মূল – রিয়াসত আলী নদভী (র)
সংক্ষিপ্ত অনুবাদ — ইমরান রাইহান।
——————————————————–
(মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন মাহবুবুল মুরসালিন, তানভীর রাজ, তানভীর মুহতাসিমসহ আরো কয়েকজন ভাই। এ বিষয়ে রিয়াসত আলী নদভী রচিত ‘ইসলামি নেজামে তালিম’ বইটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু সমৃদ্ধ। মূল বইটি অনুবাদ করা সময়সাপেক্ষ কাজ। তাই আপাতত, মূল বইয়ের সারকথা অনুবাদ করে দিচ্ছি। এই লেখাটি বইয়ের হুবহু অনুবাদ নয়। শুধু বইয়ের মূল তথ্যগুলো অনুবাদ করেছি। কোথাও রেফারেন্স বা অতিরিক্ত তথ্য যোগ করতে হলে তা টীকায় সংযুক্ত করেছি। — ইমরান রাইহান)
প্রারম্ভিকা
প্রাথমিকভাবে মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থাকে তিন যুগে ভাগ করা যায়।
১। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগ থেকে উমাইয়া শাসনের প্রথম যুগ পর্যন্ত।
২। উমাইয়া শাসনামলের শুরু থেকে হিজরী চতুর্থ শতাব্দী।
৩। হিজরী পঞ্চম শতাব্দী থেকে হিজরী অষ্টম শতাব্দী।
বৈশিষ্ট্য : এবার এই যুগগুলোর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা যাক।
প্রথম যুগ — এটি শুরু হয় রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবদ্দশাতেই। সে সময় দারুল আরকামে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম মাদরাসা। এরপর সুফফার মাদরাসা (১)। মসজিদে নববীতে সাহাবীদের এক জামাত কোরআন পড়তেন, অন্যরা শুনতেন। মদীনার বাহির থেকে যেসকল সাহাবী আসতেন তারা আনসারদের গৃহে থাকতেন। সুফফার মাদরাসায় পড়তেন।
মুসলমানদের বিজয়ের ধারা শুরু হলে বিজিত অঞ্চলে শিক্ষক পাঠানো হতো সেখানকার লোকজনকে ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য। খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগেও এই ধারা চলতে থাকে। যেমন, হযরত আবু মুসা আশআরী (রা) কে যখন বসরায় পাঠানো হয় তখন তার সাথে ইমরান বিন হুসাইন (রা) গেলেন বসরার মানুষদেরকে কোরআন ও শরিয়ত শিক্ষা দিতে। হযরত উবাদা ইবনু সামিত (রা) হিমসে লোকজনকে কোরআন শিক্ষা দিতেন।
হজরত মুয়াজ বিন জাবাল যান ফিলিস্তিনে। হযরত আবু দারদা (রা) দামেশকে গমন করে মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তারা নিয়মতান্ত্রিক দরস দিতেন। হযরত আবু দারদা (রা) যখন দামেশকের শাহী মসজিদে দরস দিতেন তখন এত মানুষের ভীড় হত, মনে হত কোনো বাদশাহ আগমন করেছেন।
অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম যেখানেই অবস্থান করতেন, সেখানেই তারা হাদিসের দরস দিতেন। যেমন – হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা) দরস দিতেন মসজিদে নববীতে। হযরত হুযাইফা বিন ইসহাক (রা) দরস দিতেন কুফার মসজিদে (২)।
এ যুগের দরসগাহের বৈশিষ্ট্য ছিল-
১। কুরআন, হাদিস ও ফিকহের মধ্যেই পাঠ্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য কোনো বিষয় পড়ানো হতো না।
২। কোনো পাঠ্যপুস্তক ছিল না। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বলা ও শোনা নির্ভর।
৩। শিক্ষাদানের জন্য কোনো বেতন-ভাতা আদান-প্রদান করা হতো না।
৪। মসজিদ্গুলোই ছিল মাদরাসা। মসজিদেই দরস দেয়া হতো। মাদরাসার আলাদা কোনো অবকাঠামো ছিল না।
৫। হাদিস অন্বেষণে সফর করা হতো। স্বয়ং সাহাবায়ে কেরাম একে অপরের কাছ থেকে হাদিস শোনার জন্য অনেকদূর সফর করতেন। (৩)
৬। শিক্ষক যদি টের পেতেন ছাত্র দুনিয়াবী কোনো উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করতে চাচ্ছে, তাহলে তার কাছে হাদিস বর্ননা করতেন না।
দ্বিতীয় যুগ- এ যুগের শুরু হযরত উমর ইবনে আবদুল আযিয (র) এর সময়কাল ( রাজত্বকাল- ২২ সেপ্টেম্বর ৭১৭ – ৪ ফেব্রুয়ারি ৭২০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে। তিনি ইলমের প্রচার প্রসারে জোর দেন। তিনি শিক্ষাব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা নির্ধারণ করেন। সে সময় বিভিন্ন ভাষা থেকে বিভিন্ন গ্রন্থ অনুবাদের কাজও শুরু হয়। একইসাথে পাঠ্যক্রমে কোরআন, হাদিস, ফিকহ,মাগাজি, সিয়ার, তারিখ, আদব, নাহু, সরফ,ফালসাফা, মানতেক ইত্যাদী বিষয় সংযুক্ত হয়। এ যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল-
১। ইলম লিপিবদ্ধ হতে থাকে।
২। সংকলন, অনুবাদ, লেখালেখির ধারা চলতে থাকে।
৩। ছাত্র শিক্ষকের ভাতা নির্ধারণ হয়।
৪। মসজিদে পড়াশোনার জন্য পৃথক স্থান নির্ধারিত হয়।
৫। পাঠদানের কাজ চলতো মসজিদেই। অনেক সময় পাঠদানের জন্যই নতুন মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হতো।
৬। এই সময়ে বিভিন্ন কিতাব পড়ার ও শোনার সনদ প্রদানের রীতি শুরু হয়।
৭। শিক্ষকরা অন্যের লিখিত কিতাব পড়াতেন। আবার কখনো কখনো নিজের লিখিত কিতাবও পড়াতেন।
তৃতীয় যুগ- এই যুগে মসজিদের বাইরে আলাদা ইমারত নির্মানের প্রবণতা শুরু হয়। মসজিদেও দরস দেয়া হতো। একইসাথে আলাদাভাবে মাদরাসার অবকাঠামো নির্মানের কাজও চলতে থাকে। ছাত্র শিক্ষকদের থাকা-খাওয়া ও পোষাকের ব্যবস্থা করা হতো। এ যুগের বৈশিষ্ট্য-
১। মাদরাসার জন্য নিজস্ব ভবন নির্মান শুরু হয়।
২। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মাদরাসা নির্মান করা হয়। সামাজিক দৃষ্টিতে এটা ছিল সম্মানের কাজ। আমিররা এ কাজে আগ্রহের সাথে এগিয়ে আসতেন।
৩। পড়া এবং পড়ানো ছিল সম্মানের কাজ। রাজকার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ সময় পেলেই পড়াতেন কিংবা কারো দরসে বসতেন।
