মূল : শায়খ আব্দুল হাই হাসানী নদভী র.
রুপান্তর : ইমরান রাইহান
এটা অত্যন্ত হতাশার বিষয় যে, ভারতবর্ষে ইলমের ইতিহাস এখনো অন্ধকারেই আছে। এখনো আমরা সঠিকভাবে নির্নয় করতে পারি নি, বিভিন্ন সময়ে এখানকার পাঠ্যক্রমে কী কী পরিবর্তন এসেছে। ইতিহাস থেকে এটুকু নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, ভারত বিজেতাদের সাথে ইলম এ অঞ্চলে এসেছে এবং ইরাক ও মা ওয়ারাউন্নাহার অঞ্চলের পাঠ্যক্রমে যেসকল পরিবর্তন এসেছে তার প্রভাব এ অঞ্চলের পাঠ্যক্রমেও পড়েছে।
সর্বপ্রথম সিন্ধ ও মুলতানের বালূকাময় প্রান্তরে ইলমের প্রদীপ জ্বলে উঠে। তারপর এই প্রদীপের আলো বাড়তে থাকে এবং একসময় গোটা ভারতবর্ষে এই আলো ছড়িয়ে পড়ে। গজনবীরা যখন লাহোরকে তাদের রাজধানী বানান তখন ঐ শহর এই ইলমের দ্বারা প্রদীপ্ত হয়ে উঠে। দিল্লী বিজয়ের পর সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় যোগ্য যোগ্য উলামাগন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগমন করে দিল্লী একত্রিত হন। তাদের প্রসিদ্ধির কারনে দূর দূরান্ত থেকে ছাত্ররা তাদের কাছে পড়তে আসা শুরু করে। সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবনের সময়কালে শামসুদ্দীন খাওয়ারেজমী , শামসুদ্দীন কোশজি, বোরহানুদ্দীন বলখী, বোরহানুদ্দীন বাজ্জাজ, নাজমুদ্দীন দিমাশকি, কামালুদ্দীন যাহেদ, এমন প্রসিদ্ধ অন্তত বিশজন আলেম দিল্লীতে বসবয়াস করতেন। তাদের ইলম ও খ্যাতিতে দিল্লী তখন বাগদাদ ও কর্ডোভার আরেক নমুনা হয়ে যায়। আলাউদ্দীন খিলজির শাসনকালে জহিরুদ্দীন বাখরী, ফরিদুদ্দীন শাফেয়ি, হামিদুদ্দীন মোখলেস, শামসুদ্দীন নাজী, মহিউদ্দীন কাশানি, ফখরুদ্দীন হানুসী, ওয়াজিহুদ্দিন রাজী, তাজুদ্দিন মিকদাম, এমন অন্তত ৪৬ জন আলেমের নাম জানা যায়, যাদের ব্যাপারে জিয়াউদ্দীন বারনীর মন্তব্য হলো, তাদের সমকক্ষ আর কেউ ছিল না ।
মুহাম্মদ শাহ তুঘলকের শাসনামলে মুইনুদ্দীন ইমরানী, কাজী আব্দুল মুকতাদির, শেখ আহমদ থানেশ্বরীর মতো আলেমরা ছিলেন, যাদের সংস্পর্শে শিহাবুদ্দীন দৌলতাবাদীর মতো আলেম তৈরী হয়েছেন, ইতিহাস যার যোগ্যতার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছে। ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকালে জালালুদ্দীন রুমী দিল্লী আসেন। তাকে শাহী মাদরাসার প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। একই সময়ে নাজমুদ্দীন সমরকন্দীও দিল্লী আসেন এবং নিজের ইলম দ্বারা ইলম পিপাসুদের তৃষনা নিবারণ করেন। সিকান্দার লোদীর শাসনামলে শেখ আব্দুল্লাহ ও শেখ আজিজুল্লাহ নামে দুজন আলেম মুলতান থেকে দিল্লী আসেন। তারা