ইতিহাস কী ও কেন? প্রশ্নটা মাথার ভেতর ঘুরঘুর করছিল অনেকদিন থেকেই। ইতিহাস বলতে আমরা বুঝি অতীতের ঘটনাবলীর বিবরণ, রাজাগজাদের কেচ্ছাকাহিনী। কিন্তু ইতিহাস বলতে আসলে কী বোঝায়? ঐতিহাসিকরা ইতিহাস বলতে কী বোঝেন? বিষয়টা ভাবাচ্ছিল। ইতিহাসের সংজ্ঞা জানতে দারস্থ হই ইবনে খালদুনের (১)।
ভেবেছিলাম ইবনে খালদুন ভারিক্কি চালে ভাবগম্ভীর কোনো সংজ্ঞা দিবেন। নাহ, তিনি দেখি সাদাসিধে ভাবেই লিখেছেন, ইতিহাস মূলত অতীতকালের ঘটনাবলী ও রাষ্ট্রসমূহের বিবরণ। (২)
ইবনে খালদুনের সংজ্ঞা পাওয়ার পর আর কোনো সংজ্ঞা না দেখলেও চলে। তবু মনে একটু খুঁতখুঁত তো থেকেই যায়। শরনাপন্ন হলাম ড. হুসাইন মুনিসের। তিনিও বেশ সহজভাবেই লিখেছেন, ইতিহাস হলো ঘটনাবলীর পাঠ মাত্র। (৩)
মোটামুটি আগের কথাটাই এসেছে। এবার একটু ভেতরে যাওয়া যাক। দেখি আর কেউ কিছু বলেছেন কিনা। ইতিহাস নিয়ে আলাপ করতে গেলে আল্লামা সাখাবীকে (৪) সামনে রাখতেই হয়। তিনি একটু বিশদাকারেই লিখেছেন, ইতিহাস আলোচনা করে রাজ্যসমূহ নিয়ে, খলিফা ও উযিরদের নিয়ে, যুদ্ধ ও রাজ্যবিজয় নিয়ে। এর বাইরে ইতিহাস আলোচনা করে নবীদের ঘটনাবলী নিয়ে, এবং অতীতের জাতীসমূহের ঘটনাবলী নিয়ে। ইতিহাসের আলোচনায় উঠে আসে মসজিদ, মাদরাসা, সড়ক ও পুল নির্মানের বিবরন, বাদ পড়ে না দূর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের বিবরনও। (৫)
ইতিহাসের প্রচলিত সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে সংজ্ঞা দিয়েছেন সাইয়েদ কুতুব (৬)। তিনি লিখেছেন, ইতিহাস নিছক ঘটনাবলীর বিবরণের নাম নয়। বরং ইতিহাস হলো, এসব ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নাম। বিক্ষিপ্ত ঘটনাবলীর মধ্যে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিণ যোগসূত্র আবিষ্কার করার নামই ইতিহাস। (৭)
সাইয়েদ কুতুবের এই সংজ্ঞার সাথে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ আছে। তবে ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়া নিছক ঘটনাবলীর বিবরণ পাঠ কখনো ইতিহাসের পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে পারে না। ইতিহাসের নানা ঘটনাবলীর মধ্যে যোগসুত্র আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হলে ঘটনাপ্রবাহের পরিবর্তন অনুমান করা হয়ে উঠে কষ্টসাধ্য। ইতিহাসের ঘটনাবলী পারস্পরিক যোগসূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে কীভাবে ঘটনাপ্রবাহের পটপরিবর্তনের ধারনা পাওয়া যায় এ সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে।
ইতিহাসের সাথে প্রাথমিক পরিচয়ের পর ইতিহাসচর্চার প্রয়োজনীয়তা জানা দরকার। ইতিহাস কি নিছক কিছু ঘটনাবলীর সমষ্টি, যা কেবল বিনোদনের উদ্দেশ্যেই পাঠ করা হবে। নাকি এর অন্য কোনো উদ্দেশ্যও আছে। ঐতিহাসিক ইবনুল আসির (৮) এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, আমি দেখেছি অনেকেই মনে করে ইতিহাস মানে কিছু গল্প ও ঘটনার সমষ্টি। কিন্তু আল্লাহ যাকে সুস্থ অন্তর ও মস্তিষ্ক দান করেছেন এবং সিরাতে মুস্তাকিমের সন্ধান দিয়েছেন , তিনি জানেন এর পার্থিব ও পারলৌকিক উপকারিতা অনেক। (৯)