৪। পৃথক পৃথক শাস্ত্রের জন্য পৃথক পৃথক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
৫। নানা পাঠ্যক্রম প্রনয়ণ হয়। একইসাথে পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের ধারাও চলতে থাকে।
আল্লামা ইবনে খাল্লিকানের মতে, জামিয়া নিজামিয়া বাগদাদ ছিল মুসলিম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মাদরাসা (প্রতিষ্ঠাকাল ১০৬৫ খ্রিস্টাব্দ)। তবে আল্লামা তকিউদ্দিন আস সুবকি লিখেছেন, এটি প্রথম মাদরাসা নয়। এর আগে নিশাপুরে মাদরাসা বাইহাকিয়্যা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুলতান মাহমুদ গযনবীর ভাই নাসির বিন সুবক্তগিনও সায়িদিয়্যাহ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। (৪)
ভারতবর্ষে প্রথম মাদরাসা নির্মান করেন নাসিরুদ্দিন কুবাচাহ। তিনি মুলতানে মাওলানা কুতুবুদ্দিন কাশানির জন্য একটি মাদরাসা নির্মান করেন। (৫) এই মাদরাসাতেই শায়খ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানী লেখাপড়া করেন। আল্লামা মাকরেজি মিসরে প্রতিষ্ঠিত অনেক মাদরাসার বিবরণ দিয়েছেন। যেমন তিনি লিখেছেন ৬৫৪ হিজরীতে বাহাউদ্দিন আলি বিন মুহাম্মদ বিন সালিম মিসরে একটি বৃহৎ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
এবার মাদরাসার প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করা যাক-
১। মক্তব/মাকাতিব- এখানে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হতো।
২। মাদারিসে আম্মাহ- শরয়ী ইলম, আদব, আকলি ইলম এগুলো পড়ানো হতো।
৩। মাদারিসে কুরআন- এসব মাদরাসা শুধুমাত্র কুরআনুল কারিমের দরসের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হতো। ওয়াসিত শহরে এমন একটি মাদরাসা ছিল।
৪। দারুল হাদিস- শুধুমাত্র হাদিস পড়ানোর জন্য এসব মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হতো। সুলতান নুরুদ্দিন জেংগি দামেশকে একটি দারুল হাদিস প্রতিষ্ঠা করেন। আল কামিল নাসিরুদ্দিন কায়রোতে একটি দারুল হাদিস প্রতিষ্ঠা করেন।
৫। মাদারিসে ফিকহ- এসব মাদরাসায় ফিকহ পড়ানো হতো। কখনো শুধু নির্দিষ্ট একটি মাজহাবের ফিকহ পড়ানো হতো। আবার কখনো সকল মাজহাবের ফিকহই পড়ানো হতো। দামেশক, হালাব, মিসরে এমন অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি ‘হুসনুল মুহাজারা’ গ্রন্থে এবং আল্লামা মাকরেজি ‘আল মাওয়ায়েজ ওয়াল ইতিবার বিজিকরিল খিতাতি ওয়াল আসার’ গ্রন্থে এমন অনেক মাদরাসার কথা উল্লেখ করেছেন।
৬। মাদারিসে তিব্বিয়া- চিকিৎসা শাস্ত্র পড়ানোর জন্য পৃথক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হতো। আবার কখনো মাদরাসাতেই চিকিৎসা শাস্ত্র পড়ানো হতো। হাসপাতালে থাকতো বাস্তব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। বাগদাদ ও কায়রোতে এমন অনেক মাদরাসা ছিল। (৬)
মাদরাসার পাশাপাশি মসজিদেও দরসের ব্যবস্থা চালু ছিল। অনেকে শুধু সপ্তাহে একদিন দরস দিতেন। ইমাম যাহাবী লিখেছেন, শায়খ আবু বকর সাজ্জাদ জামে মানসুরে প্রতি শুক্রবার দরস দিতেন। জুমার সালাতের পূর্বে তিনি ফতোয়া দিতেন। সালাতের পর বয়ান করতেন এবং ইমলা (৭) করাতেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
আলেমদের দরসে প্রচুর লোক সমাগম হতো। আবুল হাসান আলি বিন আসেম ওয়াসেতির দরসে ত্রিশ হাজারের বেশি মানুষ হতো। (তাজকিরাতুল হুফফাজ) ইয়াজিদ বিন হারুনের দরসে আশি হাজারের মত মানুষ বসতো। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
বসরার মসজিদে ইমাম বুখারী ইমলার মজলিস চালু করলে এক হাজারের বেশি মুহাদ্দিস, ফকিহ ও হুফফাজ উপস্থিত হন। মুহাদ্দিস আসেম বিন আলি বাগদাদ এলে শহরের বাইরে হাদিসের দরস দেন। খলিফা হারুনুর রশিদ সেই মজলিসে উপস্থিত হন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
এসব মাদরাসার জন্য প্রচুর ওয়াকফের ব্যবস্থা থাকতো। বাগদাদের জামিয়া মুস্তানসিরিয়ার জন্য যে সম্পদ ওয়াকফ করা হয় তা থেকে বার্ষিক আমদানী ছিল সত্তর হাজার মিসকাল স্বর্ণ। বাগদাদ শহর সম্পর্কে বিখ্যাত পর্যটক ইবনু যুবাইর লিখেছেন, এখানে ত্রিশটি মাদরাসা আছে। প্রতিটি মাদরাসার ইমারত অত্যন্ত সুন্দর। প্রতিটি মাদরাসার জন্য নিজস্ব ওয়াকফের ব্যবস্থা আছে। এই ওয়াকফ থেকে ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যয় বহন করা হয়। (রিহলাহ)
হিজরী নবম শতাব্দী পর্যন্ত মাদরাসার জন্য ওয়াকফ করার এই ধারা চালু ছিল।
অনেক সময় ওয়াকফকারী কিছু শর্ত আরোপ করতেন। যেমন তার ওয়াকফ থেকে শুধু হানাফি ছাত্রদেরকেই ভাতা দেয়া হবে। মিসরে শাফেয়ী ও হানাফিদের এমন অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদরাসা খুরুরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা বদরুদ্দিন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ খুরুবি শর্ত দেন তার ওয়াকফ থেকে কোনো অনারব ছাত্রকে ভাতা দেয়া যাবে না।
মাদরাসা নির্মান শুরু হওয়ার আগে ছাত্র-উস্তাদ সবাই মসজিদের কুঠুরিতে ঘুমাতেন। মাদরাসার জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ শুরু হলে সেখানেই ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা হত। জামেয়া মুস্তানসিরিয়া সম্পর্কে আল্লামা শিবলী নোমানী লিখেছেন, মাদরাসার প্রাংগনে একটি হাসপাতাল ছিল। মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখানে ২৪৮ জন ছাত্র ভর্তি হয়। তাদের থাকা-খাওয়া, এমনকি কাগজ-কলমও মাওদ্রাসা থেকে দেয়া হত। সাধারণ খাবার ছাড়াও প্রায় সময় ফিরনি দেয়া হত। ছাত্রদের মাসিক ভাতা ছিল এক আশরাফী।
