বাগ নিলাব। পাঞ্জাবের আটক জেলার ছোট একটি গ্রাম। সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থিত এই গ্রাম স্থানীয় পর্যটকদের কাছে একটি দর্শনীয় স্থান। পুরো এলাকাটি সবুজ শ্যামল। বিস্তৃর্ণ মাঠ। স্থানীয় কিশোররা এখানে প্রায়ই ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলে। কিন্তু তাদের অনেকের জানা নেই, আটশো বছর আগে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারেজম শাহ।
বাগ নিলাব বরাবর সিন্ধু নদীর অপরপ্রান্তে , ৬১৮ হিজরীর ৬ শাউয়ালে (২৪ নভেম্বর, ১২২১ খ্রিস্টাব্দ) চেঙ্গিজ খানের মুখোমুখি হন সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারেজম শাহ। সুলতান গজনী থেকে ভারতবর্ষের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। ইচ্ছা ছিল সুলতান শামসুদ্দিন আলতামাশের সাহায্য নিয়ে নতুন করে বাহিনী গড়ে তুলবেন। পিছু ধাওয়া করছিল চেঙ্গিজ খানের বাহিনী। কদিন আগেই বামিয়ান দখল করে এসেছিল সে। সিন্ধু নদীর তীরে এসে সুলতান দেখলেন বর্ষাকাল চলছে। নদীতে উত্তাল ঢেউ। পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই। একটি মাত্র নৌকা মিললো। মহিলাদের পারাপার করানোর সময় সেটিও ফুটো হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে সুলতানকে জড়িয়ে পড়তে হলো এক অসম যুদ্ধে। তার সাথে ছিল ত্রিশ হাজার সৈন্য। আর তাতারীদের সেনাসংখ্যা ছিল তার দশগুন। প্রথম দিন প্রচন্ড যুদ্ধ হলো।
যুদ্ধে বারবার তাতারীরা এগিয়ে যাচ্ছিল, আবার মুসলমানরা। দিনশেষে কোনো ফলাফল ছাড়াই দুই বাহিনী নিজ নিজ শিবিরে ফিরে আসে। দ্বিতীয় দিনও মরনপন লড়াই হয় কিন্তু কেউই জ্যী হতে পারেনি। মুসলমানরা সংখ্যায় ছিল অল্প, দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত, রসদও ক্রমশ ফুরিয়ে আসছিল, তবুও তারা দৃঢ় মনোবলের সাথে লড়তে থাকে। তৃতীয় দিন আবার দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। এদিন তাতারী বাহিনীর সাহায্যে নতুন দুটি বাহিনী এসে উপস্থিত হয়। এতে তাতারীদের মনোবল আরো বৃদ্ধি পায়। আগের দুদিনের যুদ্ধে তাতারিদের পাশাপাশি অনেক মুসলমান সেনাও নিহত হয়েছিল। ফলে মুসলমানদের সেনাসংখ্যাও কমে যায়। সুলতান অনুভব করছিলেন ক্রমেই তার শক্তি কমে আসছে। তিনি তাই সিদ্ধান্ত নেন চুড়ান্ত আঘাত হানার। তিনি সিদ্ধান্ত নেন চেঙ্গিজ খানকে যদি কোনোভাবে হত্যা করা যায় তাহলে তাতারীদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। চেঙ্গিজ খান অবস্থান করছিল বাহিনীর মধ্যভাগে। তার প্রহরায় নিযুক্ত ছিল অন্তত দশ হাজার সেনা। সুলতান বুঝতে পারলেন প্রথমে এই সেনাদেরকে মূল বাহিনী থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলেন তাতারীদের বাহিনীর বামপার্শ্বে প্রথমে হামলা করবেন। জোরদার হামলার কারনে অন্যপ্রান্তের সেনারা এদিকে এগিয়ে আসবে। তখন আগ থেকে প্রস্তুত থাকা সুলতানের সেনারা এগিয়ে চেঙ্গিজ খানের উপর মরনপন হামলা করবে। খুবই বিপদজনক একটি পরিকল্পনা। কিন্তু এছাড়া সুলতানের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
দিনের শুরুতেই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। আমিনুল মুলকের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর একাংশ ঝাপিয়ে পড়ে তাতারী বাহিনীর বাম শিবিরের উপর। আক্রমনের তীব্রতায় তাতারীদের পা টলে যায়। এমনকি তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ধাওয়া পালটা ধাওয়া চলতে থাকে। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। সুলতান সিদ্ধান্ত নিলেন এখনই তিনি চেঙ্গিজ খানের উপর হামলা করবেন। তিনি নিজের অল্পকিছু সেনা নিয়ে চিতার ন্যায় ঝাপিয়ে পড়েন চেঙ্গিজ খানকে ঘিরে রাখা বাহিনীর উপর। প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের একফাকে সুলতান দেখলেন চেঙ্গিজ খান দূরে ঘোড়ার উপর বসে আছে। তার সাদা দাড়ি দেখা যাচ্ছে। এই সেই চেঙ্গিজ খান যার হাতে পতন ঘটেছে বুখারা, সমরকন্দের মত সমৃদ্ধ শহরের । চলেছে গনহত্যা। রেহাই দেয়া হয়নি নারী ও শিশুদেরকেও। সুলতান প্রচন্ড রাগে তেড়ে যান চেঙ্গিজ খানের দিকে। মুহূর্তে তার বাহিনীর রক্ষনভাগ ভেদ করে চেঙ্গিজ খানের সামনে চলে যান। এই প্রথম মুখোমুখি হলেন দুই সেনাপতি। সুলতানের আক্রমনে চেঙ্গিজ খানের ঘোড়া মারা যায়। চেঙ্গিজ খান দ্রুত আরেকটি ঘোড়ায় উঠেই একদিকে ছুট দেয়। নিমিষেই সে তাতারীদের মাঝে মিশে যায়। চেংগিজ খান যদিও বীরযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু এই লড়াইতে সে সুলতানের সাথে লড়ার পরিবর্তে পালানোকেই নিরাপদ মনে করলো।
চেঙ্গিজ খান দ্রুত সরে গেল। এদিকে সুলতান তার বাহিনীর মাঝখানে আটকা পড়েছেন। তিনি বীরত্বের সাথে লড়ছিলেন। কিন্তু তাতারীরা ময়দানে এসেছে তাদের সকল শক্তি নিয়ে। সুতরাং আবারও যুদ্ধের গতি পালটে যায়। তাতারীদের উপর্যুপরি আক্রমনে মুসলিম বাহিনী এলোমেলো হয়ে যায়। এই আক্রমনের এক পর্যায়ে সুলতানের সাত বছর বয়সী ছেলেও নিহত হয়। সুলতান তার বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তিনি একা একাই লড়ছিলেন তাতারীদের সাথে। চেঙ্গিজ খান সুলতানকে দেখে তাতারীদের নির্দেশ দিল তাকে হত্যা করা যাবে না। জীবিত ধরতে হবে। চেঙ্গিজ খান জানতো সুলতান যতই বীর হন এক সময় তিনি ক্লান্ত হবেনই। সুলতান লড়ছিলেন, তার হাতে তাতারী সেনারা মারা যাচ্ছিল, কিন্তু তবুও তারা সুলতানের উপর প্রানঘাতি আক্রমন করছিল না। সুলতান বুঝে ফেলেন তাদের মতলব। তিনি চিন্তিত হয়ে উঠেন । চেঙ্গিজ খানের হাতে বন্দী হয়ে অপমানের মৃত্যু চান না। সুলতান যুদ্ধের একফাকে একটি তাজাদম ঘোড়া দখল করেন। তিনি একপাশে ছুটে যান।সিন্ধু নদীর পাশের একটি ছোট পাহাড়ে উঠেন। তারীখে খাওয়ারেজমশাহীর বর্ননা অনুসারে, এই পাহাড়ের উচ্চতা ছিল প্রায় ৪০ ফুট। এখান থেকে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি নদীতে ঝাপ দেন। নদীতে পানির তীব্র স্রোত। সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু দ্রুতই সুলতান অপরপার্শ্বে পৌছে যান। চেঙ্গিজ খান এগিয়ে এসে দাঁড়ায় সেই পাহাড়ে, যেখান থেকে সুলতান লাফ দিয়েছেন। সুলতান চেঙ্গিজ খানকে দেখে নিজের অভ্যাসের বিপরীতে (ইমাম যাহাবী লিখেছেন সুলতান সবসময় মুচকি হাসতেন। কখনো অট্টহাসি দিতেন না) অট্টহাসি দিলেন। এই হাসি চেঙ্গিজ খানের গায়ে পরাজয়ের অপমানের চেয়ে বেশি বিধে। কয়েকজন সর্দার অনুমতি চায় নদী পার হয়ে সুলতানকে ধাওয়া করতে। চেঙ্গিজ খান অনুমতি দেয়নি। সে জানতো এই প্রমত্তা নদী অতিক্রম করা তাতারীদের সাধ্যে নেই।
এই যুদ্ধে তাতারীরা তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এসেছিল। তবুও মুসলিম বাহিনী তিনদিন তাদের মোকাবেলা করেছে। এমনকি ইবনুল আসির লিখেছেন, এই যুদ্ধে মুসলমানদের চেয়ে তাতারীদের হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। (আল কামিল ফিত তারিখ)
এই যুদ্ধের ফলে তাতাররীদের মনোবলেও ভাটা পড়ে। চেঙ্গিজ খান আর ভারতবর্ষের দিকে এগুতে সাহস করেনি। ইমাম যাহাবীর ন্যায় বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ঐতিহাসিকও লিখেছেন, যদি জালালুদ্দিন না থাকতেন তাহলে তাতারীরা পুরো বিশ্ব পদদলিত করে ফেলতো। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)