ইবনুল জাওযির (১০) কলমে উঠে এসেছে ইতিহাসপাঠের গুরুত্ব। তিনি লিখেছেন, ইতিহাস পাঠে দুধরনের উপকারিতা আছে। প্রথমত, যখন আপনি বিচক্ষণদের জীবন চরিত অধ্যয়ন করবেন তখন আপনিও সুন্দর চিন্তা ও বিচক্ষনতার প্রয়োগ সম্পর্কে অবগত হবেন। আবার সীমালঙ্ঘনকারীদের জীবন চরিত ও তাদের শেষ পরিনতি পাঠ করে উদ্ধতরাও সংযত হয়ে উঠে। একইসাথে বুদ্ধির তরবারী হয়ে উঠে ধারালো। দ্বিতীয়ত, ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে নানা আশ্চর্য বিষয় ও যুগের পটপরিবর্তন জানা যায়, জানা যায় ভাগ্যের উত্থান পতন, যা পাঠ করে মন হয়ে উঠে প্রশান্ত।
আবু আমর বিন আলা একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কি মরতে চান? বৃদ্ধ বললেন, না। আবু আমর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জন্য দুনিয়ার কোন স্বাদ আর অবশিষ্ট আছে? বৃদ্ধ বললেন, আমি আশ্চর্য সব বিষয়ে শুনতে পছন্দ করি। (১১)
ঐতিহাসিক মাসউদি (১২) তো সরাসরি বলেই বসেছেন, ইতিহাস এমন এক শাস্ত্র যা দ্বারা জ্ঞানী ও মূর্খ দুদলই উপকৃত হতে পারে। এর দ্বারা বুদ্ধিমান ও নির্বোধ দুদলই তৃপ্ত হয়। (১৩)
আল্লামা সাখাবী বলেন, ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কারন তিনি সৎ কর্মশীলদের এর বিনিময় দান করেন। নিয়তের মাধ্যমে আমলের ফলাফল নির্ধারিত হয়। (১৪)
ড. আলী মুহাম্মদ আস সাল্লাবী লিখেছেন, মুসলমানদের জন্য আবশ্যক হলো তারা ইতিহাস পাঠ করবে। বিশেষ করে তারা সীরাতে নববী ও খোলাফায়ে রাশেদিনদের ইতিহাস পাঠ করবে। মুসলমানদের জিহাদসমূহের বিবরণ পাঠ করবে। পূর্বসূরী উলামায়ে কেরাম ও মুজাহিদদের জীবনি পাঠ করবে। এরপর সেই ইতিহাস আকর্ষনীয় পদ্ধতিতে এ যুগের মানুষের সামনে উপস্থাপন করবে। এভাবেই উম্মাহ আবারও ফিরে পাবে সঞ্জিবনী শক্তি, যুহদ ফিদ দুনিয়া ও কিতাল ফি সাবিলিল্লাহর দৃঢ় প্রত্যয়। (১৫)
পরবর্তী পর্বে ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনিয়তা সম্পর্কে প্রায়োগিক আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ। তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইতিহাস পাঠের পূর্বে আকিদাহর জ্ঞান রাখা আবশ্যক। আকিদাহর বিশুদ্ধ জ্ঞান না থাকলে একজন মুসলিম ইতিহাসের ঘটনাবলীর মধ্যে তফাত করতে পারবেন না। তিনি যুদ্ধ ও জিহাদকে আলাদা করতে পারবেন না। খিলাফাহ ও সাম্রাজ্যকেও তার মনে হবে একই জিনিস। তার মনে হবে সম্রাট আকবর একজন উদারমনা মহান সম্রাট, যিনি কিনা সব ধর্মকেই একসাথে মিলেমিশে থাকার সুযোগ দিচ্ছেন। আকিদাহর বিশুদ্ধ জ্ঞান না থাকলে উসমানি সুলতান প্রথম আব্দুল মাজিদকে মনে হবে যুগ সচেতন একজন সুলতান, যিনি কিনা উসমানি সাম্রাজ্যে ফ্রান্সের সংকলিত দন্ডবিধি প্রচলন করেন। ব্যাভিচার ও চুরির শরয়ী দন্ডবিধিকে বাতিল করে দেন। (১৬)
মূলত আকিদাহ একজন মুসলিমের জন্য সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিছক ইতিহাস পাঠের সাথে সম্পৃক্ত, বিষয়টি মোটেও এমন নয়। এখানে যেহেতু আমরা ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করছি তাই এখানে ইতিহাসের সাথে আকিদাহর সম্পর্কের কথা আসলো। নইলে আকিদা একজন মুসলিমের জন্য সবসময়ই প্রথম আবশ্যক।
টীকা
—————————
১। পুরো নাম আবু জায়েদ আবদুর রহমান বিন মুহাম্মদ বিন খালদুন আল হাদরামি । জন্ম মে ২৭, ১৩৩২ খ্রিষ্টাব্দ /৭৩২ হিজরি । মৃত্যু ১৯ মার্চ, ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ/৮০৮ হিজরি)। তিনি ছিলেন একজন আরব মুসলিম পন্ডিত। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাসের জনকদের মধ্যে তাকে অন্যতম বিবেচনা করা হয়। কিতাবুল ইবার তার লিখিত বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ।
২। আল মুকাদ্দিমা, ১ম খন্ড, ৮১ পৃষ্ঠা– আব্দুর রহমান ইবনে খালদুন। দার ইয়ারুব।
৩। আত তারিখ ওয়াল মুআররিখুন, ২৩ পৃষ্ঠা–ড হুসাইন মুনিস। দারুর রাশাদ।
৪। পুরো নাম শামসুদ্দিন আবুল খাইর মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মদ বিন আবু বকর বিন উসমান বিন মুহাম্মদ আস সাখাবী। জন্ম মিসরে , ৮৩১ হিজরীতে (১৪২৭ খ্রিস্টাব্দ)। মৃত্যু ৯০২ হিজরীতে, ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানির ছাত্র। হাদিসশাস্ত্রে তার দক্ষতা সর্বজনবিদিত। ইতিহাস বিষয়ে তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো, আদদাউ আল্লামি ফি আইয়ানিল করনিত তাসি।
৫। আল ইলান বিত তাওবিখ, ১৮ পৃষ্ঠা– আল্লামা সাখাবী। মুআসসাতুর রিসালাহ।
৬। সাইয়েদ কুতুবের জন্ম ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে, মিসরে। তাফসির ফি যিলালিল কুরআন তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ইখওয়ানুল মুসলিমিনের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তাকে ফাসি দেয়া হয়।
৭। ফিত তারিখি ফিকরাতুন ওয়া মিনহাজুন, ৩৭ পৃষ্ঠা– সাইয়েদ কুতুব।
৮। মূল নাম ইযযুদ্দিন আবুল হাসান আল জাযারি। জন্ম ইরাকের মোসুলে, ১১৬০ খ্রিস্টাব্দে। আরব ঐতিহাসিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আল কামিল ফিত তারিখ, আত তারিখুল বাহির ফিদ দাওলাতিল আতাবিকিয়্যাহ তার উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ। ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
৯। আল কামিল ফিত তারিখ, ১ম খন্ড, ৯ পৃষ্ঠা– ইবনুল আসির। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত।
১০। জন্ম বাগদাদে, ১১১৬ খ্রিস্টাব্দে। হাদিস, তাফসির, ফিকহ, ইতিহাস ইত্যাদী শাস্ত্রে তার দক্ষতা সর্বজনবিদিত। ওয়ায়েজ হিসেবেও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে তিনি ইন্তেকাল করেন।
১১। আল মুন্তাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম, ১ম খন্ড, ১১৭ পৃষ্ঠা– ইবনুল জাওযি। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত।
১২। ঐতিহাসিক মাসউদির জন্ম ৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে, বাগদাদে। একজন ভূগোলবিদ ও ঐতিহাসিক হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধ। মুরুজুয যাহাব তার বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ। তবে এই গ্রন্থে তিনি প্রচুর বানোয়াট ঘটনাও উল্লেখ করেছেন। ইবনে খালদুন আল মুকাদ্দিমায় এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। মাসউদি ৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে ইন্তেকাল করেন।
১৩। মুরুজুয যাহাব, ১ম খন্ড, ৪ পৃষ্ঠা– মাসউদি। আল মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ, বৈরুত।
১৪। আল ইলান বিত তাওবিখ, ৮১ পৃষ্ঠা– আল্লামা সাখাবী।
১৫। সফাহাতুন মুশরিকাতুম মিনাত তারিখিল ইসলামি, ১ম খন্ড, ২০ পৃষ্ঠা– ড আলি মুহাম্মদ আস সাল্লাবী। দার ইবনুল জাওযি, কায়রো।
১৬। বিস্তারিত জানতে দেখুন ড. ওমর সুলাইমান আশকার রচিত আশ শরিয়াতুল ইলাহিয়্যাহ লাল কা ওয়ানিনুল জাহিলিয়্যাহ।