ইবনে বতুতা ওয়াসিতের একটি মাদরাসার কথা লিখেছেন। সেখানে তকিউদ্দিন নামে একজন আলেম নিজ খরচে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ইবনে বতুতা লিখেছেন সেই মাদরাসায় প্রায় তিনশো কামরা ছিল।
ভারতবর্ষের মাদরাসাগুলিতেও ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। ইবনে বতুতা ৮৩৪ হিজরীতে ভারতবর্ষে আসেন। তিনি সিন্ধের একটি মাদরাসার কথা লিখেছেন। তিনি এই মাদরাসায় এক রাত ছিলেন। গ্রীষ্মকাল ছিল তাই তিনি ছাত্রাবাসের ছাদে ঘুমিয়েছেন। দিল্লির মাদরাসা ফিরোজশাহী সম্পর্কে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারনী লিখেছেন, আদিল শাহ শাহী মাদরাসার ছাত্রদের জন্য দারুল ইকামার ব্যবস্থা করেন। তাদেরকে প্রতিদিন খাবার দেয়া হত। পড়ার জন্য কিতাব দেয়া হত। মাসিক ভাতা দেয়া হত।
এ সকল ভবনে উস্তাদরাও থাকতেন। তারা ছাত্রদের পড়াশোনার দিকে খেয়াল রাখতেন। তাদের স্বভাব চরিত্র গঠনে কাজ করতেন। নিজেরা এমনভাবে চলাফেরা করতেন, যেন তাদের আখলাক দেখেই ছাত্ররা নিজেদের বদলে নেয়। সাধারণত উস্তাদরা থাকতেন নিচতলায়। ছাত্ররা থাকত দোতলায়।
উস্তাদরা এমনভাবে চলাফেরা করতেন, তাদেরকে ছাত্ররা শ্রদ্ধাও করতো আবার উপকৃতও হতো। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া উস্তাদরা নিজের কামরা থেকে বের হতেন না। সবসময় সালাত জামাতের সাথে মসজিদে আদায় করতেন। মুস্তাহাব আমল করার প্রতিও তারা সচেষ্ট ছিলেন। দরসের সময় ছাড়াও আলাদা সময় নির্ধারিত ছিল । সে সময় ছাত্ররা এসে পড়া সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে আলাপ করতে পারতো। উস্তাদদের অনেকে রাতের বেলাতেও পড়াতেন। যেমন ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আশ শাইবানী রাতের বেলা সিসিলি বিজেতা আসাদ ইবনুল ফুরাতকে পড়াতেন।
ছাত্রদের জন্য কিছু নিয়ম ছিল, যেমন-
১। কমবয়সী ছাত্রদেরকে অভিবাবক ছাড়া দারুল ইকামায় অবস্থানের অনুমতি দেয়া হত না।
২। বিনা প্রয়োজনে দারুল ইকামার বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না।
৩। অপরিচিত লোকজনকে দারুল ইকামায় প্রবেশের অনুমতি দেয়া হত না।
৪। ছাত্র, উস্তাদ ও কর্মচারী ব্যতিত আর কারো রাতের বেলা মাদরাসায় অবস্থানের অনুমতি ছিল না।
৫। শরিয়তের বিধি-বিধান মেনে চলা বাধ্যতামূলক ছিল।
৬। শিক্ষকদের সাথে দেখা করার সময় আদবের দিকে খেয়াল রাখতে হত।
৭। দরসে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হত।
৮। হাসি-ঠাট্টা ও গল্পগুজব করা নিষেধ ছিল।
মাদরাসার কুতুবখানা
মাদরাসার সাথে নিজস্ব কুতুবখানাও নির্মাণ করা হত। ছাত্র উস্তাদ সকলেই এটি ব্যবহার করতো। জামিয়া মুস্তানসিরিয়া প্রতিষ্ঠিত হলে শাহী কুতুবখানা থেকে একশো ষাট উট ভর্তি কিতাব পাঠানো হয় মাদরাসার কুতুবখানার জন্য। আল হাকেম মিসরে দারুল হিকমাহ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদরাসা সম্পর্কে আল্লামা মাকরেজি লিখেছেন, এই মাদরাসায় আমিরুল মুমেনিনের পক্ষ থেকে এতবেশি কিতাব পাঠানো হয়, যা আমি এর আগে কখনো দেখিনি। এই কুতুবখানা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। কেউ কিতাব পড়তে আসতো, কেউ আসতো অনুলিপি তৈরী করতে। অনেকে আবার পড়ার জন্য বই নিয়ে যেত। এই কুতুবখানায় কাগজ, কলম ও দোয়াত পাওয়া যেত।
মাদরাসা নাসিরিয়াতেও একটি বিশাল কুতুবখানা ছিল। (৮)
বসার স্থান
প্রতিটি হলে উস্তাদদের বসার জন্য আলাদা স্থান নির্মান করা হত। ইবনে বতুতা জামিয়া মুস্তানসিরিয়া সম্পর্কে লিখেছেন, এখানে চার মাজহাবের ছাত্রদেরকেই পড়ানো হয়। সবার জন্য আলাদা আলাদা দরসগাহ (ক্লাসরুম)। উস্তাদদের জন্য কাঠের উপর বিছানা পাতা থাকে।
পোষাক
শিক্ষকদের নির্দিষ্ট পোষাক থাকতো। জামিয়া মুস্তানসিরিয়ার শিক্ষকরা কালো আবা ও পাগড়ি পরতেন। দরসের সময় এ পোষাক পরা বাধ্যতামূলক ছিল।
শিক্ষক নির্বাচন
শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হতো অনেক যাচাই-বাছাই করে। জামিয়া নিজামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা নিজামুল মুলক বলখের একটি গ্রামে বেড়াতে যান। সেখানে তিনি একজন আলেমের খ্যাতি শুনে তার সাথে দেখা করেন। পরে তাকে বাগদাদ নিয়ে আসেন এবং জামিয়া নিজামিয়াতে নিয়োগ দেন। নিজে তার কাছে সুনানে আবু দাউদ পড়েন। এই আলেমের নাম হাফেজ আবু আলি হাসান বিন আলি দাখশি।
বেতন-ভাতা
উস্তাদদেরকে বেতন দেয়া হতো। তবে অনেকে বেতন গ্রহণ করতেন না। তারা উপার্জনের জন্য অন্য মাধ্যম খুঁজে নিতেন।
দরসে উস্তাদদেরকে সাহায্য করার জন্য থাকতেন মুয়িদ। তার কাজ ছিল উস্তাদদের আলোচনা আবার ছাত্রদের বুঝিয়ে দেয়া। ইবনে বতুতা লিখেছেন, উস্তাদদের দুপাশে দুজন মুয়িদ থাকেন। মর্যাদার দিক থেকে এদের অবস্থান হলো ছাত্র-উস্তাদের মাঝামাঝি। তারা মাদরাসাতেই অবস্থান করেন। দরসের পর ছাত্ররা কোনো পড়া ভুলে গেলে তারা তা মনে করিয়ে দেন।
হিজরী দশম শতাব্দী পর্যন্ত মাদরাসায় মুয়িদের পদ অবশিষ্ট ছিল।
আরেকটি পদ ছিল নকীবে দরস। তার কাজ ছিল ছাত্রদেরকে তাদের অবস্থান অনুযায়ী আসনে বসানো। এছাড়া কেউ দরসের মাঝে কথা বলে উঠলে সে তাদের ইশারায় চুপ করাতো।
শিশুদের শিক্ষা
শিশুদের অল্পবয়সেই শিক্ষা শুরু হত। ভারতবর্ষে মুঘল আমলে ৪ বছর ৪ মাস ৪ দিন বয়সে বাচ্চাদের পড়ালেখা শুরু করার নিয়ম ছিল। খতীব বাগদাদি বলেন, আমি এগারো বছর বয়সে হাদিস শ্রবণ শুরু করি। (৯)
ছাত্রদের জন্য বয়সের কোনো সীমা নির্ধারিত ছিল না। যখন যার সুযোগ হতো পড়াশোনা শুরু করতেন।
অনেকে লেখাপড়া শেষ করেও উস্তাদের কাছে দীর্ঘদিন থেকে যেতেন। ইবনে খাল্লিকান লিখেছেন, আবদুল্লাহ বিন ওহাব মালেকি ছিলেন মিসরে ইমাম মালেকের ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ২০ বছর ইমাম মালিকের সান্নিধ্যে ছিলেন।
আবু ইসহাক সিরাজি তার উস্তাদ গাজি আবুত তিবের কাছে টানা ১০ বছর অবস্থান করেন। হাকিম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী তার উস্তাদ শায়খ আবুল হোসাইন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব নিশাপুরির কাছে ২০ বছর অবস্থান করেন।
ইবনে মাগরেবি বলেন, আমি ইবনে হাজমের কাছে ৭ বছর অবস্থান করি এবং তার সকল লেখা পড়ে ফেলি। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
পুরো শিক্ষাক্রম সমাপ্ত করতে কত বছর লাগতো তার সঠিক কোনো পরিমাপ নেই। ইবনে খালদুন লিখেছেন, মরক্কোতে পড়ালেখা শেষ করতে ১৬ বছর ব্যয় হয়। আবার তিউনিসে এই সময় ৫ বছর।
মাদরাসায় তীরন্দাযি ও ঘোড়দৌড় এসবও শেখানো হত। ইমাম শাফেয়ী ১০ টি তীর নিক্ষেপ করলে একটিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো না। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
ইমাম বুখারী প্রায়ই ঘোড়ায় চড়ে খোলা ময়দানে বের হতেন এবং তীর নিক্ষেপ করতেন। (ফাতহুল বারীর ভূমিকা) (১০)
উলামাগন বিকালে হাটতে বের হতেন। মুক্ত বাতাসে তাদের ক্লান্তি দূর হত। ইবনে খাল্লিকান লিখেছেন, আবু নসর ফারাবি দামেশকে অবস্থানের সময় বাগানে বসেই লেখালেখি করতেন। ইবনে বতুতা লিখেছেন, কওয়ামুদ্দিন কিরমানির কথা। তিনি জামে আজহারে দরস দিতেন। আসরের পর খোলা প্রকৃতিতে হাটতে বের হতেন।
ইমাম ইবনে খুজাইমা ৩০৯ হিজরীতে তার বাগানে আলেমদের দাওয়াত দেন। শহরের সব মুহাদ্দিস ও ছাত্ররা উপস্থিত হন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
ছাত্রদেরকে শাসনের ক্ষেত্রে কঠোরতা করা হতো না। নম্রভাবে শাসন করা হত। কিন্তু কারো অপরাধ গুরুতর হলে কিংবা সেই অপরাধের প্রভাব অন্যদের মধ্যে ছড়ানোর আশংকা থাকলে কঠোর শাস্তি দেয়া হত। ইয়াহইয়া বিন মুহাম্মদ বিন ইয়াহইয়া বলেন, একবার কাজি আসাদ ইবনুল ফুরাত দরস দিচ্ছিলেন।
রুইয়াতে বারি তাআলা’ মাসআলা নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। দরসে একজন ছাত্র সুলাইমান মুতাজেলিও উপস্থিত ছিল। সে এটি অস্বীকার করে এবং আবোলতাবোল প্রশ্ন করে। তখন আসাদ ইবনুল ফুরাত তাকে প্রহার করেন। (তারিখে সকলিয়্যাহ)
এসব মাদরাসায় বার্ষিক পরীক্ষা হতো কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। তবে বিজাপুরে আদেল শাহি মাদরাসায় বার্ষিক পরীক্ষা হত এবং ছাত্রদেরকে পুরস্কৃত করা হত। বেশিরভাগ মাদরাসায় শুক্রবার ও মংগলবার বন্ধ দেয়া হত। এই দুদিন ছাত্ররা বিভিন্ন কিতাবের প্রতিলিপি প্রস্তুত করতো। মৌসুমী ছুটির ব্যবস্থা ছিল কিনা সে ব্যাপারে তথ্য নেই তবে কাজি ইবনে জুমআ প্রচন্ড গরমে ও শীতকালে দরস দিতে নিষেধ করেছেন। (তাজকিরাতুস সামি ওয়াল মুতাকাল্লিম)
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল পিতাপুত্রের মতই। তবে দরসগাহে ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা হত। ইমাম মালিকের দরসগাহ সম্পর্কে কুতাইবা বলেছেন, ইমাম মালিকের দরসগাহ ছিল ভাবগাম্ভীর্যপূর্ন। ইলম ও প্রজ্ঞার মজলিস। কোনো হৈ চৈ করা হত না।
ছাত্র অসুস্থ হলে উস্তাদরা দেখতে যেতেন। কেউ ভুল করলে ইশারায় সতর্ক করতেন। এতেও সতর্ক না হলে সরাসরি বলতেন। বিদায়ের সময় অসিয়তবানী লিখে দিতেন। এই অসিয়তবানী অনেক সময় কিতাবাকারে প্রকাশিত হত।
কাজি ইবনে জুমআ লিখেছেন, কোনো ছাত্র উপস্থিত না হলে উস্তাদের জন্য আবশ্যক তার অনুপস্থিতির কারন জানা। সম্ভব হলে উস্তাদ নিজে তার কাছে যাবে। কাজি আবু ইউসুফ বলেন, আমি ইমাম আবু হানিফার কাছে হাদিস ও ফিকহ পড়তাম। সে সময় আমাদের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। আমার পিতা আমাকে বললেন, আবু হানিফার দরসে বসার দরকার নেই। তিনি ধনী মানুষ। তিনি এসব পারবেন। আমরা দরিদ্র। আমাদেরকে আয় রোজগার করতে হবে। পিতার কথায় আমি কয়েকদিন দরসে গেলাম না।
পরে দরসে গেলে উস্তাদ আমাকে অনুপস্থিতির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি সব বললাম। দরস শেষে সবাই চলে গেল। উস্তাদ আমাকে বসতে বললেন। তিনি আমার হাতে ১০০ দিরহাম দিয়ে বললেন, এগুলো নিয়ে যাও খরচ করো। শেষ হয়ে গেলে আমাকে জানাবে। আবার দিব। আর কখনো দরসে অনুপস্থিত থেকো না। (ওফায়াতুল আইয়ান)
ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার সম্পর্কের গভীরতা অনুভব করা যায় খতীব বাগদাদির ঘটনা থেকেও। তিনি দামেশকের শাহী মসজিদে দরস দিতেন। আবু জাকারিয়া তাবরেযি তার কাছে আদব পড়তেন। তিনি মসজিদের মিনারের উপর একটি কক্ষে থাকতেন। একবার ছুটির দিনে খতীব বাগদাদি তার সাথে দেখা করতে আসেন।
তিনি বলেন, তোমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হলো। তাই আসলাম। এরপর কিছুক্ষণ থেকে চলে যাওয়ার সময় তিনি ছাত্রকে ৫ দিনার হাদিয়া দিলেন। বললেন, এটা দিয়ে কলম কিনবে। এর পরেও কয়েকবার তিনি এসেছিলেন ছাত্রের সাথে দেখা করতে। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
