপ্ত দাস্তান। যা ইতিহাস ও কল্পনার মিশেলে রচিত। আট খন্ডে রচিত এই উপন্যাসে তথ্যের পরিমান খুবই কম। তাছাড়া বইটির আলোচনা শুরু হয়েছে ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে। অর্থাৎ সালাহুদ্দিনের জীবনের প্রাথমিক দিনগুলি, মিসর আগমনের প্রেক্ষাপট, ফাতেমীদের বিরুদ্ধে তার পদক্ষেপ এসব নিয়ে আলোচনা নেই। পরের দিনগুলি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা আছে তেমনটাও নয়। একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এক শ্রেনীর পাঠকের ধারণা এসব উপন্যাস পড়ে প্রচুর ইতিহাস জানা যায়, তাই কথাগুলো বলতে হলো।
আশার কথা হলো, সম্প্রতি সালাহুদ্দিন আইয়ুবীর জীবনি সম্পর্কিত কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মাকতাবাতুল ইসলাম থেকে প্রকাশিত হয়েছে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রচিত ‘সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী’। সমর্পন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আব্দুল্লাহ নাসিহ উলওয়ান রচিত ‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী’। আকিক পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হবে সুলতানের ঘনিষ্ঠ সহচর কাজি বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ রচিত ‘ আন নাওয়াদিরুস সুলতানিয়্যা’, কালান্তর থেকে প্রকাশিত হবে, ড. আলী মুহাম্মদ আস সাল্লাবি রচিত ‘সালাহুদ্দিন আইয়ুবী ওয়া জুহুদুহু ফিল কাদাই আলাদ দাওলাতিল ফাতিমিয়্যাহ ওয়া তাহরিরি বাইতিল মাকদিস’। অনুবাদ হওয়া উচিত সুলতানের সমসাময়িক আলেম ইমাদুদ্দিন কাতেব রচিত ‘আল বারকুশ শামি’ ও ‘আন নাফহুল কাসি ফিল ফাতহিল কুদসি’ বই দুটিও।
মূল আলোচনায় আসি। আব্দুল্লাহ নাসিহ উলওয়ান রচিত ‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী’ বইটি সংগ্রহ করেছি গতকাল। বইটি পড়ে মনে হলো বন্ধুদেরকে বইটির কথা না জানালে অন্যায় হবে। বইটি কলেবরে খুবই ছোট। পেপারব্যাক সাইজে মাত্র ১৬৮ পৃষ্ঠা। বইটির যেসব বিশেষত্ব চোখে পড়েছে-
১। বইটিতে ইতিহাসের দীর্ঘ ও খুটিনাটি বর্ননা এড়িয়ে সংক্ষেপে সালাহুদ্দিন আইয়ুবীর জীবনি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে সাধারণ পাঠক পড়ার সময় একঘেয়ে অনুভব করেন না।
২। ইতিহাস লেখার সাথে সাথে এ থেকে অর্জিত শিক্ষা ও তার প্রায়োগিক রুপ পাঠককে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
৩। বইটি রচিত হয়েছে ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীতে উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে। প্রতিটি তথ্যের সাথে তথ্যসূত্র দেয়া আছে। ফলে তথ্যের ব্যাপারেও নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
৪। সালাহুদ্দিনের সাফল্যের কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে এবং আমাদের সময়ের সাথে তার তুলনা করে আমাদের দূর্বলতা তুলে ধরা হয়েছে।
৫। বইটি রচনা করা হয়েছে সত্তরের দশকে। লেখক ফিলিস্তিন সমস্যার প্রতি আলোকপাত করেছেন। ফিলিস্তিনের মুক্তিকামীদের মৌলিক সমস্যাবলীও তিনি তুলে ধরেছেন।
৬। অনুবাদ সাবলিল, পাঠককে ধরে রাখে।
তবে বইটিতে দুটি স্থানে একটু দৃষ্টিকটু লেগেছে।
১। বইয়ের শুরুতে , ১৮ পৃষ্ঠায়, লেখা হয়েছে, ‘সালাহুদ্দীন আইয়ুবির জন্ম এক সম্ভ্রান্ত কুর্দি পরিবারে। এই পরিবারটি মিশর ও শাম (বর্তমান সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিন) শাসন করতো। একে বলা হতো আইয়ুবী সাম্রাজ্য।
এখানে অনুবাদ ঠিকই আছে। (মূল বইতে আছে- هذه العائلة ملكت مصر و الشام و عرفت بالدولة الايوبية )। কিন্তু সমস্যা হলো, আইয়ুবীর জন্মের বর্ননার পরেই লেখা হয়েছে এই পরিবারটি মিশর ও শাম শাসন করতো। যা থেকে মনে হতে পারে, সালাহুদ্দিন আইয়ুবীর আগ থেকেই এই পরিবার মিশর ও শাম শাসন করতো। (মূলত সে সময় মিশর ছিল ফাতেমিদের নিয়ন্ত্রণে। শামে শাসন করছিল যিংকি রাজবংশ। সালাহুদ্দিন আইয়ুবির হাতেই আইয়ুবি সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। সংক্ষেপে আইয়ুবী সাম্রাজ্যের উত্থানের ইতিহাস জানতে দেখুন, ড. ওয়াফা মুহাম্মদ আলি রচিত ‘কিয়ামুদ দাওলাতিল আইয়ুবিয়্যাহ ফি মিসর ওয়াশ শাম’। )
এটাকে ঠিক অনুবাদের ভুল বলা যায় না। তবে এই বাক্য থেকে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে। বাক্যের গঠনটা অন্যরকম হলে সুন্দর হতো।
২। ২১ পৃষ্ঠায় বাআলবেক শহর সম্পর্কে টীকায় লেখা হয়েছে, বাআলবেক বর্তমান লিবিয়ার একটি জেলার নাম। কিন্তু বইতে বর্নিত বাআলবেক শহরটির অবস্থান লেবাননে। এই শহর সম্পর্কে ইয়াকুত হামাভী মুজামুল বুলদানে লিখেছেন,
مدينة قديمة فيها أبنية عجيبة وآثار عظيمة وقصور على أساطين الرّخام لا نظير لها في الدنيا، بينها وبين دمشق ثلاثة أيام وقيل اثنا عشر فرسخا من جهة الساحل
ইতিহাসের আগ্রহী পাঠকের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য বিবেচনা করি। আল্লাহ এর সাথে জড়িত সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিক।