১
২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯০ । জং, পাকিস্তান। রাত ৮টা।
কাউকে হত্যা করার জন্য রাতের অন্ধকারই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। রিভলবার হাতে চার আততায়ী অপেক্ষা করছে মোক্ষম সময়ের। তারা দাঁড়িয়ে আছে একজন মাওলানার ঘরের সামনে। মহল্লার একজনের বিয়েতে শরিক হওয়ার জন্য মাওলানা ঘর থেকে বের হবেন। আর তখনই হামলা চালানো হবে।
৮ টা পনেরো মিনিট।
৩৮ বছর বয়স্ক মাওলানা ঘর থেকে বের হলেন। তার স্ত্রী দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন তাকে। স্ত্রীকে সালাম জানিয়ে হাঁটা শুরু করলেন তিনি। স্ত্রী দরজা আটকে ঘরে ফিরে গেলেন। মাওলানা সাহেব সামনে এগুলেন। কয়েক কদম সামনে এগুতেই চার খুনি একযোগে গুলি শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি বুকে, মাথায় ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তার শরিরের চারপাশে রক্ত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আরো কয়েক রাউন্ড গুলি করে খুনিরা দ্রুত সরে পড়ে।
–
এক ঘন্টা পর পৃথিবীর আরেক প্রান্তে ম্যানচেস্টার ইসলামিক একাডেমির অফিসের ফোন বেজে উঠে। মাওলানা জিয়াউল কাসেমি এগিয়ে এসে ফোন রিসিভ করেন।
‘আমরা এতিম হয়ে গেলাম। মাওলানা হক নেওয়াজ জংভী শহিদ হয়ে গেছেন’ ফোনের ওপাশে কেউ একজন বলে উঠে। মাওলানা জিয়াউল কাসেমির রিসিভার ধরা হাত অবশ হয়ে যায়। তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান।
২
মাওলানা হক নেওয়াজ জংভীর আলোচনায় পরে আসবো। আপাতত আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই।
১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারীতে সংঘঠিত ইরানি বিপ্লবের ফলে শিয়াদের মধ্যে নতুন এক জাগরণ সৃষ্টি হয়। ফেব্রুয়ারীতে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ফ্রান্স থেকে ফিরে আসেন। তাকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইরানি বিপ্লবের ঢেউ লাগে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র পাকিস্তানেও। সেখানকার শিয়ারা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। তারা দাবী তোলে পাকিস্তানের আদালতে শিয়াদের জাফরি ফিকহ চালু করতে হবে। এ সময় শিয়াদের লেখা বইপত্র জোরেশোরে প্রচার করা হয়। এসবের বেশিরভাগ ছিল ইরান থেকে প্রকাশিত। এসব বইয়ের বিষয়বস্তু ছিল প্রচন্ড আপত্তিকর। প্রায় প্রতিটি বইতেই প্রথম তিন খলিফা ও উম্মুল মুমিনিন আয়শা সিদ্দিকা (রা) কে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয়া হয়েছিল। তাদের চরিত্রের উপর কালিমা লেপনের চেষ্টা ছিল। দুই একজন বাদে প্রায় সকল সাহাবাকে কাফের বলা হয়েছিল কয়েকটি বইতেই। পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম শুরু থেকেই এসব বইপত্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। তারা এসব বইপত্র নিষিদ্ধের আহ্বান জানান। কিন্তু প্রশাসন শিয়াদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে উলামায়ে কেরামের উপর মামলা ও নির্যাতন চালাতে থাকে।
প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে শিয়াদের মজবুত অবস্থান ছিল। ফলে উলামায়ে কেরাম ছিলেন কার্যত অসহায়। শিয়াদের এসব কাজের বিরোধিতা করার কারনে মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকিকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে ইরানী গোয়েন্দাদের যাতায়াত ছিল। তারা স্থানীয় শিয়াদের অস্ত্র সরবরাহ করতো। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের জুনে কোয়েটাতে শিয়াদের হামলায় ৪৪ জন পুলিশসহ মোট ৭৬ জন নিহত হয়। বিবিসিতে নিউজ করা হয়, একজন ইরানির লাশ পাওয়া গেছে। তার পকেটে পাসদারানে ইনকিলাবের (ইসলামিক রেভুলেশনারি গার্ড ক্রপস) সদস্যপদ ছিল। প্রশাসন তৎক্ষণাৎ কোয়েটার বাজার থেকে সন্দেহভাজন ২৩১ জন ইরানি নাগরিককে গ্রেফতার করলেও পরে তাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়ে ইরান পাঠিয়ে দেয়। এই হত্যাকান্ডের তদন্তও আর আগাতে পারেনি।
এক অস্থির সময় পার হচ্ছিল তখন। একদিকে প্রকাশ্যে সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মুল মুমিনিনকে গালি দেয়া হচ্ছে, আবার এর প্রতিবাদ করলে প্রশাসন খড়গহস্ত হচ্ছে। এই সময়ে দরকার ছিল একজন রাহবারের, যিনি শিয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিবেন, যিনি কারো পরোয়া না করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন, সর্বোপরি যিনি সাহাবায়ে কেরামের আযমতের কথা আলোচনা করে আহলুস সুন্নাহর অন্তরগুলোকে প্রশান্ত করবেন। সবাই অপেক্ষায় ছিল এমন এক নেতৃত্বের, কিন্তু কারোই জানা ছিল না কে হবেন তিনি।
জং এর এক তরুণ মাওলানা, হক নেওয়াজ জংভীই ছিলেন সেই রাহবার, যিনি এগিয়ে এসেছিলেন এক ক্রান্তিলগ্নে। শত জুলুম-নির্যাতনও তাকে টলাতে পারেনি, শিয়াদের বিরুদ্ধে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন জুলকারনাইনের প্রাচীরের মত দৃঢ়তা নিয়ে, দৃঢ় কন্ঠে তিনি বলতেন, টানা বিশ বছর শিয়াদের নিয়ে পড়াশোনা করে কথা বলতে এসেছি আমি, অবশেষে জং এর রাস্তায় পড়ে থাকা তার নিথর দেহ সাক্ষ্য দিচ্ছিল আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা বাস্তবায়নের।
৩
আশির দশকের শুরুতে মাওলানা হক নেওয়াজ জংভী পরিচিত ছিলেন একজন তরুণ আলোচক হিসেবে। এসময় তিনি বিভিন্ন জলসায় উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখতেন। শিয়া মতবাদের অসারতা নিয়ে কথা বলতেন। শিয়াদের ক্রমবর্ধমান অপতৎপরতা নিয়ে তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। তিনি দেখছিলেন, আলেমরা সাধ্যমত প্রতিবাদ করছেন কিন্তু এই প্রতিবাদের কোনো প্লাটফর্ম নেই, ফলে কথাগুলো সবার কানে যাচ্ছে না। প্রকাশ্যে সাহাবায়ে কেরামের সম্মানে আঘাত করা হচ্ছে কিন্তু এর জোরালো প্রতিবাদ করা যাচ্ছে না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম তৈরী করতে হবে। এই চিন্তা থেকেই ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিপাহে সাহাবা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে নিজের এক বন্ধুকে বলেছিলেন তিনি, ‘আমি দেখলাম পাকিস্তানের মাটিতে আমার মাকে গালি দেয়ার সাহস কারো নেই, অন্য কারো মাকে গালি দেয়ার সাহসও পায় না কেউ, কিন্তু উম্মাহাতুল মুমিনিনদেরকে প্রকাশ্যে গালি দেয়া হচ্ছে, তাদের সম্মানে আঘাত করা হচ্ছে অথচ সবাই চুপ। কেউ কিছু বলছে না। আমার ঈমান আমাকে আর চুপ থাকার অনুমতি দিল না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে এর বিরুদ্ধে লড়তেই হবে। বিনিময়ে আমাকে জান দিতে হলে তাতেও প্রস্তুত আমি’।
–
মাওলানা হক নেওয়াজ জংভী যখন সিপাহে সাহাবা প্রতিষ্ঠা করেন, তিনি ছিলেন একা। তার পেছনে কোনো রাজনৈতিক শক্তি ছিল না, কারো ছত্রছায়ায় থেকে এই সংঘঠন প্রতিষ্ঠা করেননি তিনি। সিপাহে সাহাবা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছিল দুটি। প্রথমত, সাহাবায়ে কেরামের সম্মান ও মর্যাদা মানুষের সামনে তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত, শিয়াদের কুফর মানুষের সামনে স্পষ্ট করার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা।
৪
১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে সিপাহে সাহাবার আয়োজনে প্রথম দিফায়ে সাহাবা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল সিপাহে সাহাবার প্রথম প্রকাশ্য সমাবেশ। মাওলানা জিয়াউল কাসেমি, মাওলানা আবদুস সাত্তার তিউনেসির মত বরেণ্য আলেমরা এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সকাল থেকেই সম্মেলনস্থলে লোকজন আসতে থাকে। জুমার পর সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আচমকাই পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। সম্মেলনে আগত প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকির মুক্তির দাবীতে রোড ব্লক করে দেয়। মাওলানা ফারুকি এর তিনদিন আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং তখন তিনি চিনিউট কারাগারে অবস্থান করছিলেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দফায় দফায় আলোচনা করেও কোনো সমাধান করতে না পারায় রাত এগারোটার দিকে মাওলানা ফারুকিকে মুক্তি দেয়া হয়। প্রশাসনের গাড়িতে করে ৯০ কিলোমিটার দূর থেকে মাওলানা ফারুকিকে সম্মেলনস্থলে পৌছে দেয়া হয়।পুরো ময়দান নারায়ে তাকবির ধবনীতে কেঁপে উঠে। হাজারো জনতে সানন্দে খোশ আমদেদ জানাতে থাকে। বরেণ্য আলেম ও স্কলাররা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। মাওলানা জংগভী এগিয়ে এসে মাওলানা ফারুকিকে অভ্যর্থনা জানান। পুরো সমাবেশ নিজেদের দাবি পূরন হওয়ার আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে।
রাত সোয়া দুইটার দিকে মাওলানা ফারুকি মঞ্চে উঠেন। এ সময় তিনি স্পষ্ট কন্ঠে বলেন, ‘আজ থেকে আমি সিপাহে সাহাবার সকল কার্যক্রমের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করছি। আমৃত্যু আমি সাহাবায়ে কেরামের সম্মান রক্ষায় কাজ করে যাব’।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে মাওলানা ফারুকি আনুষ্ঠানিকভাবে সিপাহে সাহাবাতে যোগ দেন। এর আগ পর্যন্ত তিনি এই দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না।
–
সিপাহে সাহাবার সৌভাগ্য, শুরু থেকেই একদল সাহসী ও মেধাবী আলেম এই দলের সাথে যুক্ত হয়ে যান। মাওলানা আজম তারিক, মাওলানা ইসারুল কাসেমি, মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকি, মাওলানা আলি শের হায়দারি প্রমুখ ছিলেন একাধারে সুবক্তা ও দক্ষ সংঘঠক।
সিপাহে সাহাবার উদ্যোগে সারা দেশে একের পর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এসব সমাবেশে বক্তারা দালিলিকভাবে সাহাবায়ে কেরামের সম্মান ও মর্যাদা আলোচনা করতেন। একইসাথে শিয়াদের বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে তাদের কুফর ও তাহরিফের নমুনা দেখাতেন। তারা দাবী জানাতেন শিয়াদের বইপত্র নিষিদ্ধ করা হোক। তাদেরকে কাফির ঘোষণা করা হোক।
–
শিয়াদের বিরুদ্ধে চৌদ্ধশত বছর ধরেই আলেমরা কাজ করে গেছেন। ইবনে তাইমিয়া থেকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী সবাই তাদের মতবাদ সম্পর্কে লিখেছেন। সিপাহে সাহাবা প্রতিষ্ঠার সত্তর বছর আগেও মাওলানা আবদুশ শাকুর লখনভী শিয়াদের নিয়ে বিস্তৃত কাজ করে গেছেন। সিপাহে সাহাবা শিয়াদের বিরুদ্ধে নতুন কোনো ফতোয়া চালু করেনি, তারা কেবল আগের উলামাদের বক্তব্যগুলোই প্রচার করেছে। পাশাপাশি শিয়াদের বইপত্র থেকে তাদের কুফরের বিষয়টি প্রমাণ করেছেন।
সিপাহে সাহাবার সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, তারা শিয়াদের কুফরের বিষয়গুলো সহজ ভাষায় জনসাধারণের কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এতদিন যা ছিল জ্ঞানতাত্ত্বিকতার জগতে সীমাবদ্ধ, তা তারা নিয়ে আসেন খোলা ময়দানের আলোচনায়। একইসাথে তারা বয়ান ও আলোচনার জগতে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। এর আগে বেশিরভাগ ওয়াজ মাহফিলে আলোচনার ধাঁচ ছিল সুরেলা ও গল্প-কাহিনী নির্ভর। তারা এ থেকে বের হয়ে আসেন। সিপাহে সাহাবার কল্যাণে মানুষ শুনলো মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকির আলোচনা। একটানা দাঁড়িয়ে আলোচনা করে যাচ্ছেন, কখনো এডওয়ার্ড গিবনের ‘দ্য ডিক্লাইন এন্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’ থেকে রেফারেন্স টানছেন, আবার কখনো দলিল দিচ্ছেন তারিখে ইবনে আসাকির থেকে, এ ছিল এক মুগ্ধকর দৃশ্য। । সিপাহে সাহাবার কল্যাণে বিকশিত হলেন মাওলানা আযম তারিকের মত তুখোড় বক্তা। পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশ ও ভারতেও তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
এতদিন পর্যন্ত উলামায়ে কেরাম শিয়াদের অভিযোগের জবাব দিতেই ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সিপাহে সাহাবা অভিযোগের জবাব দেয়ার বদলে পালটা আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিল। এতদিন যা ছিল রক্ষণাত্মক প্রতিরোধ, তাকে তারা পরিণত করলো আক্রমণাত্মক লড়াইয়ে।
৫
মাওলানা হক নেওয়াজ জংভীর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে ডক্টর আল্লামা খালেদ মাহমুদ যথার্থই বলেছেন, ‘চৌদ্দশ বছর ধরে শিয়ারা সাহাবায়ে কেরামকে বিচারের কাঠগড়ায় বসিয়ে একের পর এক অভিযোগ তুলে যেত। আহলুস সুন্নাহর আলেমরা এসব অভিযোগের জবাব দিতেন। কিন্তু মাওলানা হক নেওয়াজ জংভী এসে এই ধারা বদলে দিলেন। তিনি শিয়াদেরকেই বিচারের কাঠগড়ায় তুলে দিলেন। সরাসরি অভিযোগ তুললেন তাদের ঈমান নিয়ে। তিনি বললেন, আবু বকরের (রা) আলোচনায় পরে আসো, আগে তোমরা নিজেদেরকে মুসলমান প্রমাণ করো। সাহাবায়ে কেয়ারমের ঈমান নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে নিজেরদের ঈমানের প্রমাণ দাও। তার এই আক্রমণের সামনে শিয়ারা ছিল অসহায়। এবার তারা অভিযোগ তোলার বদলে নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে ব্যস্ত হয়ে গেল’।
–
মাওলানা হক নেওয়াজ জংভীর এই মিশন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একইসাথে এর কর্মীদেরকে প্রচুর ত্যাগ ও কোরবানির মুখোমুখি হতে হয়। একদিকে ইরানের চাপ অন্যদিকে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা শিয়া কর্মকর্তা, এই দুয়ে মিলে সিপাহে সাহাবার কর্মিদের নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। ১৯৯৬ সালে, সিপাহে সাহাবা প্রতিষ্ঠার এগারোতম বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারী বাহিনী ও শিয়াদের হাতে নিহত সিপাহে সাহাবার কর্মীর সংখ্যা প্রায় পৌনে চারশো। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আহত হয়েছেন প্রায় ৭ হাজার কর্মী। তাদের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয়েছে এগারো হাজার। কারাবরণ করেছেন ১৪ হাজার কর্মী। এর প্রতিষ্ঠাতা হক নেওয়াজ জংভীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল ৩০০ । এর মধ্যে তিনটি ছিল খুনের মামলা।
–
প্রশাসন ও শিয়ারা মাওলানা জংভীর কন্ঠরুদ্ধ করার সকল চেষ্টাই চালাচ্ছিল। বিভিন্ন জেলায় তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। অপরদিকে একের পর এক মামলা চাপানো শুরু হয়। কিন্তু মাওলানা জংভী এসবের বিন্দুমাত্র পরোয়া করতেন না। তিনি বারবার বলতেন, যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে সাহাবাদের সম্মানের কথা বলেই যাব।
–
মাওলানা জিয়াউল কাসেমি লিখেছেন, সেবার ভাওয়ালপুর জেলার আহমাদপুরে মাওলানা জংভীকে নিষিদ্ধ করা হয়। সেখানে আগ থেকেই আমাদের অনুষ্ঠান ছিল। প্রশাসন কোনোভাবেই মাওলানাকে যেতে দিবে না। নির্দিষ্ট দিনে মাওলানা ঠিকই ছদ্মবেশে শহরে প্রবেশ করলেন এবং মঞ্চে উপস্থিত হয়ে বয়ান শুরু করলেন। তিনি বয়ান শুরু করতেই শ্রোতাদের মধ্যে ‘তালাক হয়ে গেছে, তালাক হয়ে গেছে’ বলে হৈচৈ শুরু হলো। মাওলানা বয়ান থামিয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তখন জানা গেল, এলাকার এক পেশাদার বক্তা কয়েকদিন বলেছিল, হক নেওয়াজ এই এলাকায় আসার সাহস নেই। যদি সে আসতে পারে তাহলে আমার স্ত্রী তালাক’। এই ঘটনা অনেকের জানা ছিল। তাই মাওলানা বয়ান শুরু করতেই তারা এটা বলতে থাকে।
৬
মাওলানা জংভী একাধিকবার কারাবরণ করেন। প্রতিবার তাকে প্রচন্ড নির্যাতন করা হয়। একবার রাত দুটো বাজে পুলিশ তার ঘরে হানা দেয়। ঘরেই তাকে প্রচন্ড মারধোর করা হয়। তারপর তাকে মিয়ানওয়ালি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এই কারাগার ছিল পুরো পাকিস্তানের সবচেয়ে ভয়ংকর কারাগার। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই কারাগার ছিল কুখ্যাত। ইতিপূর্বে আতাউল্লাহ শাহ বুখারি, মুফতি কেফায়েতুল্লাহ দেহলভী, মাওলানা যফর আলি খান, মাওলানা আহমাদ আলি লাহোরি, আগা সুরেশ কাশ্মিরী প্রমুখকে এখানেই কারাবন্দী করা হয়েছিল। গাজি ইলমুদ্দিন এখানে বন্দি ছিলেন এবং এখানেই তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, যখন মাওলানা জংভীকে কারাগারে প্রবেশ করানো হয় তখন তার শরীরে কোনো কাপড়ই ছিল না। পুরো শরিরে ছিল রক্তাক্ত। মারের কারণে তার হাত ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গা হাত শরিরের সাথে লটকে ছিল। একজন কারা কর্মকর্তার মনে দয়ার উদ্রেক হলে তিনি মাওলানাকে ছোট একটি কাপড় দেন। মাওলানা জংভী তা পরে কোনোভাবে সতরের হেফাজত করেন। এ সময় তাকে প্রায় আট মাস কারাবাস করতে হয়। তাকে ছোট একটি কুঠুরিতে বন্দি করা হয়। যেখানে গরম ও শীত থেকে বাঁচার কোনো উপায়ই ছিল না। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ওই কুঠুরিতে সারতে হত, আবার সেখানেই থাকতে হত। মাওলানা জংভী এতে বিন্দুমাত্র মনোবল হারাননি। তিনি কারাগারে বসেই শিয়াদের নতুন প্রকাশিত বইপত্র সংগ্রহ করতে থাকেন, এবং এসব বইয়ের উপর নোট করতে থাকেন। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি দ্বিগুন উৎসাহে আবারও শিয়াদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে থাকেন।
–
মাওলানা জংভীর বয়ানের ভাষা শুনে মনে হতো তিনি খুবই কঠোর স্বভাবের মানুষ। তবে তার এই কঠোরতা ছিল কুফরের ক্ষেত্রে। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন খুবই নরম মেজাজের মানুষ। একবার এক কর্মচারী তাকে বলে, আপনার হাতের ঘড়িটি সুন্দর। আমিও যদি এমন একটা পেতাম। কয়েকদিন পর সেই কর্মচারীর সাথে দেখা হলে তিনি মাফ চেয়ে বলেন, আমার ঘড়িটি আনতে মনে নেই। তখনই তিনি একজনকে পাঠিয়ে একটি নতুন ঘড়ি কিনে আনান, এবং কর্মচারীকে তা উপহার দেন।
–
মাওলানা জংভীকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তাদের ভাষ্য হলো, তার মাথায় সবসময় সাহাবায়ে কেরামের সম্মান রক্ষার বিষয়টিই ঘুরতো। এছাড়া আর কোনো চিন্তা ছিল না তার। এই এক মিশন নিয়েই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন সর্বত্র। গ্রেফতার হয়েছেন, ১৪৪ ধারার মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু পিছপা হননি একটুও, সরে আসেননি নিজের অবস্থান থেকেও। মাওলানা জংভীর তিন সন্তান ছিলেন। তিনজনের জন্মের সময়ই মাওলানা জংভী ছিলেন কারাগারে। শিয়া নেতা সরদার যফর আব্বাস ঘোষণা করেছিল, মাওলানা জংভীর মাথা এনে দিলে ৬ লাখ রুপি ও দুই টুকরো জমি উপহার দেয়া হবে। তবুও মাওলানা জংভী বিন্দুমাত্র আতংকিত হননি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে সর্বশেষ জুমার বয়ানে তিনি বলেছিলেন, জীবন আর মৃত্যু আমার কাছে এক সমান। কোনো ভয় দেখিয়ে আমাকে এই পথ থেকে সরানো যাবে না।
৭
মাওলানা হক নেওয়াজ জংভী ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে জং জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা নিজের এলাকায় সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জামিয়া খাইরুল মাদারিস মুলতান থেকে দাওরা হাদিস সমাপ্ত করেন। মাওলানা হক নেওয়াজ জংভী মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারান। তিনি ছিলেন আলেমদের স্নেহধন্য। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারীদের চোখের মনি। তার মৃত্যুর সাথে সাথে প্রশাসন কারফিউ জারি করে। সামরিক বাহিনী শহরে প্রবেশের পথগুলো আটকে দেয়। প্রশাসন চাচ্ছিল জানাযায় বেশি মানুষের উপস্থিতি না হোক। কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় এক লাখ মানুষ উপস্থিত হয়ে যায়। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে মাওলানা আযম তারিক, মুহাম্মদ মক্কি সবাই চলে আসেন।
মাওলানা মুহাম্মদ মক্কি স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘আমি পৌঁছে দেখি মাওলানার কাফনে মোড়ানো লাশ একটা চৌকির উপর রাখা। আমি এগিয়ে গেলাম। কাফনের মুখ খুলে তার চেহারার দিকে তাকালাম। বুকের ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। আমার মনে পড়লো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর আবু বকর সিদ্দিক (রা) এসে নবিজিকে দেখে চুমো দিয়েছিলেন (এই মর্মে সহীহ বুখারীতে হাদিস এসেছে)। আমার মনে পড়লো, মাওলানা জংভী সারাজীবন সাহাবায়ে কেরামকে ভালোবেসেছেন। তাদের সম্মানেই জীবন দিয়েছেন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও হজরত আবু বকরের অনুসরণ করব। আমি মাওলানার চেহারায় চুমু দিলাম। তারপর আবার কাফনের কাপড়ে চেহারা ঢেকে দিলাম’।
মাওলানা আযম তারিক সব ভীড় থেকে দূরে চলে যান। মাওলানা জংভীর জন্য সদ্য খোঁড়া কবরের পাশে সুরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করতে থাকেন।
মাওলানার জানাযার ইমামতি করেন হাফেজুল হাদিস শায়খ আবদুল্লাহ দরখাস্তি।
–
জানাযার পর মাওলানা জংভীকে গুলশানে জংভী শহিদ চত্বরে দাফন করা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে মাওলানা জংভীর কবরের পাশে গড়ে উঠেছে আরো অনেকগুলো কবর। তার পাশেই দাফন করা হয়েছে তার সহযোদ্ধা মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকি, মাওলানা ইসারুল কাসেমি, মাওলানা মুখতার আহমদ, ইজহারুল হক ও মাওলানা আযম তারিককে। তারা প্রত্যেকেই সাহাবায়ে কেরামের সম্মানের কথা বলতে গিয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন।
মাওলানা জংভীর শাহাদাতের মাধ্যমে কোরবানির যে সিলসিলার শুরু পরবর্তী দিনগুলোতে তা আরো দীর্ঘ হয়েছিল।
সূত্র
———
১। মাওলানা হক নেওয়াজ শহিদ- মাওলানা জিয়াউল কাসেমি।
২। মেরা জুরম কিয়া হ্যায়- মাওলানা আযম তারিক।
৩। তারিখে আযিমত, ১ম খন্ড – আবু উসামা মাহমুদ।
৪। ফির ওহি কাইদে কাফাস- জিয়াউর রহমান ফারুকি।