সিসিলি বিজেতা আসাদ ইবনুল ফুরাত বলেন, একদিন আমি ইমাম মুহাম্মদের দরসে বসা ছিলাম। রাস্তায় পানিওয়ালা আসার শব্দ শুনে উঠে গেলাম। পানি পান করে ফিরে এলে ইমাম মুহাম্মদ বললেন, তুমি রাস্তার পানি পান করো? আমি বললাম, আমি নিজেই তো রাস্তার ছেলে (এতীম)। রাতের বেলা আমার কাছে ইমাম মুহাম্মদের খাদেম আসলেন। তিনি আমাকে ৮০ আশরাফী দিয়ে বললেন, ইমাম মুহাম্মদ জানতেন না আপনি এতিম। এগুলো দিয়ে নিজের প্রয়োজন সারুন। (মাআলিমুল ঈমান ফি মারিফাতি আহলিল কাইরাওয়ান)
কোনো ছাত্র পেরেশানিতে থাকলে উস্তাদরা তার পাশে দাড়াতেন। শায়খ আবু ওয়াদ্দার স্ত্রী মারা গেলে তিনি পেরেশানির কারনে কয়েকদিন দরসে অনুপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি দরসে উপস্থিত হলে তার উস্তাদ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব তাকে অনুপস্থিতির কারণ জিজ্ঞেস করেন।
কারণ জেনে তিনি আফসোস করেন এবং ছাত্রকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বলেন। আবু ওয়াদ্দা বলেন তার মোহর আদায়ের সামর্থ্য নেই। অল্প কিছু দিরহাম আছে। এই কথা শুনে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব সেই সামান্য দিরহামে সেই মজলিসেই নিজের মেয়ের সাথে আবু ওয়াদ্দার বিয়ে পড়িয়ে দেন। সন্ধায় তিনি মেয়েকে আবু ওয়াদ্দর গৃহে দিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, আমি চাই না বিবাহের পর স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকুক। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিবের এই কন্যা ছিলেন আলেমা। হাদিস শাস্ত্রেও তার গভীর জ্ঞান ছিল। তার গুনে মুগ্ধ হয়ে মুসলিম বিশ্বের তৎকালীন যুবরাজ ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সাঈদ সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।(ওফায়াতুল আইয়ান)
মুজাকারা/আলোচনা
ইলমের মুজাকারা ছিল আলেমদের প্রিয় বিষয়। আলি বিন হাসান বিন শাকিক এবং আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক একরাতে ইশার সালাতের পর বাড়ি ফিরছিলেন। শীতের মৌসুম ছিল। চারপাশে ঘন কুয়াশা। তারা মসজিদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটি হাদিস নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। এই আলোচনাতেই তাদের সারারাত কেটে যায়। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
উলামায়ে কেরাম কোনো শহরে গেলে সেখানকার আলেমরাও তাদের কাছে আসতেন। তাদের মজলিসে বসতেন। আবু আলি নিশাপুরী বাগদাদ গমন করলে সেখানকার বিখ্যাত আলেমরা যেমন আবু ইসহাক বিন হামযা, আবু তালিব বিন নসর প্রমুখ উপস্থিত হন। তাকে হাদিসের দরস দিতে অনুরোধ করেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
মুনাজারা/বিতর্কসভা
সেকালে মুনাজারার ব্যাপক প্রচলন ছিল। উস্তাদ-ছাত্র সবাইই এতে অংশগ্রহণ করতো। উলুমুল হাদিস, ফিকহ, কালাম, আদব নানা বিষয়ে এসব বিতর্ক অনুষ্ঠিত হত। আমির কিংবা খলিফাও অনেক সময় এসব মজলিসে উপস্থিত হতেন।
ইলমের জন্য সফর করা
ইলমের জন্য সফর করা সাহাবিদের যুগ থেকেই শুরু হয়। তারা একেকটি হাদিস সংগ্রহের জন্য শাম থেকে মিসর, হেজাজ থেকে শাম সফর করেন। তাবেয়ীদের সময় এই সফর আরো বেড়ে যায়। আবু হাতেম রাজি বলেন, আমি সাত বছর সফর করি। এ সময় আমি এক হাজার ফারসাখের (১১) বেশি পথ অতিক্রম করি।
তারপর ফারসাখের হিসেব করা ছেড়ে দেই। আমি পায়ে হেটে মিসর থেকে বাহরাইন সফর করি। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে রামাল্লা আসি। সেখান থেকে তরতুস। এভাবে আমার বিশ বছর কেটে যায় ইলমের জন্য সফর করে। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
ইমাম বুখারী ষোলো বছর বয়সে নিজ এলাকার উস্তাদদের কাছে পড়াশোনা শেষ করে সফর শুরু করেন। বলখ, বাগদাদ, বসরা, শাম, আসকালান, দামেশক এসব এলাকায় সফর করে ইলম অর্জন করেন। ইমাম দারেমি হারামাইন, মিসর, খোরাসান, শাম, ইরাক এসব অঞ্চলে সফর করে ইলম অর্জন করেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
হাফেজ আবু বকর মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম ইলমের জন্য ইস্ফাহান, বাগদাদ, মোসুল, আসকালান, কুফা, তুসতর, বাইতুল মাকদিস, দামেশক, বৈরুত, রামাল্লা, ওয়াসিত, আসকার, হিমস, বাক্কা, মিসর এসব এলাকা সফর করেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
হাফেজ আবুল আব্বাস আহমাদ বিন মুহাম্মদ রাজি ছিলেন জন্মান্ধ। তবু তিনি ইলম অন্বেষনের জন্য বুখারা, নিশাপুর, বাগদাদ ও বলখে সফর করেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
হাফেজ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহেদ ১২০টি স্থানের নাম বলেন যেখানে তিনি ইলমের জন্য সফর করেছিলেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
ইমাম শাবী বলেন, যদি কেউ হেকমত শেখার জন্য শামের একমাথা থেকে ইয়ামানের অন্য মাথায় সফর করে তাহলে তার এই সফর বৃথা যায়নি।
ইলমের জন্য কষ্ট সহ্য করা
ইলমের পথে নানা বাধা-বিপত্তি আসলেও ছাত্ররা এই পথ ছাড়তেন না। আবু নসর ফারাবি রাতে পড়ার জন্য তেল পেতেন না। তাই তিনি চৌকিদারদের পাশে বসে তাদের প্রদীপের আলোয় পড়তেন। আবুল আলা হামদানি রাতের বেলা মসজিদের বাতীর আলোতে পড়তেন। (১২)
বেশিরভাগ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল তারা কম খেতেন। ইমাম শাফেয়ী বলেন, আমি ষোলো বছর ধরে পেট ভরে খাবার খাইনি। তাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল তারা কম ঘুমাতেন। ইমাম মুহাম্মদ রাতের পর রাত জেগে থাকতেন।
একবার তিনি আসাদ ইবনুল ফুরাতকে জাগানোর জন্য তার চেহারায় পানি মারেন। সময় ব্যয় করার ক্ষেত্রে তারা ছিলেন খুবই সতর্ক। যে কোনো মানুষের সান্নিধ্যও তারা গ্রহণ করতেন না। দুজন কোথাও একত্রিত হলেই ইলমের আলোচনা শুরু করতেন। বইকে তারা খুব সম্মান করতেন। এর উপর তারা অন্যকিছু রাখতেন না। হাতে অর্থ এলেই তারা কিতাব সংগ্রহ করতেন। কারো দ্বারা অনুলিপি তৈরি করতেন। দরিদ্র হলে নিজেই অনুলিপি তৈরী করতেন।
এ সময় তারা কয়েকটি বিষয়ে খেয়াল রাখতেন।
১। হাতের লেখা সুন্দর বা পৃষ্ঠার অলংকরণে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতেন না। শুধু স্পষ্টাক্ষরে লিখে যেতেন।
২। তারা লাল কালিতে লিখতে পছন্দ করতেন না।
৩। ধর্মীয় বইপত্র লেখার সময় অনেক সতর্ক থাকতেন। অযু করে নিতেন। আল্লাহ তাআলার নামের সাথে সম্মানসূচক তাআলা, সুবহানাহু, ও আযযা ওয়া জাল্লা ইত্যাদী লিখতেন। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নামের সাথে দরুদ লিখতেন। সাহাবিদের নামের সাথে রাদিয়াল্লাহু আনহু , সালাফদের নামের সাথে রহিমাহুল্লাহ লিখতেন।
শিক্ষকের সম্মান
ছাত্ররা শিক্ষককে খুবই সম্মান করতেন। শো’বা বলেন, আমি যার কাছ থেকে একটি হাদিস শুনেছি সারাজীবন আমি তার গোলাম। রবিআ বলেন, আমি ইমাম শাফেয়ীর সামনে আদবের কারনে পানি পান করার সাহসও করিনি।
দরসগাহের বিবরণ
শিক্ষকরা দরসে যেতেন গুরুত্ব সহকারে। তারা পরিচ্ছন্ন পোষাক পরতেন, শরীরে সুগন্ধী মেখে নিতেন। ইমাম মালেক দরসে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। তারপর পরিচ্ছন্ন পোষাক পরে সুগন্ধী মেখে দরসে যেতেন। দরসের আগে তিনি এই দুআ পড়ে নিতেন,
للهم إني أعوذ بك أن أضل أو أضل، أو أزل أو أزل، أو أظلم أو أظلم، أو أجهل أو يجهل علي
জিকির করতে করতে দরসে প্রবেশ করতেন। সবাইকে সালাম দিতেন। মাকরুহ ওয়াক্ত না হলে দরসগাহে দু’রাকাত সালাত পড়ে নিতেন। এরপর দরসে বসতেন।
শিক্ষকদের বসার স্থান একটু উঁচু হতো। আলেমদের বেশিরভাগ মসজিদের প্রাঙ্গণে দরস দিতেন। তারা কোনো পিলার বা খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে বসতেন। দরসে হাসি-তামাশা করা থেকে বিরত থাকতেন। ওয়াকি ইবনুল জাররাহ এর দরস সম্পর্কে সালেম বিন জানাওয়াহ বলেন, আমি তার সান্নিধ্যে সাত বছর ছিলাম। আমি তাকে কখনো থুথু ফেলতে দেখিনি। কোনো পাথরের টুকরো নাড়াচাড়া করতে দেখিনি (১৩)। যে গাম্ভীর্য নিয়ে দরসে বসতেন শেষ পর্যন্ত সেটা ধরে রাখতেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
দরসের শুরুতে কারী তেলাওয়াত করতেন। এরপর মুস্তামলি ও নকীব দাঁড়িয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলতেন। শিক্ষক বিসমিল্লাহ ও দরুদ পড়তেন। তারপর সবাইকে নিয়ে হাত তুলে দুআ করতেন। তারপর আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ পড়ে তাকরির শুরু করতেন। (তাজকিরাতুস সামি ওয়াল মুতাকাল্লিম)
দরসে কন্ঠস্বর থাকতো স্বাভাবিক। বেশি জোরেও নয়, আবার আস্তেও নয়। এমনভাবে কথা বলা হতো যেন উপস্থিত সবাই শুনতে পারে। কিন্তু মজলিসের বাইরে আওয়াজ না যায়। মাসআলা বুঝানোর জন্য সাধারণত একটি কথা তিনবার বলা হত। কোথাও বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার হলে কিংবা ভ্রান্ত মতালম্বীদের রদ করতে হলে তাও করা হত।
দরস খুব বেশি লম্বা হতো না, আবার একেবারে সংক্ষিপ্তও হতো না। ছাত্ররা কোনো প্রশ্ন করলে শিক্ষক রাগ করতেন না। সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন। তবে কেউ অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করলে তাকে শান্তভাবে সতর্ক করতেন। মাঝে মাঝে ছাত্রদের প্রশ্ন করতেন। কঠিন প্রশ্ন হলে অনেক সময় জবাব দেয়ার জন্য এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় দিতেন। কখনো প্রশ্ন করে তাদের স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করতেন। জবাব পছন্দ হলে পুরস্কৃত করতেন। একবার ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম শাফেয়ীকে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। ইমাম শাফেয়ী উত্তর দিলে তিনি খুশি হয়ে তাকে একশো দিরহাম উপহার দেন। (মিফতাহুস সাআদাহ)
ভিনদেশী ছাত্রদের প্রতি তারা মমতার দৃষ্টি দিতেন। তাদের ভীতি ও একাকিত্ব দূর করার জন্য প্রায়ই তাদের সময় দিতেন। তাদের সাথে কথা বলতেন। শিক্ষকরা চেষ্টা করতেন প্রতিটি ছাত্রের নাম, বংশ, জন্মস্থান ও সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকতে। অন্য কোনো আলেম দরসে উপস্থিত হলে শিক্ষক পড়া থামিয়ে দিতেন। তাকে স্বাগত জানাতেন। এরপর আবার পড়ানো শুরু হত। সেই আলেম কোনো প্রশ্ন করলে জবাব দিতেন। জানা না থাকলে বলে দিতেন, জানা নেই। একে অপরকে সম্মান করতেন। ইমাম আউযায়ির কাছে আবু মুহাম্মদ সাইদ বিন আবদুল আজিজের উপস্থিতিতে কোনো প্রশ্ন করা হলে তিনি বলতেন, আবু মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করো। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
মুস্তামলি দাঁড়াতেন উস্তাদের ডানে বা বামে। সামনে বসতেন আলেমরা এরপর ছাত্ররা। ছাত্ররা উস্তাদের আগেই দরসে উপস্থিত হতেন। তারাও পরিপাটি পোষাক পরে আসতেন। শায়খ আবু উমর বিন সলাহ যেসব ছাত্র টুপি ছাড়া পাগড়ি পরে আসতো তাদেরকে দরস থেকে উঠিয়ে দিতেন। বইপত্র রাখা হতো কাঠের রেহালে বা হাতে। ছাত্ররা কোনো কথা বলতে হলে উস্তাদের অনুমতি নিতেন। কেউ কোনো দরকারে উঠে গেলে সে স্থান খালিই থাকতো, অন্য কেউ বসতো না। দরসের শুরু শেষে দরুদ পড়া হতো। লেখকের জন্য দোয়া করা হতো। দরস শেষে অনেকসময় উস্তাদ ছাত্রদের নসিহত করতেন। বাল্যকালে ছাত্রদের পিতামাতাই তাদের জন্য উস্তাদ নির্ধারণ করে দিতেন। ইমাম মুসলিমের সহপাঠী আহমাদ বিন সালামাহ বলেন, আমার পিতা আমাকে কুতাইবার দরসে বসার জন্য পাঠিয়েছিলেন।
পড়ালেখার সূচনা হতো কুরআনুল কারিমের মাধ্যমে। হিফজ ও তাফসির পড়ার পর অন্যান্য ইলম অর্জন করা হত। ইবনু আবি হাতেম বলেছেন, আমার পিতা আমাকে ততক্ষণ হাদিস সংগ্রহের অনুমতি দেননি যতক্ষণ আমি ফজল বিন শাজানের কাছে কুরআন খতম করিনি। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
ভারতবর্ষেও এমনই নিয়ম ছিল। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী বলেছেন, তিনি প্রথমে কুরআন শিখেছেন। (১৪) কুরআন খতমের আগে অন্য কোনো ফন বা শাস্ত্র পড়ানো হতো না। ইবনে খালদুন লিখেছেন, মরক্কোর লোকেরা বাচ্চাদের শিক্ষার শুরুতে কেবল কুরআনুল কারিম শিক্ষা দেয়। এ সময় তারা হাদিস বা ফিকহ পড়ায় না। আন্দালুসে কোরআনের সাথে আরবী ব্যকরন, কাব্য এবং হস্তলিপিও পড়ানো হত। আন্দালুসে হস্তলিপিকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হত। আফ্রিকার লোকেরাও আন্দালুস দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তারাও হস্তলিপিকে বেশ গুরুত্ব দিত। (১৫)
কুরআন পড়ার পর ফিকহ, হাদিস, তাফসীর ইত্যাদী পড়ানো হত। গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলী মুখস্থ করানো হত। এটার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হত। এমনকি সুলতানদের পক্ষ থেকেও এ কারনে পুরস্কার দেয়া হত। মিসরের অনেক সুলতান ইমাম মুহাম্মদের কিতাব মুখস্থ করার কারনে ছাত্রদের পুরস্কৃত করতেন। সাহাবী, তাবেয়ী , খলিফা্ মুহাদ্দিস, ফকিহদের জীবনি ও ঘটনাবলী পড়ানো হত। মুখস্থও করানো হত।
ইমাম যাহাবী ফকিহ ইউনিনির ব্যাপারে বলেছেন, তিনি প্রথমে কুরআন হিফজ করেছেন। এরপর হুমাইদির আল জামউ বাইনাস সহিহাইন মুখস্থ করেছেন। হারিরির তিনটি মাকামাত মুখস্থ করেন। ইমাম বুখারী বাল্যকালেই ইবনুল মুবারকের বইপত্র মুখস্থ করেন। ইবনে কুতাইবার ছেলে আবু জাফর আহমদ সম্পর্কে সুয়ুতি বলেছেন তার পিতার সব কিতাব (২১ টি) তিনি মুখস্থ করেছিলেন।
উসমান ইবেন দাউদ মুলতানির হেদায়া, বাযদাভী, এহইয়াউল উলুম ইত্যাদী গ্রন্থ মুখস্থ ছিল। (সিয়ারুল আউলিয়া)। দাউদ কাশ্মিরীর মিশকাতুল মাসাবিহ মুখস্থ ছিল।
পড়ানোর ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি পদ্ধতী ছিল।
১। উস্তাদ নিজেই পড়তেন ও ব্যখ্যা করতেন।
২। ছাত্র পড়তো, উস্তাদ ব্যখ্যা করতেন।
সনদ
পড়ালেখা শেষে ছাত্রদের সনদ দেয়া হত। একটি ছিল ইজাজত। অর্থাৎ উস্তাদ একজন ছাত্রকে একটি কিতাবের কিছু অংশ পড়িয়ে দিতেন। এরপর বাকি অংশ তাকে এমন কারো কাছে পড়ার অনুমতি দিতেন যাকে উস্তাদ আগে সনদ দিয়েছেন। ইমাম শাফেয়ী একজন ছাত্রকে কিতাবুল উম্মের কিতাবুস সালাত ও কিতাবুল মানাসিক পড়িয়ে দেন। এরপর তিনি বাগদাদ গেলে সেখানে একজন তার কাছে কিতাবুল উম্ম পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। তখন ইমাম শাফেয়ী তাকে বলেন, আমি তোমাকে ইজাজত দিচ্ছি। তুমি আমার অমুক ছাত্রের কাছে গিয়ে এই কিতাব পড়ে নাও। (তকাবাতুশ শাফিয়িয়্যাহ)
মাদরাসায় ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে গনিত, চিকিৎসাবিদ্যা,জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদীও শেখার সুযোগ ছিল। যারা আগ্রহী হতেন তারা পড়ে নিতেন। প্রতিদিন একেকজন ছাত্রকে অনেকগুলো বিষয় পড়তে হতো। ইমাম যাহাবী , ইমাম নববীর প্রতিদিনের যে পাঠ্যতালিকা দিয়েছেন তা নিম্মরুপ-
আল ওয়াসিত, কিতাবুল মুহাজ্জা্ হুমাইদির আল জামউ বাইনাস সহিহাইন, সহিহ মুসলিম, তা’রীফ,
আসমাউর রিজাল, উসুলুদ দীন, মানতিক। তিনি এসব পড়তেন এবং নোট করতেন।
সকল বিষয়ের জন্য ঐ সময় পর্যন্ত রচিত বুনিয়াদি গ্রন্থগুলো পড়ানো হত। হাদিসের জন্য সহিহাইন পড়ানো হত। এরপর সিহাহ সিত্তার বাকি কিতাবগুলো। এরপর সুনানে বাইহাকি, মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, মুসনাদে বাযযার, মুসনাদে হুমাইদি ইত্যাদী পড়ানো হত। উসুলে হাদিসের জন্য ইমাম দারা কুতনির কিতাবুল ইলাল, হাকিম আবু আবদুল্লাহর মারিফাতু উলুমিল হাদিস ইত্যাদি পড়ানো হত। এরপর আরো ইলম অর্জনের জন্য ছাত্ররা এক শহর থেকে অন্য শহরে সফর করতেন।
আবু ইসহাক ইবরাহিম বিন আহমদ নিশাপুরি সম্পর্কে ইবনে আসাকির লিখেছেন, তিনি প্রথমে নিশাপুরে হাদিস শুনেন। এরপর তিনি নাসা গমন করেন। সেখানে হাসান বিন সুফিয়ান থেকে মুসনাদে ইবনে মুবারক ও মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা শ্রবন করেন।
টীকা
——————–
১। সুফফা মাদরাসার শিক্ষাপদ্ধতী নিয়ে ডক্টর তাফসির আব্বাস ‘দরগাহে সুফফা কা নেজামে তালিম ও তরবিয়ত’ নামে একটি বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেছেন।
২। সাহাবায়ে কেরামের দরসগাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন কাজি আতহার মোবারকপুরী লিখিত ‘খাইরুল কুরুন কি দরসগাহে আওর উনকা নেজামে তালিম ও তরবিয়ত’ বইটি।
৩। সহীহ বুখারীর ইলম অধ্যায়ে বর্নিত আছ, হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা) একটি হাদিস সংগ্রহের জন্য এক মাস সফর করে হযরত আবদুল্লাহ বিন উনাইসের (রা) কাছে যান। এ সম্পর্কে আরো বর্ননা পেতে দেখুন খতিব বাগদাদী লিখিত ‘আর রিহলাহ ফি তলাবিল হাদিস’ গ্রন্থটি ।
৪। তবাকাতুশ শাফেয়িয়্যাহ আল কুবরা, ৪য় খন্ড, ৩১৩ পৃষ্ঠা– আল্লামা তাজ উদ্দিন আস সুবকী। দার এহইয়ায়িল কুতুবিল আরাবিয়্যা।
এ সম্পর্কে আরো কয়েকটি মতামত উদ্ধৃত করা হল-
ঐতিহাসিক মাকরেজির মতে হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পরে স্বতন্ত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয় (আল মাওয়ায়েজ ওয়াল ইতিবার বিজিকরিল খিতাতি ওয়াল আসার, ৪র্থ খন্ড, ১৯৯ পৃষ্ঠা– তকিউদ্দিন আবুল আব্বাস আহমদ বিন আলী। ) বিখ্যাত ভূগোলবিদ মাকদেসী হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তার লেখাতেও দেখা যায় হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে মসজিদেই দরস দেয়া হতো (আহসানুত তাকাসিম ফি মারিফাতিল আকালিম, পৃষ্ঠা ২০৫– আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ বিন আহমদ মাকদেসী। দার সাদের, বৈরুত )।
ড. নাজি মারুফের অনুসন্ধান মতে জামেয়া নিজামিয়া নিশাপুর , জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদের ৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় (মাদারিসুন কবলান নিজামিয়্যা — ড. নাজী মারুফ। প্রবন্ধটি অনলাইনে আছে)। ঐতিহাসিক মাকরেজির মতে সর্বপ্রথম নিশাপুরের মাদ্রাসা বাইহাকিয়্যা প্রতিষ্ঠিত হয় (আল মাওয়ায়েজ ওয়াল ইতিবার বিজিকরিল খিতাতি ওয়াল আসার, ৪র্থ খন্ড, ১৯৬ পৃষ্ঠা– তকিউদ্দিন আবুল আব্বাস আহমদ বিন আলী)। জালালুদ্দিন সুয়ুতী লিখেছেন ৪০০ হিজরীতে মিসরে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয় (হুসনুল মুহাজারা ফি তারিখি মিসর ওয়াল কাহেরা, ২য় খন্ড, ৩০৯ পৃষ্ঠা– আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতী)।
ঐতিহাসিক কাসেম ফেরেশতা লিখেছেন ৪ ১০ হিজরীতে মাথুরায় সুলতান মাহমুদ গজনভী একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন (তারীখে ফেরেশতা, ১ম খন্ড, ৩০ পৃষ্ঠা– আবুল কাসেম অস্ত্রাবাদী। নওল কিশোর প্রেস, লখনৌ )।
৫। অবশ্য হিন্দুস্তান কি কদিম ইসলামি দরসগাহে বইয়ের লেখকের অনুসন্ধান মতে ভারতবর্ষে প্রথম মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় আজমীরে, মুহাম্মদ ঘুরীর বিজয়ের পর।
৬। এ বিষয়ে আরো জানতে দেখুন ড. মুস্তফা আস সিবায়ী রচিত ‘মিন রাওয়াইউ হাদারাতিনা”।
৭। ইমলা ছিল এক ধরণের বিশেষ মজলিসের নাম।
এই পদ্ধতীতে শিক্ষক পড়াতে বসতেন, তার পাশে বসতো খাতা-কলম হাতে ছাত্ররা। শিক্ষক তার স্মৃতিশক্তি থেকে বলতে থাকতেন, ছাত্ররা তা লিখে ফেলতো। পরে এই কথাগুলোই স্বতন্ত্র পুস্তকের আকার ধারণ করতো। একে বলা হতো আমালি। আমালি ইবনে দুরাইদ এমনই এক গ্রন্থ। মজলিসে ছাত্র অতিরিক্ত হয়ে গেলে উস্তাদের ডানে বামে আরো ছাত্র দাঁড়িয়ে যেত। তারা উস্তাদের কথাগুলো হুবহু নকল করে দুরের লোকদের শুনিয়ে দিত। এদেরকে বলা হতো মুস্তামলি। ইমলার এই পদ্ধতি মুহাদ্দিসের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল। ইমাম মালেক, শু’বা, ইমাম দারা কুতনি, ইমাম বুখারী, ইমাম নাসায়ি প্রমুখের ইমলার মজলিস ছিল বিখ্যাত।
তবে ধীরে ধীরে ইমলার পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। হিজরী অষ্টম শতাব্দীতে হাফেজ যাইনুদ্দিন ইরাকি আবারও ইমলা চালু করেন। তিনি প্রায় চারশো ইমলার মজলিস করেন। তার দেখাদেখি তার ছাত্র হাফেজ ইবনু হাজার আসকালানি ও আল্লামা সাখাভীও এমন কিছু দরস দেন। তাদের পরেই এই ধারা সমাপ্ত হয়ে যায়। পরে আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতী ইমলার মজলসি করতে চেয়েও লোকদের অনাগ্রহ আর উদাসিনতার কারনে করতে পারেননি। (মাকালাতে শিবলী, ৩য় খন্ড –আল্লামা শিবলী নোমানী। দারুল মুসান্নেফিন,আযমগড়)। এ সম্পর্কে আরো জানতে দেখুন আবু সাদ আব্দুল করিম বিন মুহাম্মদ সামআনি (মৃত্যু ৫৬২ হিজরী) লিখিত ‘আদাবুল ইমলা ওয়াল ইস্তিমলা’ গ্রন্থটি।
৮। মাদরাসার সাথে সংযুক্ত অন্যান্য কুতুবখানাগুলো সম্পর্কে জানতে দেখুন ডক্টর শাবান আবদুল আজিজ খলিফা লিখিত ‘আল কুতুব ওয়াল মাকতাবাত ফিল উসুরিল উসতা’, সাইয়েদ নাশশার লিখিত ‘তারিখুল মাকতাবাত ফি মিসর- আল আসরুল মামলুকি’, ডক্টর ইয়াহইয়া ওহিব জুবুরি লিখিত ‘আল কিতাব ফিল হাদারাতিল ইসলামিয়্যা’।
৯। মুসলিম শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস সম্পর্কে ডক্টর শাবান আইয়ুব একটি চমৎকার গ্রন্থ রচনা করেছেন। বইটির নাম ‘কাইফা রব্বাল মুসলিমুনা আবনাআহুম’। কেউ আগ্রহী হলে দেখে নিতে পারেন।
১০। উলামায়ে কেরামের শরীরচর্চার আরো কিছু বর্ননা পেতে দেখুন নবাব সদরে ইয়ার জং হাবিবুর রহমান শেরওয়ানি রচিত ‘উলামায়ে সালাফ’।
১১। দূরত্ব পরিমাপের একটি একক। এক ফারসাখ= তিন মাইল। (তাজুল লুগাহ ওয়া সিহাহুল আরাবিয়্যাহ, ১৮২৩ পৃষ্ঠা)
১২। ইলম অর্জনে উলামায়ে কেরাম কীরুপ পরিশ্রম ও কষ্ট সহ্য করতেন তার কিছুটা ঝলক মিলবে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ লিখিত ‘সফাহাত মিন সবরিল উলামা’ গ্রন্থে।
১৩। অর্থাৎ অনর্থক কাজ করতেন না।
১৪। ভারতবর্ষে মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে দেখুন সাইয়েদ মানাজির আহসান গিলানি রচিত ‘হিন্দুস্তান মে মুসলমানো কা নেজামে তালিম ও তরবিয়ত’। এছাড়া শায়খ আবদুল হাই হাসানি নদভী লিখিত ‘আস সাকাফাতুল ইসলামিয়া ফিল হিন্দ’ গ্রন্থেও ভারতবর্ষে মুসলমানদের পাঠ্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা আছে।
১৫। আন্দালুসের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে দেখুন, ডক্টর সাদ আবদুল্লাহ সালেহ বাশারি রচিত ‘ আল হায়াতুল ইলমিয়্যা ফি আসরিল খিলাফাহ ফিল উন্দলুস’