পাঠ্যক্রমে মানতেক এবং হেকমতের পরিমান বৃদ্ধি করেন। আকবরের শাসনামলে শাহ ফতহুল্লাহ সিরাজী ইরান থেকে ভারতে আসেন । তাকে আযদুল মুলক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পুরো ভারতবর্ষে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময়ে হাকীম শামসুদ্দীন আওরানের ভাগনে হাকীম আলী গিলানী চিকিতসাবিদ্যায় অবদান রাখেন এবং শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী হাদীসের খেদমত করেন। শাহজাহান এবং আলমগীরের আমলে মীর যাহেদের খ্যাতির সূর্য আলো ছড়ায় । বলতে গেলে দরসে নিজামির বুনিয়াদ তার হাতেই রাখা হয়। তার ছাত্রদের মধ্যে শাহ্ আব্দুল আজিজ, শাহ্ রফিউদ্দীন, শাহ্ আবদুল কাদের, মৌলভী আবদুল হাই, শাহ্ মুহাম্মদ ইসমাঈল, মৌলভী মুহাম্মদ ইসহাক, মৌলভী রশীদুদ্দীন খান, মুফতী সদরুদ্দীন খান, মৌলভী মামলুক আলী প্রমুখ আলেমরা ছিলেন।
লাহোরে ইলমের প্রচার প্রসার শুরু হয়েছিল দিল্লির আগে কিন্তু দিল্লী অল্পসময়েই খ্যাতির শীর্ষে পৌছে যায় , ফলে ইলমের ময়দানে লাহোর তার জৌলুস হারায়। পরে জামালুদ্দিন তালাহ, কামালুদ্দীন কাশ্মিরী, মুফতী আবদুস সালাম, মোল্লা আবদুল হাকিম শিয়ালকোটি প্রমুখ বরেন্য আলেমরা লাহোরে ইলমের প্রচার প্রসারের কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে লাহোর তার হারানো রওনক ফিরে পায়।
জৌনপুরে শর্কি সালতানাতের পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ আবুল ফাতাহ শিহাবুদ্দীন দৌলতাবাদী, উস্তাযুল মুলক মুহাম্মদ আফজাল, শামসে বাযেগার লেখক মোল্লা মাহমুদ, দেওয়ান আব্দুর রশীদ, মুফতী আবদুল বাকী, মোল্লা নুরুদ্দীনের মতো আলেমরা ইলম প্রচার প্রসারে অবদান রেখেছেন। তাদের ছাত্ররা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ভারতবর্ষে।
গুজরাটের বাসিন্দারাও ইলম চর্চায় অসামান্য বদান রেখেছেন। শায়খ ওয়াজিহুদ্দীন গুজরাটি, মোল্লা নুরুদ্দীন প্রমুখ বরেণ্য আলেমরা গুজরাটে ইলমের প্রদীপ জ্বেলেছেন। সে প্রদীপ থেকে আলো নিতে দূরদুরান্ত থেকে ছুটে এসেছে শিক্ষার্থীরা। কাজী জিয়াউদ্দীন এসেছিলেন শায়খ ওয়াজিহুদ্দীনের কাছে। তার কাছ থেকে ইলম অর্জন করে নিজের এলাকায় ফিরে ইলমের প্রচারে মনোনিবেশ করেন। তার ছাত্রদের মধ্যে শেখ জামাল অন্যতম। শেখ জামালের ছাত্র মোল্লা লুতফুল্লাহ । মোল্লা লুতফুল্লাহর ছাত্র নুরুল আনোয়ার প্রণেতা মোল্লা জিয়ুন, মোল্লা আলী আসগর, মোল্লা মুহাম্মদ আমান, কাজী আলিমুল্লাহ। তারা সবাই ছিলেন স্বীয় যুগের খ্যাতনামা আলেম। এলাহাবাদের আলেমদের মধ্যে শায়খ মুহিব্বুল্লাহ, কাজী মোহাম্মদ আসফ, শেখ মুহাম্মদ তাহের , মৌলভী বরকত, মউলভী জারুল্লাহ, প্রমুখ আলেম উল্লেখযোগ্য। তারা দীর্ঘদিন দরস তাদরিসের সাথে জড়িত থেকে নিজ নিজ এলাকাকে ইলমের আলোয় আলোকিত করেছেন। লখনউতে সর্বপ্রথম শায়খে আজম জৌনপুর থেকে ইলমের এই ধারা নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে শাহ্ পির মুহাম্মদ এই ধারায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন করেন। তার শিষ্যদের কেউ কেউ যেমন মোল্লা গোলাম নকশবন্দী এই পাঠ্যক্রমকে সামনে অগ্রসর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এই সময়ে শায়খ কুতুবুদ্দীন সহালভীও দরস তাদরিসের সাথে যুক্ত হন, শীঘ্রই তার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। বংশীয় কোন্দলের কারনে তিনি নিহত হলে তার সন্তান মোল্লা নিজামুদ্দিন পিতার মসনদে আসিন হন। শীঘ্রই লখনৌ পরিচিতি পায় ইলমের মারকাজ হিসেবে। মোল্লা নিজামুদ্দীন যে পাঠ্যক্রম প্রনয়ন করেন তা সর্বত্র গ্রহনযোগ্যতা পায়। ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি দরসগাহে এই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হতে থাকে। এই বংশেই মোল্লা হাসান, বাহরুল উলুম মোল্লা মুবিন, মৌলভী আবদুল হাকীম, মুফতি জহুরুল্লাহ, মৌলভী ওয়ালিউল্লাহ, মুফতী মুহাম্মদ আসগর, মুফতী মুহাম্মদ ইউসুফ, মৌলভী আবদুল হাই, মউলভী আবদুল হালীম, মৌলভী নুরুল্লাহ প্রমুখ আলেম জন্মগ্রহণ করেন। এই বংশের সন্তানরা এবং তাদের ছাত্ররা ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়েন।
আউধের ছোট ছোট গ্রামগুলো হয়ে উঠে ইলমের কেন্দ্রবিন্দু । খুব কম এলাকাই এমন ছিল যেখানে ইলমের চর্চা হচ্ছিল না । ঝাইস, বিলগ্রাম, কাকোরি, হারগ্রাম, আমিঠি প্রতিটি এলাকাতেই তখন বইছে ইলমের ঝর্নাধারা। সহজবোধ্যতার জন্য আমরা ভারতবর্ষের পাঠ্যক্রমের ইতিহাসকে চার যুগে ভাগ করেছি। প্রত্যেক যুগে কী কী কিতাব পড়ানো হতো তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা সামনে আসবে। এ কাজে তথ্য সংগ্রহ করেছি ইতিহাসের বই থেকে , মাশায়েখদের মালফুজাত ও মাকতুবাত থেকে এবং তবাকাত ও কবিদের তাজকিরা থেকে। যদিও প্রাথমিকভাবে এটাকে ছোট কাজ মনে হবে কিন্তু বাস্তবতা হলো বিভিন্ন ধরনের বইপত্রের হাজার পৃষ্ঠা উল্টানোর পরেই এই প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে ।
প্রথম যুগ
এই যুগের শুরু হিজরী সপ্তম শতাব্দী থেকে। সমাপ্তিকাল হিজরী দশম শতাব্দী। প্রায় দুইশ বছরের বেশি সময়কাল এই পাঠ্যক্রম চালু ছিল। এ সময় যে সকল বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হতো তা হলো, নাহু, সরফ, বালাগাত, ফিকহ, উসুলে ফিকহ, মানতেক, ইলমুল কালাম, তাসাউফ, তাফসীর, হাদীস ইত্যাদী। নাহুর জন্য পড়ানো হতো মিসবাহ, কাফিয়া এবং কাজী নাসিরুদ্দীন বায়জাভির লুব্বুল আলবাব। পরে কাজী শিহাবুদ্দীন দৌলতাবাদীর ইরশাদ ও পড়ানো হতো।
ফিকহ = হেদায়া
উসুলে ফিকহ = মানার এবং তার শরাহ, উসুলে বাযদাভী
তাফসীর = মাদারেক, বায়জাভী, কাশশাফ
তাসাউফ = আওয়ারেফ, ফুসুস। (পরবর্তীকালে খানকাহ সংলগ্ন মাদ্রাসাগুলোতে নকদুন নুসুস পড়ানো হতো )
হাদীস = মাশারিকুল আনোয়ার, মাসাবিহুস সুন্নাহ
আদব = মাকামাতে হারিরি। এর মাকামাতগুলো মুখস্থ করানো হতো। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মালফুজাত থেকে জানা যায় তিনি তার উস্তাদ শামসুদ্দীন খাওয়ারেজমীর কাছে মাকামাত পড়েছিলেন এবং এর চল্লিশটি মাকামাত মুখস্থ করেছেন।
মানতেক = শরহে শামসিয়্যাহ
ইলমুল কালাম = শরহে সহায়েফ, কোথাও কোথাও আবু শাকুর সালেমির তামহিদ।
সেই সময়ের আলেমদের জীবনি থেকে বোঝা যায় তখন উসুলে ফিকহের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো। হাদীস শাস্ত্রে শুধু মাশারিকুল আনোয়ার পড়াকেই যথেষ্ট মনে করা হতো। যদি কেউ মাসাবিহুস সুন্নাহ পড়তেন তাহলে তাকে ইমামুদ দুনিয়া ফিল হাদীস উপাধি দেয়া হতো। সে যুগে হাদীসের সাথে সম্পর্কহীনতার একটি প্রমান পাওয়া যায় শেখ নিজামুদ্দীন আউলিয়ার ঘটনা থেকে। গিয়াসুদ্দীন তুঘলকের সময়কালে দিল্লীতে সামা বিষয়ক একটি বিতর্কের আয়োজন করা হয়। এক পক্ষে ছিলেন নিজামুদ্দীন আউলিয়া। অন্য পক্ষে দিল্লীর অন্যান্য উলামায়ে কেরাম। নিজামুদ্দীন আউলিয়া বলেন, আমি যখনই তাদের সামনে কোনো হাদীস পেশ করি তখনই তারা বলে, আমাদের এই শহরে হাদীসের চেয়ে ফিকহের গুরুত্ব বেশি । এখানে ফিকহের অগ্রাধিকার। আবার কখনো তারা বলে এই হাদীস ত শাফেয়ীদের। আর ইমাম শাফেয়ী আমাদের উলামাদের দুশমন। শায়খ বলেন যে শহরের উলামাদের আত্যম্ভরিতা এতো বেশি সে শহর কীভাবে টিকে থাকবে। এই শহর ধবংস হয়ে যাওয়াই ভালো। (এর কিছুকাল পরেই মুহাম্মদ বিন তুঘলক রাজধানী দিল্লী থেকে সরিয়ে দেবগিরিতে নিয়ে যান। দিল্লী হয়ে যায় বিরান। —- ই.রা)
আলাউদ্দীন খিলজির শাসনামলে মাওলানা শামসুদ্দীন তুর্ক নামে একজন মিসরী মুহাদ্দিস মুলতান পর্যন্ত এসে ফেরত যান। তিনি যাওয়ার আগে বাদশাহর কাছে একটি পত্র লেখেন। সেখানে তিনি বাদশাহকে জানান ভারতবর্ষে হাদীসচর্চার প্রতি মৌলভীদের আগ্রহ নেই। দরবারী আলেমরা তার এই পত্র বাদশাহ পর্যন্ত পৌছতে দেয় নি। জিয়াউদ্দীন বারনী তারিখে ফিরোজশাহীতে এ ঘটনা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
দ্বিতীয় যুগ
হিজরী নবম শতাব্দীর শেষভাগে মুলতান থেকে শেখ আবদুল্লাহ ও শেখ আজিজুল্লাহ নাম দুজন আলেম আসেন। শেখ আবদুল্লাহ দিল্লীতে অবস্থান করেন এবং শেখ আজিজুল্লাহ সাম্বলে অবস্থান নেন। সিকান্দার লোদী তাদের কে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। বিভিন্ন সময় তাদের দরসেও উপস্থিত হতেন। তার আগমনে যেন দরসে ব্যাঘাত না ঘটে সে জন্য তিনি সরাসরি দরসে না বসে মসজীদের এক কোনে বসে পড়তেন। পরে দরস শেষ হলে শেখ আব্দুল্লাহর সাথে গিয়ে দেখা করতেন। এই দুই আলেম নিজেদের যোগ্যতাবলে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় শীঘ্রই পুরো ভারতবর্ষে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে তারা পাঠ্যক্রমে কাজী ইযদের আল মাওয়াকিফ এবং সাক্কাকীর মিফতাহুল উলুম অন্তর্ভুক্ত করেন।
মোল্লা আব্দুল কাদের বাদায়ূনী মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখে লিখেছেন, ‘সুলতান সিকান্দার লোদীর যুগে শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে ছিলেন দিল্লীর শায়খ আব্দুল্লাহ তালবানী এবং সাম্ভলের শেখ আজিজুল্লাহ তালবানী । এই দুজন মুলতানের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে হিন্দুস্তানে এসে ইলমে মাকুল কে এদেশে প্রসারিত করে ছিলেন। এ দুজনের পূর্বে শরহে শামসিয়া এবং শারহে সাহায়েফ ব্যতিত ইলমে মানতেক এবং কালামের অন্য কোন কিতাব ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল না’।
এ সময় মীর সাইয়েদ শরীফের ছাত্ররা শহরে মাতালি ও শরহে মাওয়াকিফ এবং তাফতাজানির শিষ্যরা মুখতাসারুল মা’আনি ও শরহে আকাইদে নাসাফী পড়ানো শুরু করেন। শরহে জামী ও শরহে বেকায়াও এ সময় ধীরে ধীরে পাঠ্যক্রমে প্রবেশ করতে থাকে। এই যুগের শেষদিকের একজন আলেম যিনি তার সময়কালের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বও বটে, শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী আরবে যান এবং সেখানে তিন বছর অবস্থান করে হাদীস শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। দেশে ফিরে তিনি এবং তার সন্তানরা হাদীসের এই বরকতময় সিলসিলার প্রচার প্রসারে মনোযোগী হন কিন্তু তাদের এই ধারা বেশিদিন সচল থাকে নি। এই সৌভাগ্য অর্জন করেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী। সে যুগের উলামায়ে কেরামের জীবনি পড়লে এটা পরিস্কার হয়, সেকালে মিফতাহুল উলুম ও মাওয়াকিফকে খুবই গ্রুত্ব দেয়া হতো। মুফতী জামাল খানের জীবনিতে বাদায়ুনী লিখেছেন, ‘তিনি দরসে বসে মিফতাহুল উলুম ও মাওয়াকিফ আগাগোড়া চারবার পড়েছেন’।
তৃতীয় যুগ
দ্বিতীয় যুগে পাঠ্যক্রমে যেসকল পরিবর্তন , পরিবর্ধন এসেছে তার ফলে আলেমরা আরো আশাবাদী হন এবং পাঠ্যক্রমে যে কোনো পরিবর্তনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। এ কারনেই আকবরের শাসনামলে যখন শেখ ফতহুল্লাহ সিরাজী আসেন এবং পাঠ্যক্রমে কিছু পরিবর্তন আনেন , তা সর্বত্র সমাদৃত হয়। মাওলানা গোলাম আলী আজাদ বিলগ্রামী ‘মাআছিরুল কিরামে’ লিখেছেন, ‘পরবর্তী উলামায়ে কেরামের মধ্যে মীর সদরুদ্দীন, মীর গিয়াসুদ্দিন মানসুর, মীর্জা জান প্রমুখ ভারতবর্ষে আগমন করেন এবং দরসদানে মনোযোগী হন’। এই আলোচনায় অবশ্যই শায়খ ওয়াজিহুদ্দীন গুজরাটির নাম নিতে হয়। তিনিই সর্বপ্রথম মুতাআক্ষেরিন উলামায়ে কেরামের বইপত্র পড়ানো শুরু করেন। তার এই ধারা গুজরাটের বাইরেও জনপ্রিয়তা পায়। তার ছাত্ররা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ইলমের প্রদীপ জ্বেলেছেন। মুফতী আব্দুস সালাম ছিলেন ফতহুল্লাহ সিরাজীর ছাত্র। তিনি চল্লিশ বছর লাহোরে বসে দরস দেন। হাজার হাজার ছাত্র তার কাছে পড়তো। অবশ্য তিনি খুব কম ছাত্রকেই সনদ দিতেন। দেওয়াহর মুফতী আব্দুস সালাম এবং এলাহাবাদের শায়খ মুহিব্বুল্লাহ এমনই দুই ভাগ্যবান যারা লাহোরে পড়াশুনা করেন এবং সনদ অর্জন করেন। তাদেরই ছাত্র শায়খ কুতুবুদ্দীন সাহালভি, যিনি দরসে নিজামীর প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা নিজামুদ্দীনের পিতা। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (মৃত্যু ১১৭৪ হিজরী), যিনি এই পাঠ্যক্রমের সবচেয়ে বিখ্যাত আলেম, তিনি নিজের ছাত্রজীবনের কথা বলতে গিয়ে পাঠ্যতালিকা দিয়েছেন। তা নিম্নরূপ :
নাহু = কাফিয়া, শরহে জামী।
মানতেক = শরহে শামসিয়া, শরহে মাতালি।
দর্শন = শরহে হেদায়াতুল হিকমাহ।
কালাম = শরহে আকাইদে নাসাফী, শরহে মাওয়াকিফ।
ফিকহ = শরহে বেকায়া, হেদায়া।
উসুলে ফিকহ =হুসামি এবং তালবি আলাত তাওজি এর কিছু অংশ।
বালাগাত = মুখতাসারুল মাআনি , মুতাওয়াল।
গনিত = নির্বাচিত কিছু পুস্তিকা।
চিকিৎসা বিজ্ঞান = মুজিজুল কানুন।
হাদীস = মিশকাতুল মাসাবিহ (সম্পূর্ণ), শামায়েলে তিরমিযি (সম্পূর্ণ), সহীহ বুখারীর কিছু অংশ।
তাফসীর = তাফসীরে মাদারেক, বায়যাভী।
তাসাউফ = আওয়ারেফ, রাসায়েলে নকশেবন্দীয়া, শরহে রুবাইয়াতে জামী, মুকাদ্দিমা নাকদুন নুসুস।
এসব পড়া শেষে শাহ সাহেব আরবে যান। সেখানে তিনি শায়খ আবু তাহের মাদানীর কাছে অবস্থান করে ইলমে হাদীস চর্চা করেন এবং এই উপহার নিয়ে দেশে ফিরেন। দেশে ফিরে তিনি হাদীস চর্চার যে মশাল জ্বেলেছেন তার আলো আজো জ্বলছে। মূলত শাহ সাহেবের সময়কাল থেকেই ভারতবর্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সিহাহ সিত্তার পঠনপাঠন শুরু হয়। শাহ সাহেব এ সময় নতুন একটি পাঠ্যক্রম প্রনয়ণ করেন। কিন্তু ততোদিনে ইলমের কেন্দ্র দিল্লী থেকে স্থানান্তরিত হয়ে লখনৌতে চলে গেছে। ফলে শাহ সাহেবের এই পাঠ্যক্রম খুব একটা কার্যকরী হয় নি এবং শাহ সাহেবের সন্তানরাও এই পাঠ্যক্রমকে প্রচার করার আগ্রহ দেখান নি।
চতুর্থ যুগ
হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীতে এই যুগের শুরু। এই সময়ে মোল্লা নিজামুদ্দিন ফিরিংগী মহল্লী একটি পাঠ্যক্রম প্রনয়ন করেন, পরবর্তীকালে যা দরসে নেজামী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মোল্লা নিজামুদ্দিন ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর সমসাময়িক। তার প্রনীত পাঠ্যক্রম ছিল নিম্নরুপ :
ইলমুস সরফ (শব্দ ও তার রুপান্তর শাস্ত্র) = মীযানুস সরফ , মুনশায়িব, পাঞ্জেগাঞ্জ, ইলমুস সীগাহ (মুফতী ইনায়েত আহমাদ কাকুরী প্রনীত), ফুসুলে আকবরী, শাফিয়া।
নাহু (ব্যাকরণ) =নাহবেমীর, মিয়াতে আমেল (আব্দুল কাহির জুরজানির ব্যখ্যাসহ), আবু হাইয়ান আন্দালুসীর হিদায়াতুন নাহু, কাফিয়া, শরহে জামী।
মানতিক ( যুক্তিবিদ্যা) =সুগরা-কুবরা, মুখতাসার ঈসাগুজি, তাহযিবুল মানতিক ওয়াল কালাম, শরহে তাহযীব, কুতবী, মীর কুতবী, সুল্লামুল উলুম।
হিকমত ও ফালসাফা (দর্শন ও তত্ত্বজ্ঞান)=হিদায়াতুল হিকমাহ ব্যখ্যাগ্রন্থ মারযুবী, সদরা, শামসে বাযেগা।
গণিত =খুলাসাতুল হিসাব ওয়াল হানদাসা, উসুলুল হানদাসাতিল ইকলীদাস, তাশরিহুল আফলাক, রিসালাতু কুশজিয়া, শরহে চুগমীনী (প্রথম অধ্যায়)।
বালাগাত (অলংকারশাস্ত্র) =মুখতাসারুল মাআনি, মুতাওয়াল ।
ফিকহ =শরহে বেকায়া, হেদায়া।
উসুলে ফিকহ =নুরুল আনোয়ার, আত তাওহীদ ফী হাললি গাওয়ামিদিত তানকীহ, আত তালবীহ, মুসাল্লামুস সুবুত।
ইলমে কালাম =শরহে আকাইদে নাসাফী, শরহুল আকাইদিল আদদিয়া, মীর যাহেদ।
তাফসীর =তাফসীরে জালালাইন, বায়জাভী।
হাদীস =মিশকাতুল মাসাবিহ।
এই পাঠ্যক্রমের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল তাতে ছাত্রদের চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তি প্রখর করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাতে বই পাঠ্য ছিল কিন্তু মূলত ছাত্রদের কে শাস্ত্রের প্রতি আগ্রহী করানোর দিকেই বেশি জোর দেয়া হতো। পাঠ্যক্রমে সংক্ষিপ্তভাবে সকল বিষয়কে রাখা হয়েছিল যেন একজন ছাত্র ষোলো সতেরো বছর বয়সেই পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করতে পারে। (ফিরিংগী মহলের উলামায়ে কেরামের জীবনি পড়লে দেখা যায় তাদের অধিকাংশ এ বয়সেই নেসাব বা পাঠ্যক্রম শেষ করেছেন । —- ই.রা)